এক গুপ্ত আত্মোন্নতির কথা : দ্বিতীয় পর্ব

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন , ” ভারত বর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্ত করিয়া পরীক্ষা দিই, তা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্ন কাহিনী মাত্র। …পাঠান মোগল পর্তুগিজ ফরাসি ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে। …ঘরের কথা কিছুমাত্র পাই না। সেই ইতিহাস পড়িলে মনে হয়, ভারতবর্ষ তখন ছিল না, কেবল মোগল-পাঠানের গর্জন মুখর বাত্যাবর্ত শুষ্কপত্রের ধ্বজা তুলিয়া উত্তর হইতে দক্ষিণে এবং পশ্চিম হইতে পূর্বে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।

কিন্তু বিদেশ যখন ছিল দেশ তখনো ছিল, নহিলে এই সমস্ত উপদ্রব্যের মধ্যে কবীর নানক চৈতন্য তুকারাম ইহাদিগকে জন্ম দিল কে? তখন যে কেবল দিল্লি এবং আগ্রা ছিল তাহা নহে, কাশী এবং নবদ্বীপও ছিল। তখন প্রকৃত ভারতবর্ষের মধ্যে যে জীবনস্রোত বহিতেছিল, যে চেষ্টার তরঙ্গ উঠিতেছিল, যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটিতেছিল, তাহার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না।”

ওই সময় বসে তিনি অনেক কঠিন সত্যকে প্রকাশ করেছিলেন। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত সেই আবেদন নিবেদন নীতি ও নরমপন্থার বিকৃত রাজনীতির স্বীকার আমাদের দেশ , সমাজ….আর আমাদের ইতিহাস।

হেথা একদিন বিরামবিহীন

              মহা ওংকারধ্বনি,

       হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে

              উঠেছিল রনরনি।

                    তপস্যাবলে একের অনলে

                           বহুরে আহুতি দিয়া

                    বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল

                           একটি বিরাট হিয়া।

              সেই সাধনার সে আরাধনার

              যজ্ঞশালায় খোলা আজি দ্বার…..
 পূর্ব পর্বেই উল্লেখ করেছিলাম যে কিরূপে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধীরে ধীরে চরমপন্থী বৈপ্লবিক মতের সমর্থক হয়ে পড়েছিল। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের আবেদন নিবেদন নীতির ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছিল ভারতীয় ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লববাদ।


মহারাষ্ট্রে উক্ত কারনেই উত্থান হল বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে । ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা হল সাভাকরের #মিত্রমেলা, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হল  #অভিনব_ভারত । মহারাষ্ট্রের বুকে এই যে ব্যাপক কর্মকান্ড চলেছিল , অরবিন্দ তা কেবল প্রত্যক্ষই করেননি, তার সঙ্গে যুক্তও ছিলেন।

sri aurobindo presiding over a conference of nationalist delegates at surat in december,1907 sri aurobindo, sitting with his hands on the table, flanked on his right by g.s. khaparde and on his left by lokmanya bal gangadhar tilak, speaking
Abhinab Bharat
Vinayak Damodar Savarkar


বিংশ শতাব্দীর সূচনা কালে অরবিন্দ বাংলার বুকে বিপ্লবী সংগঠন করার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন ।উনিশ শতকের শেষভাগ  থেকে বাংলার নানা শহরে শরীর চর্চার আখড়া, ব্যায়ামাগার ,লাঠি খেলার ক্লাব ইত্যাদি গড়ে ওঠে। পরে এরম অনেক আখড়াই বিপ্লবী তৎপরতার কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরিত হয় । 
অরবিন্দ ঘোষের দূত যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার আগেই ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয় অনুশীলন সমিতি এবং অবশ্যই বাংলার অন্যতম গুপ্তসমিতি আত্মোন্নতি  সমিতি। যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যভূষণ নিজেও হুগলী জেলার অনেক অঞ্চলে অনেকগুলি কুস্তি ও লাঠিখেলার আখড়া স্থাপন করেছিলেন ,যেগুলি সবই ছিল গুপ্ত সমিতি। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল  #গোন্দলপাড়ার _পাঠসমাজ। তবে যে কারণেই হোক উক্তিগুলো স্থায়ী হয়নি।

