দু’দিনে দুই ‘বুড়ো’-র দুই গল্প! বেঙ্গালুরু হারলেও ৪৩-এর ধোনিকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিলেন ৪০-এর সুনীল

প্রথম দৃশ্য: শুক্রবার চেন্নাই সুপার কিংস বনাম কলকাতা নাইট রাইডার্সের ম্যাচ সবে শেষ হয়েছে। হাতের দস্তানা খুলে এক বার রিঙ্কু সিংহের পিঠটা চাপড়ে দিলেন। এর পর প্রথামাফিক বিপক্ষের কিছু ক্রিকেটার এবং আম্পায়ারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাজঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। মুখে অব্যক্ত একটা যন্ত্রণা, যেখানে ধরা পড়ল যে তাঁর কয়েকটা সিদ্ধান্তই দলকে হারিয়ে দিল। তিনি ৪৩ বছরের মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।

দ্বিতীয় দৃশ্য: শনিবার মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট বনাম বেঙ্গালুরুর এফসি-র ফাইনাল। রেফারি শেষ বাঁশি বাজানোর সময় তিনি মাথা নীচু করে কোমরে হাত দিলেন। ক্ষণিকের স্তব্ধতা। এর পরেই গট গট করে হাঁটা দিলেন ডাগআউটের দিকে। সতীর্থেরা কেউ তখন হতাশায় মাটিতে শুয়ে পড়েছেন, কেউ মাটিতে মুখ গুঁজে দিয়েছেন, কেউ শূন্যে চেয়ে রয়েছেন। তাঁর সে দিকে ভ্রুক্ষেপও নেই। তিনি হাঁটছিলেন। দু’-একজন এসে পিঠ চাপড়ে দিলেন। তিনি তাকালেনও না। সোজা গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটা জলের বোতল বার করে আসনে বসে পড়লেন। তিনি ৪০ বছরের সুনীল ছেত্রী।

দু’দিনের ব্যবধানে ১,৬৬৭ কিলোমিটার দূরে দুই ‘বুড়ো’র কাহিনি এ ভাবেই লেখা হয়ে থাকল। প্রথম ‘বুড়ো’র হাতে এখনও সময় রয়েছে বাকি আইপিএলটা খেলার। দ্বিতীয় ‘বুড়ো’র আইএসএল যাত্রা শনিবারই শেষ হয়ে গেল কি না তা সময় বলবে। তবে দু’দিনে এটা প্রমাণিত, ৪৩-এর ধোনিকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিলেন ৪০-এর সুনীল।

চেন্নাই ছ’টা ম্যাচ খেলে ফেললেও ধোনিকে এ বার কখনও বাড়তি দায়িত্ব নিতে দেখা যায়নি। দলের ব্যাটিং-বিপদের সময় যখন তাঁকে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, তখন তিনি ব্যাট করতে নেমেছেন সবার পরে। যে দু’টি ম্যাচে আগে নেমেছেন, সেখানে চেন্নাই জয় থেকে অনেক দূরে ছিল। অতীতে পারলেও, এখন ৪৩ বছরে ক্রিকেট খেলা ধোনির পক্ষে সেই ম্যাচ জেতানো অসম্ভবই ছিল। সেই তুলনায় ৪০-এর সুনীল গোটা মরসুম জুড়ে দাপট দেখিয়েছেন। ১৪টি গোল এবং দু’টি অ্যাসিস্টই সে কথা বলে দিচ্ছে। শারীরিক ভাবে ক্রিকেটের থেকে ফুটবল খেলা অনেক কঠিন। তাই সুনীলের কৃতিত্ব ধোনির থেকে কিছুটা বেশি, এ কথা বললে হয়তো অত্যুক্তি করা হবে না।

