একটি দেশের শাসনব্যবস্থার মধ্যে অধিকার ভোগ করবে কে? রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর মূল দাবি কার? এ নিয়ে বিতর্ক আজকের নয়। শাসনব্যবস্থার সূত্রপাত থেকেই এই বিতর্ক চলছে। নাগরিকতা এক ধরনের আইনগত মর্যাদা, তা অর্জন করলে ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক ও সামজিক অধিকার অর্জন করার, ভোগ করার এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা পালন করার সুযোগ পায়। এ কারণে নাগরিকতাকে বলা হয় ‘অধিকার অর্জনের অধিকার’ (right to have rights)। নাগরিকতা বিষয়টি নিছক আইনগত বিষয় নয়। কেবল আইনগত বা সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে নাগরিকতার তাৎপর্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা অসম্ভব।
দেশের সমস্ত অধিবাসী নাগরিক হতে পারে না, নাগরিকদের সঙ্গে অ-নাগরিকদের অধিকারগত এবং মর্যাদাগত পার্থক্য আছে— এই ভাবনা প্রথম দেখা যায় গ্রিক নগররাষ্ট্রের রাজনৈতিক দর্শনে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায়। গ্রিক নগররাষ্ট্র বা city state যেগুলিকে গ্রিকরা পোলিস (polis) নামে অভিহিত। করতো সেখানকার সমাজের শ্রেণীভিত্তিক কাঠামোটি গড়ে উঠেছিল তিনটি জনগোষ্ঠীর স্তরের উপস্থিতি নিয়ে। সমাজ কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ক্রীতদাস বা slave। এটা। মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রাচীন ইউরোপের সর্বত্রই দাস প্রথার প্রচলন ছিল। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল্ মনে করতেন একটি পরিবার গড়ে ওঠে নারী, পুরুষ ও ক্রীতদাসকে নিয়ে। গ্রিক সমাজের মধ্যবর্তী স্তরে ছিল নগররাষ্ট্রে বসবাসকারী বিদেশি বা matics। বিদেশি হওয়ার কারণে এদের কোনো রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা অধিকার ছিল না। রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতো এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নিতে পারতো City-state-এ বসবাসকারী citizen বা নাগরিকরা। এরা জন্মসূত্রে স্বাধীন এবং নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করার একমাত্র অধিকারী। অ্যারিস্টটল তার Politics গ্রন্থে নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তৎকালীন ব্যবস্থা মেনে নিয়ে বলেছেন, সরকারি ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকেই কেবল নাগরিক বলা যাবে।
প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রেই কেবল নাগরিক এবং তার অধিকার নিয়ে ভাবনা ছিল না, প্রাচীন রোমানরাও নাগরিকতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতাব্দী জুড়ে দীর্ঘ দুশো বছর ধরে অভিজাতদের সঙ্গে সাধারণ মানুষদের যে দ্বন্দ্ব চলছিল (conflict between Patricians and Plebeians) তার নিরসন ঘটে উত্তম শ্রেণীর মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে। এই বোঝাপড়ার ফল হলো পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের সমতার ভিত্তিতে এক অভিন্ন রোমান নাগরিকত্বের প্রতিষ্ঠা। রোমানরা পার্শ্ববর্তী বহু অঞ্চল দখল করেছিল। বিজিত অঞ্চলের মানুষদের মর্যাদা কী হবে সে নিয়েও রোমানরা ভাবনাচিন্তা করেছে। তবে সে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পরিসর এখানে নেই।
সুতরাং নাগরিকতা বিষয়টির গুরুত্ব এবং এনিয়ে ভাবনাচিন্তা বহু পুরানো। দেশে শাসন ব্যবস্থা যখন প্রায় ধ্ৰুণাবস্থায় তখন থেকেই নাগরিকতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা, বিতর্ক চলছে। আধুনিক যুগে বিভিন্ন দেশ তার নাগরিকতা সম্পর্কিত বিধিব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং সেগুলো গড়ে তোলা হয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। দেশের নাগরিকতার প্রকৃতি তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত দ্বারাই বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। ভারতীয় নাগরিকতা আলোচনা করার সময় তার। ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে ভুলে গেলে চলবে না। ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে দুর্ভাগ্যজনক দেশভাগ যার অভিঘাত ভারত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দেশ বিভাগের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের মানুষ ভারতে চলে আসেন। দীর্ঘদিন ধরে এই দুটি অঞ্চল থেকে এই মানুষদের ভারতে আসার সম্ভাবনাও ছিল। এইসব বিষয়গুলি ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের মাথায় রাখতে হয়েছিল। ফলে ভারতীয় নাগরিকতা বিষয়ে কোনো স্থির ও স্থায়ী সিদ্ধান্তে তারা আসতে পারেননি। এ কারণে সংবিধানের খসড়া কমিটির সভাপতি ড. বি. আর আম্বেদকার গণ পরিষদে বলেছিলেন যে, ভারতের নাগরিকত্বের ব্যাপারে তারা কোনো স্থায়ী ও সম্পূর্ণ বিধিবিধান তৈরি করতে যাচ্ছেন না। গণপরিষদের উদ্দেশ্য হলো সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার প্রাক্কালে কারা ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবেন তা নির্ধারণ করা, নাগরিকতা সম্পর্কে স্থায়ী নিয়মকানুন প্রণয়নের সামগ্রিক ক্ষমতার অধিকারী হবে ভারতের সংসদ। সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পর নাগরিকতা অর্জন ও বিলোপের ব্যাপারে নিয়মকানুন ও পন্থা পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য ভারতীয় সংসদ ১৯৫৫ সালে ভারতীয় নাগরিকতা আইন, ১৯৫৫ (Indian Citizenship Act, 1955) প্রণয়ন করে। ভারতের সংবিধান বিশ্বের বৃহত্তম লিখিত সংবিধান হলেও নাগরিকতা সম্পর্কে কোনো বিশদ আলোচনা এখানে নেই। ভারতীয় সংবিধানের ১১ নম্বর ধারা অনুযায়ী এ বিষয়ে সমস্ত ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতাবলে ভারতীয় সংসদ Indian Citizenship Act, 1955 পাশ করে এবং বার বার এই আইনটি সংশোধিত হয়েছে। এর আগে ১৯৫৭, ১৯৬০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫ এবং ২০১৫ সালে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সংশোধিত হয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর লোকসভায় এবং ১১ই ডিসেম্বর রাজ্যসভায় পাশ হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। ১২ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বিলটিতে সম্মতি দেওয়ায় তা আইনে পরিণত হয়। এবং এটি ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী হিসাবে সেই আইনের অঙ্গীভূত হয়েছে। সুতরাং সংবিধানের ১১ নম্বর ধারা অনুযায়ী নাগরিকতার বিধিনিয়ম প্রণয়নের যে ক্ষমতা ভারতীয় সংসদের আছে সংসদ সেই ক্ষমতাই প্রয়োগ করেছে।
ভারতীয় নাগরিকতা বিষয়ক সাংবিধানিক সংস্থানগুলি ভারতীয় সংবিধানের ৫ থেকে ১১ ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সংবিধান চালুর সময় অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সারা ভারতের স্থায়ী বাসিন্দারা সকলে ভারতের নাগরিক হবেন যদি তঁারা ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, বা তাদের মাতা-পিতার কেউ একজন ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন। সংবিধানের ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত আগে। যারা অন্তত পাঁচ বছর ধরে ভারতে বসবাস করে আসছেন তারা যদি স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তবে তারা ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবেন। সংবিধানের ৬, ৭, ৮, ৯, ১০ ধারাগুলিতেও স্বাধীনতা ও দেশত্যাগের প্রেক্ষাপটে সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার সময় কারা ভারতের নাগরিক হতে পারেন তার উল্লেখ আছে।