Pulin Bihari Das


এখানে ভীষণ ভাবে বলা দরকার যে ,যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ যখন সংস্কৃত কলেজে পড়তেন তখন প্রায় সমসাময়িক ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী এবং বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী ।  শিবনাথ শাস্ত্রী সংস্কৃতে এমএ পাস করে কিছুদিন হেয়ার স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করেন, পরে ব্রাহ্মসমাজের সর্বক্ষণের কর্মী এবং আচার্য হয়ে যান।
 বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী  কিছুদিন  বাংলায় ডাক্তারি কোর্স পড়তে পড়তে ছেড়ে দেন । তিনিও ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়েছিলেন ।সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তিনি আচার্য হয়েছিলেন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু পরে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের মেকি চিন্তা ও অসাড়তাকে উপলব্ধি করেছিলেন। শেষ জীবনে তিনি ব্রাহ্ম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন । বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীর ব্রাহ্ম থেকে যোগ হয়ে ওঠা এক সুবিশাল পথ চলা। তা নিয়ে অন্যএকদিন বলব। 


শিবনাথের  সঙ্গে যোগেন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব বরাবর বজায় ছিল। যোগেন্দ্রনাথ পরে সরকারী কাজে যুক্ত হন। বঙ্গীয় বৈপ্লবিক সমিতির মধ্যে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন নি।  কিন্তু বিপ্লবে পন্থায় অর্থাৎ গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে বৈপ্লবিক কাজে তাঁর সহানুভূতি ছিল।  বিদ্যভূষণের জামাতা ছিলেন ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায় । ললিতমোহন ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘাযতীনের মামা। ডক্টর ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন ” ললিতবাবুর এই সূত্রে দলের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং বোধহয় এই সূত্রে বৈপ্লবিক দলে যতীন্দ্রনাথের প্রবেশলাভ। 


যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ এর সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামী অনেকেরই যোগাযোগ ছিল। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে অধিষ্ঠিত থাকার সময় তিনি কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রিটে বসবাস করতেন । তাঁর সম্পর্কে বিপ্লবী ও আত্মোন্নতি সমিতির সদস্য অধ্যাপক নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য উত্তরকালে লিখেছিলেন –
“তিনি বলিলেন মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডিলেখার ফলে  বেটারা আমাকে নাস্তানাবুদ করিতেছে । সাতঘাটের জল খাওইয়া খারাপ জায়গায় বদলী করিয়া স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া দিয়াছে। অসুখের চিকিৎসার জন্য এখন কলিকাতায় বাস করিতেছি;  ব্যাটারা আমাকে কসাই গিরি করিতে বলে। তা’ পারি না , তাই প্রমোশন বন্ধ। লাটসাহেবের হুকুম – নো কনভিকশন নো প্রমোশন -। আমি দেখি বেশিরভাগ লোকই অভাবে পরিয়া চুরি করে। আমি আমার যোগশক্তির প্রভাবে তাদের জেলে দেওয়া উচিত কিনা বিচার করি । বেশিরভাগ অপরাধীকেই  খালাস দেই। সাহেবরা বলে আমি আদালতে ঘুমাই। মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া আমি সাধারণের সঙ্গে হরি সংকীর্তন করিয়া বেড়াই। ইহাতে তাহাদের প্রেস্তটিজ থাকে না । “


নিবারনচন্দ্রের ন্যায় শিক্ষিত যুবকেরাই ঝুঁকেছিলেন বিপ্লবী দলের দিকে। কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতাদের সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীলতার এবং ইংরেজদের অনুগ্রহ ভিক্ষা তাঁদের নতুন পথের কথা ভাবতে শেখায়। 
 ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন  , ” সাধারণের বিশ্বাস , স্বদেশী আন্দোলনের ফলে বাঙ্গালায় বৈপ্লবিকপন্থীয় গুপ্ত সমিতির আবির্ভাব হয় । ইহা একটা ঘোর ভুল ধারণা। আগেই বলিয়াছি যে,  স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বে বিপ্লববাদী গুপ্ত সমিতির প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল ।”