ধোনি যেখানে ব্যাটিং অর্ডারে ক্রমশ নিজেকে পিছিয়ে দেন, সুনীল তার উল্টো। ফাইনালে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, পুরো ১২০ মিনিট খেললেন। বেঙ্গালুরুর হয়ে শেষ কবে ১২০ মিনিট খেলেছেন সেটা হয়তো নিজেই ভুলে গিয়েছেন। শনিবার তাঁকে এ ভাবেই দায়িত্ব নিতে দেখা গেল। ফ্রিকিক নেওয়া, হেড দেওয়া, রক্ষণ, আক্রমণ— সবেতেই পুরোভাগে তিনি। মোহনবাগানের ২৫ বছরের ফুটবলারও তাঁকে আটকাতে পারছিলেন না। এই বয়েসেও এতটাই তাঁর গতি। দিনের শেষে হয়তো সুনীলকে হেরে মাঠ ছাড়তে হল, কিন্তু মাঠের বাইরে তিনি জিতে গেলেন। জিতিয়ে দিলেন সেই সব মানুষকেও, সব বাধা অতিক্রম করে যাঁরা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন।

ম্যাচের আগে ওয়ার্ম-আপ করার সময়েই সুনীলের মুখটা লাগছিল পাথরের মতো। চাপা চোয়াল, কঠিন দৃষ্টি। মনেই হচ্ছিল কিছু একটা প্রমাণ করার চেষ্টায় রয়েছেন। তত ক্ষণে টিম লিস্ট প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। প্রথম একাদশে জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। ফাইনালের আগে ২৭টি ম্যাচে ১৮৪৪ মিনিট খেলেছিলেন সুনীল। অর্থাৎ কোচ জেরার্ড জারাগোজ়া তাঁকে সব ম্যাচে প্রথম একাদশে রাখেননি। ৪০ বছর বয়সে এসে গোটা একটি লিগের প্রতিটি ম্যাচে শুরু থেকে খেলা মুখের কথা নয়। কিন্তু ফাইনাল অন্য লড়াই। জারাগোজ়া জানতেন, এই ম্যাচে সুনীলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। তাই হর্হে পেরেরা দিয়াসের মতো ফুটবলারকে বসিয়ে নামিয়ে দিয়েছিলেন সুনীলকে।

ম্যাচ শুরুর আগে সেই সুনীলকেই দেখা গেল বেশ হালকা মেজাজে। সেন্টার লাইনে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে গল্প করছিলেন মনবীর সিংহের সঙ্গে, যেন গ্রুপ লিগের ম্যাচ খেলতে নামছেন। ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজার পরেই ‘সিরিয়াস’। শুরু থেকেই ছুটছিলেন। দেড় মিনিটের মাথায় প্রথম বার বল ‘হাতে’ পান। থ্রো করেন সতীর্থ এদগার মেন্দেসকে। এর পর বল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হাতে লাগিয়ে নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হয়ে যান। ১৭ মিনিটের মাথায় বক্সের ঠিক বাইরে ফ্রিকিক পেয়েছিল বেঙ্গালুরু। সুনীলই ফ্রিকিক নেন। কিন্তু ‘ডেক্লান রাইস’ হয়ে উঠতে পারলেন না। বল সোজা লাগল ওয়ালে। দু’মিনিট পরেই কর্নার থেকে হেড শুভাশিস বসুর বুকে লেগে ফিরল। তীরের ফলার মতো যে ভাবে মোহন-রক্ষণকে বিভ্রান্ত করে বলের কাছে ছুটে গেলেন, কে বলবে বয়স ৪০ পেরিয়েছে। কৌশল অনুযায়ী খেলছিলেন একটু পিছন থেকে। কিন্তু বল কেড়ে নেওয়ার ক্ষিপ্রতা ছিল আগের মতোই। সংযুক্তি সময়ে রায়ান উইলিয়ামসের ক্রসে তাঁর হেড ঠিক জায়গায় থাকলে তখনই এগিয়ে যেত বেঙ্গালুরু।

দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগান আক্রমণ বাড়ানোর পর সে ভাবে বল পাচ্ছিলেন না। তখন নিজের কাজটা নিজেই একটু বদলে নেন। নীচে নেমে এসে মোহনবাগান ফুটবলারদের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। সুনীলের খেলোয়াড়োচিত রূপও দেখা গেল। তাঁর পায়ে লেগে বল নিজেদেরই জালে জড়িয়ে দেওয়ার পর হাঁটুতে হাত দিয়ে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আলবের্তো। পিছন থেকে দৌড়ে এসে পিঠ চাপড়ে তাঁকে উৎসাহ দিয়ে যান সুনীল।