কিন্তু ভারতের সংবিধান প্রণেতারা এটা বুঝেছিলেন যে ভবিষ্যতে নাগরিকতার বিষয়টি বার বার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে এবং ভারতীয় সংসদকে এ নিয়ে চিন্তা করতে হতে পারে। তাই সংবিধানের ১১ নম্বর ধারায় সংসদের হাতে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এই ক্ষমতাবলে ভারতীয় পার্লামেন্ট ১৯৫৫ সালে যে ভারতীয় নাগরিকতা আইন প্রণয়ন করেছে পরিস্থিতিরি প্রয়োজনে তাকে বার বার সংশোধন করতে হয়েছে। ২০১৯ সালে যে নাগরিকতা আইন, ১৯৫৫ সংশোধিত হলো তাকে এই প্রেক্ষাপটেই বিচার করা প্রয়োজন। ২০১৯-এ সংশোধিত আইন অনুযায়ী ২০১৪-এর ৩১ ডিসেম্বর বা তার আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এই তিনটি ইসলামিক দেশ থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান বা পার্সি ধর্মের মানুষজন ভারতীয় নাগরিকতার সুযোগ পাবেন। রাজ্যসভায় বিলটি পাশের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে ‘সমবেদনা ও সৌভ্রাতৃত্বের যে সংস্কৃতি আমাদের রয়েছে এই বিলটি তার মাইলফলক। মূলত ধর্মীয় বা সংশ্লিষ্ট কারণে এই দেশগুলিতে নিপীড়িত সংখ্যালঘু মানুষ এই সংশোধনীর ফলে এদেশে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবেন। এর আগেও ভারতীয় সংসদে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে যে সংশোধনী এনেছে তাতে নাগরিকতা প্রদানের ক্ষেত্রটিকে বাড়ানো হয়েছে। ২০১৯-এর সংশোধনী সেই ক্ষেত্রটিকেই আর একটু বৃদ্ধি করেছে। অনেক সময় বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করতে ভারত সরকার ১৯৫৫ সালের আইন সংশোধন করে। ১৯৬৪ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী ভারত প্রায় ৫,২৫,০০০ তামিলভাষী মানুষকে এদেশে ফিরিয়ে এনে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে বিদেশ থেকে আসা মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদানের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে।
এই সংশোধনী নিয়ে একটি প্রশ্ন বারবার উঠেছে। এই সংশোধনী কি সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় সন্নিবিষ্ট সাম্যের অধিকারের বিরোধী ? এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যে মামলা দায়ের হয়েছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হলেন সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দু’একটি উক্তি করা যায়। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার মূল বিষয় হলো ‘আইনের দৃষ্টিতে সাম্য। এই আইন কেবল ভারতের নাগরিকদের জন্য, অন্যদেশের নাগরিকের জন্য নয়। আইভর জেনিংস-এর মতে ‘সমপর্যায়ভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য আইন হবে একই প্রকার এবং একইভাবে প্রযুক্ত হবে।’ চিরঞ্জিত পাল চৌধুরী বনাম ভারত সরকার (১৯৫১), সতীশচন্দ্র বনাম ভারত সরকার (১৯৫৩) মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, একই পরিস্থিতি বা অবস্থায় অবস্থিত সকল ব্যক্তি সমভাবে আইনের দ্বারা সংরক্ষিত হবে। ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-তে সংশোধন করতে গিয়ে ২০১৯ এবং সংশোধনী আইন যে তিনটি দেশের উল্লেখ করেছে সেই পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ ঘোষিতভাবেই মুসলমান দেশ।ইসলাম এদের রাষ্ট্রধর্ম। সেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের সঙ্গে অ-মুসলমানদের একই সুযোগ সুবিধা আছে তা কি বলা যায় ? এই দেশগুলিতে বিগত ৭০ বছরে অ-মুসলমানদের সংখ্যা এভাবে হ্রাস পেয়েছে কেন? ধর্মীয় কারণে জীবন, জীবিকা, কিংবা নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হওয়ার অভিযোগ (বিশেষত পাকিস্তানে) বার বার ওঠে কেন? ভারতীয় সংবিধানে পৃথকীকরণের সংস্থান আছে। তবে তাকে যুক্তিসংগত হতে হবে। ২০১৯-এর সংশোধনীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান কিংবা পার্সি ছাড়া অন্য কাউকে ২০১৪-এর ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিবর্ষ ধরে নাগরিকতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই পৃথকীকরণ কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয়, বরং অনেক বেশি যুক্তিসংগত। অন্তত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে।
বিমল শঙ্কর নন্দ
2019-12-27