এই কথাটি সত্যি ।১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়।  আসলে ওই নামের যে সংগঠন সতীশচন্দ্র বসু, প্রমথনাথ মিত্র প্রমুখ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং অরবিন্দ ঘোষের প্রেরিত দূত যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় এসে যে” বঙ্গীয় বৈপ্লবিক সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা যুক্ত হয়েছিল ।নাম থাকে অনুশীলন সমিতি । এর মধ্যে মিশে গিয়েছিল আত্মোন্নতি সমিতি । যদি আখড়া বা গোষ্ঠী ধরা হয় তাহলে বেশ কিছু আখড়া বা গোষ্ঠীর ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে গড়ে উঠেছিল। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের ফলে এদের কাজকর্ম একটু গুটিয়ে গিয়েছিল বটে , তবে ১৯০২  সাল থেকে গুপ্তসমিতিগুলি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল । এরকম একটি দল হল সরলা দেবীর #বীরাষ্টমী_দল ।
বঙ্গীয় বৈপ্লবিক গুপ্তসমিতির এবং অনুষ্ঠানের সভাপতি পি.মিত্র ছিলেন নৈহাটির সন্তান । তিনিও দুই একটি দল গঠন করেছিলেন । একটি সমিতি ছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারে হেমচন্দ্র বসু মল্লিকের বাড়িতে । হেমচন্দ্র বসু মল্লিক ছিলেন রাজা সুবোধচন্দ্রের কাকা। 
যাই হোক আত্মোন্নতি সমিতি  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে পুরনো সেই বিষয় কোনো সন্দেহ নেই।  উনিশ শতকে  আরো দু-একটি সমিতি করা হলেও তা স্থায়ী হয়নি।
 সত্যেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন-
” অনুরূপভাবে উনিশ শতকের শেষের দিকে মধ্যে কলিকাতায় গড়ে উঠেছিল আত্মোন্নতি সমিতি নামের আরেকটি ঐরূপ প্রতিষ্ঠান। ১৮৯৭ সালে, যে বছরটি স্বামী অভেদানন্দের দ্বারা আমেরিকা বিজয় ভাস্বর,  সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের #ডন পত্রিকা প্রকাশে উজ্জ্বল আর সুভাষচন্দ্রের আবির্ভাবে জ্যোতির্ময় । সেকালের এক  প্রখ্যাত বিপ্লবী বা ইন্দ্রনাথ নন্দীর কাছে শোনা – রঘুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে খেলাৎচন্দ্র  স্কুলের একটি অগ্রনী ছাত্র ছিলেন । তিনি থাকতেন ওই স্কুলের কাছেই ওয়েলিংটন লেনে, তখনকার ১৩ নম্বর বাড়িতে। রঘুনাথ ছিলেন একটি উদ্দীপনাময় জীবন। এই রঘুনাথের প্রচেষ্টায় এবং হরিশচন্দ্র শিকদার , নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য ( পরে অধ্যাপক) প্রভৃতির নেতৃত্বে রঘুনাথের বাড়িতে নিম্নলিখিত সভ্যদের নিয়ে প্রথম সূচনা হয় #আত্মোন্নতি_সমিতি নামের এক পাঠচক্রের ।”
এই পাঠচক্রই পরে বিপ্লবী দল বা গোষ্ঠী তে রূপান্তরিত হয়। প্রাথমিকভাবে যাঁঁদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন – ১.রঘুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ২. নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য ৩.সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ৪. সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ৫.ভুবনেশ্বর সেন ৭. রাধারমন দাস , ৮. রুক্মিণী মুখোপাধ্যায়ম ,৯. নিত্যানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ১০. কৃষ্ণচরন মুখোপাধ্যায় , ১১.রাধিকা বন্দ্যোপাধ্যায় , ১২. অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
আরও ছিলেন – দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হৃষিকেশ দে, নন্দলাল দে , রনেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় , অহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিনোদলাল চক্রবর্তী প্রমুখ ।
ক্রমে সেই ১৩ নম্বর ওয়েলিংটনের বাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়াতে সমিতির অধিবেশন ও কাজকর্ম স্থানান্তরিত হয়ে যায় তিন নম্বর ওয়েলিংটনে অবস্থিত তখনকার খেলাৎচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের বাড়িতেই। আত্মোন্নতি সমিতির সভ্য হিসাবে যাঁরা যোগদান করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হল ১. প্রভাসচন্দ্র দে, ২. ইন্দ্রানাথ নন্দী, ৩. মুকুন্দলাল চক্রবর্তী , ৪. তিনকড়ি দে , ৫. রাজমোহন দাস , ৬. অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ,৭. গিরীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ৮. বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী।
এই যে প্রথম গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন আত্মোন্নতি সমিতি , তার যে সভ্যবৃন্দ – তাঁদের নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। মানে আজকাল বিশাল সব বিপ্লবীরা যাঁরা বিদেশি সব ব্যক্তিদের আইডল বানান তাঁদের একটু এসকল স্বদেশীয় বিপ্লবীদের জানা র প্রোয়জন আছে বৈকি….