দ্বিতীয়ার্ধ যত এগোল, আক্রমণাত্মক সুনীলের জায়গায় দেখা গেল রক্ষণাত্মক সুনীলকে। মোহনবাগানের টানা আক্রমণে বেঙ্গালুরু যখন দিশেহারা, তখন সুনীল নীচে নেমে আসেন। মোহনবাগানের কর্নারের সময় দু’বার উড়ে আসা বল হেড করে ক্লিয়ার করে দিয়েছেন। দরকারের সময় ট্যাকল করেছেন। গোটা মাঠ ছুটেছেন। শেষের দিকে তাঁকে একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। তবে মুখেচোখে কখনওই তা ধরা পড়েনি। জেমি ম্যাকলারেন গোল করে মোহনবাগানকে এগিয়ে দেওয়ার পরেই সুনীলের বিশ্বাস ছিল ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। দ্রুত বল কুড়িয়ে সেন্টার লাইনে বসিয়ে খেলা শুরুর অপেক্ষা করতে থাকেন। সেই কাঙ্ক্ষিত গোল আসেনি। হয়তো সব লড়াই পূর্ণতা পায়নি বলেই।

গত কয়েক বছর ধরেই আইপিএল শুরু হওয়ার আগে একটা প্রশ্ন বার বার ওঠে, ‘এটাই কি ধোনির শেষ মরসুম?’ প্রশ্ন ওঠে, চর্চা হয়, আবার মিলিয়েও যায়। অধিনায়ক থাকুন বা না থাকুন, কোনও না কোনও সময় হঠাৎ করে কোনও সাক্ষাৎকারে আবির্ভূত হয়ে ধোনি জানিয়ে দেন, তিনি অবসর নিচ্ছেন না। নিজের মুখে না বললে তো চেন্নাই সুপার কিংসের সিইও কাশী বিশ্বনাথন তো রয়েছেনই, যিনি প্রতি বছরই একই সংলাপ আউড়ে যান, ‘ধোনি যত দিন চায় তত দিন এই দলে খেলতে পারে’। তবে সত্যি বলতে, কত দিন? বয়সের কাছে এক দিন সবাইকে হার মানতে হয় এটা হয়তো তিনি ভুলে গিয়েছেন। টেস্ট, এক দিনের ক্রিকেট এবং টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ার সময় ধোনির ‘টাইমিং’ নিয়ে ধন্য ধন্য করেছিল দুনিয়া। আইপিএলে সেই সুযোগ দেননি ধোনি। বরং কানাঘুষো এটাও শোনা যাচ্ছে, মাহি-প্রেম বজায় থাকলেও ধোনির খেলা নিয়ে খুশি হতে পারছেন না চেন্নাই সমর্থকদের একাংশই। আইপিএল থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে ধোনির ‘টাইমিং’ কেন ঠিকঠাক হল না তা নিয়ে চর্চা জারি রয়েছে।

সমালোচনা কি সইতে হয়নি সুনীলকেও? যে শহর থেকে ফুটবলার হিসাবে পরিচিতি পাওয়া, সেই কলকাতাতেই ভারতের জার্সি গায়ে শেষ ম্যাচ খেলবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন সুনীল। তাঁর ‘আব্দার’ মেনে নিয়েছিল সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন। ৬ জুন বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনকারী ম্যাচে কুয়েতের বিরুদ্ধে খেলে শেষ ম্যাচ খেলে চোখের জলে বিদায় জানান। সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে লেখা খোলা চিঠি ভাইরাল হয়। তিনিও ‘নায়ক’ হওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি। তাই অবসর ভেঙে ফেরার অনুরোধ যখন আসে কোচ মানোলো মার্কেজ়ের থেকে, হ্যাঁ বলতে বেশি সময় নেননি। তবে সেটা করেছেন একান্তই দেশের জন্য। দেশের জার্সিকে ভালবেসে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করে দেওয়ার তাগিদ থেকে। সুনীলের ‘টাইমিং’ ঠিক হল কি না, তার উত্তর দেবে সময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.