আত্মোন্নতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা রঘুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা নির্মলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি কর্মচারী ছিলেন। পূর্বেই বলেছি যে রঘুনাথের গৃহেই সভার আয়োজন হত। পরবর্তী সময়ে রঘুনাথ ইন্দ্রনাথ নন্দীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের গোষ্ঠীতে যুক্ত হন। প্রসঙ্গত নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য খেলাৎচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ছিলেন।  পরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র মহালনবীশের সহকারী হিসাবে প্রেসিডেন্সিতে শরীর বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও খেলাৎচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ছিলেন। পরে বিপ্লবী সমিতিতে যুক্ত হন।ইনিই সেই ব্যক্তি যিনি অরবিন্দ ঘোষের পত্র নিয়ে মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক প্রমুখের সঙ্গে দেখা করেন।সতীশচন্দ্র রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন।তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্সি , পরে চট্টগ্রাম এবং সব শেষে হুগলি কলেজে অধ্যাপনা করেন।সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সতীশচন্দ্রের ভ্রাতা ছিলেন। হরিশচন্দ্র শিকদার বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তিনি যশোর জেলার মানুষ ছিলেন। কিন্তু কোলকাতার বউবাজার আর্মহাস্টস্ট্রিট জংশনের নিকট তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল। তিনিও খেলাৎচন্দ্র স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
প্রসঙ্গত একটি তথ্য দিয়ে রাখি, সেসময়ের অখন্ড ভারতের বাংলার পূর্ব অংশের হিন্দু মুসলমান সমস্যা থেকেই গেছিল। হিন্দুরা নানা ভাবে উৎপীড়ন হত সংখ্যালঘু দ্বারা।১৯০১ সালে এন্ড্রু ফ্রেজার বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। ১৯০৩ সালে তৈরি হল বঙ্গভঙ্গের খসড়া। এই খসড়ায় পূর্ব বঙ্গের চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা, ময়মনসিংহকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির #আয়তন_হ্রাস করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই বিষয় কার্জনের অনুমোদন পাওয়ার পর লন্ডনে কর্তৃপক্ষ নিকট অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে বলা হয় শাসনতান্ত্রিক সুবিধার জন্য বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব এবং নবগঠিত প্রদেশের নাম হবে পূর্ববঙ্গ অসম।
 এদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন সূচিত হয় সমগ্র ভারত জুড়ে। কার্জন প্রমাদ গুনে কার কাছে গেলেন? গেলেন পূর্ব বঙ্গ , অতিথি হলেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লার।সেখানে কি হল? সেখানে পরামর্শ হল পদ্মাপারে একটি ইসলামপ্রধান দেশ গঠন করা হবে । যার রাজধানী হবে ঢাকা। এই সময় ঢাকায় আয়োজিত বিশাল মুসলিম জনসভায় কার্জন তাঁর ভাষণে বলেছিলেন ” পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগন প্রাচীন সুলতান ও সুবেদারদের আমল থেকেই রাজনৈতিক ঐক্য বঞ্চিত, সে জন্য তাদের ঐক্য ফিরিয়ে দিতে হবে।”
ফলত, ব্যাপকভাবে হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষ বিস্তার লাভ করে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলায় এক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। বিপ্লবী কাজে গিয়ে সেই দাঙ্গা প্রতিরোধে অংশ নিয়েছিলেন এই হরিশচন্দ্র শিকদার।তাঁর সংগঠন প্রতিভা সকলের নিকট স্বীকৃত হয়েছিল। 
ভুবনেশ্বর সেন বউবাজার মদন বড়াল লেনের বাসিন্দা ছিলেন । পরে তিনি একজন নামকরা ব্যবসায়ী হল। 
রাধারমণ দাস ছিলেন উড়িষ্যার লোক। চাঁপাতলার লেডি ডাফরিন হাসপাতালের নিকট তিনি থাকতেন।
রুক্মিনী মুখোপাধ্যায় বউবাজার অঞ্চলেই থাকতেন।নিত্যানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ভাগ্নে ছিলেন কৃষ্ণচরণ মুখোপাধ্যায়।কৃষ্ণচরণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কালীচরণ মুখার্জি পশ্চিনবঙ্গে বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভায় ছিলেন। রাধিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বউবাজারের অধিবাসী ছিলেন।  দুর্গদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বিপ্লবী অনুকূলচন্দ্রের প্রতিবেশী ছিলেন।  


রনেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় হাওড়া ৬৪ নম্বর বিশ্বেশ্বর ব্যানার্জি লেনের অধিবাসী ছিলেন।অহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং বিনোদলাল চক্রবর্তী মিলে কলেজ স্ট্রিটে চক্রবর্তী চ্যাটার্জী নামে প্রসিদ্ধ বইয়ের দোকানে খোলেন।অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় বেঙ্গলী সংবাদপত্রের মালিক সহকারী সম্পাদক ছিলেন।
পূর্বেই বলেছি আত্মোন্নতি সমিতি ১৩ নম্বর ওয়েলিংটন লেন থেকে ৩ নম্বর ওয়েলিংটন স্কোয়ারে খেলাৎচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে স্থানান্তরিত হয়েছিল। স্থানান্তরিত হয়েছিল বলতে স্কুল বাড়িতেই সভা মিটিং , শরীর চর্চার কাজ চলত। পরে অনুশীলন সমিতিতে এক হয়ে যায়। এই স্থানান্তরিত হবার পরে যোগদান করেন প্রভাসচন্দ্র দে।ইনি ১৫ নম্বর বাঞ্চারাম অত্রুর দত্ত লেনের অধিবাসী ছিলেন।  উত্তরকালে তিনি কোচবিহার কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হন ।
ইন্দ্রানাথ নন্দী বৈপ্লবিক দীক্ষাদাতাদের মধ্যে একজন ছিলেন। ইনি আই এম এস সার্জেন ছিলেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম নন্দীর জ্যেষ্ঠ পুত্র, তখন থাকতেন কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়।
মুকুন্দলাল চক্রবর্তী হাইকোর্টের আইনজীবী ব্রজলাল শাস্ত্রীর ভ্রাতা ছিলেন।সেই সময় ওয়েলিংটন স্ট্রিটে থাকতেন। ব্রজলাল ,মুকুন্ডলাল ও বিনোদলাল তিন সহোদর ভ্রাতা ছিলেন। তিনকড়ি দে সতীশচন্দ্র দের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তিনি #বউবাজার_বালিকা_বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। 
রাজমোহন দাস ছিলেন ব্যায়ামচর্চাবিদ। থাকতেন ওয়েলিংটনের নিকটবর্তী চৈতন্য সেন লেনে।
অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পরবর্তীকালের একজন সক্রিয় বিপ্লবী । ৩৯ নং মলঙ্গা লেনে তাঁর বাস ছিল। গিরীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ৪/৩ নম্বর মলঙ্গা লেনের বাসিন্দা , যে বাড়ি পরে সক্রিয় বিপ্লবী  গোষ্ঠীর ঘাঁটি হয়ে ওঠে। 
বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী ছিলেন ৪ নম্বর দুর্গা পিতুরী লেনের বাসিন্দা। অক্ষয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও ক্ষীরোদা দেবীর সন্তান বিপিনবিহারী ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ৫ নভেম্বর , হুগলী ( পরে হাওড়া) জগৎব্ল্লভপুরের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই আত্মোন্নতি সমিতির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন।


#ক্রমশ:
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাংলার প্রথম বিপ্লবী গুপ্তসমিতি “আত্মোন্নতি সমিতি”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি
হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.