দেখতে দেখতে মাস পেরিয়ে গিয়ে বছর শেষের দিকে এগোতে শুরু করেছে। আর সেই মুহূর্তেই লোকসভার পর রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে গেল ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী বিল। ভোটাভুটিতে ১২৫টি ভোট পড়েছে বিলের পক্ষে এবং বিপক্ষে পড়েছে। ১০৫টি ভোট। এর পর কেন্দ্রীয় সরকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় রুলস ও প্রক্রিয়া তৈরি করবে এবং গ্যাজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তা প্রকাশ হওয়ার পর সমগ্র দেশের লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুরা এই আইনের সুফল পাবেন। এই রুলস বা প্রক্রিয়া তৈরির ক্ষমতা ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে কেন্দ্রের সরকারের উপর ন্যস্ত রয়েছে।
সংশোধনী বিলটি সংসদের উচ্চকক্ষে পাশ হওয়ার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী দিনটিকে ‘যুগান্তকারী’বলে আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী দিনটিকে ভারতীয় সংবিধানের কলঙ্কিত দিন বলেছেন। সঙ্গে সুপ্রিমকোর্টে যাওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তাই এখন দেখে নেওয়া যাক। আইনটি কতটা সংবিধানসম্মত। দেশ শাসন করার জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করে সেই দেশের সংবিধান। সাধারণত জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক কোনও সংস্থা একটি সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করে। ভারতের সংবিধান বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য এই ধরনের নির্বাচিত সংস্থাকে গণপরিষদ বলা হয়। ভারতের সংবিধান হচ্ছে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হওয়ার পর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান কার্যকরী হয় দেশে। গণপরিষদে সংবিধান গ্রহণ করেই নাগরিকত্ব নিয়ে ৫ থেকে ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বলবৎ করা হয়। তার আগে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সেসময় ইংরেজ শাসিত ভারতে যারা বাস করতেন তাদের ব্রিটিশ প্রজা মনে করা হতো এবং ব্রিটিশ আইন মোতাবেক তাদের শাসন করা হতো। আমরা সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ থেকে ১১ নম্বর। অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকত্বের কথা পাই। আমরা যদি সংবিধানের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তখন দেখতে পাওয়া যাবে এই অনুচ্ছেদটি খসড়া সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে অর্থাৎ মৌলিক অধিকারের সঙ্গেই ছিল। সর্বমোট ৩৮ দিন গণপরিষদে মৌলিক অধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংবিধান প্রণেতা ড. আম্বেদকর এই অংশকেই সবচেয়ে সমালোচিত অংশ’বলেছিলেন। ১৯৪৭ সালে ২৯ এপ্রিল যখন গণ পরিষদে মৌলিক অধিকারের উপর অগ্রিম রিপোর্ট পেশ করা হয়। তখন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল স্পষ্ট বলেছিলেন : It is important to remember that the provision about Citizenship will be scrutinized all over the World. They are watching what we are doing. পরে গণপরিষদের সভায় সেটা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অধ্যায় থেকে সরিয়ে সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থান দেওয়া হয়। অর্থাৎ নাগরিকত্ব আমাদের কারোর মৌলিক অধিকার নয়। নাগরিকত্বের অধিকারটি একটি বিশেষ সুবিধার (Special Privilege) পর্যায়ে পড়ে। মনে হয় নাগরিকত্বের ব্যাপারটি নিয়ে গণপরিষদে এতই আলোচনা বা বিতর্ক হয়েছিল সেজন্য তার কোনো ইতি টানতে না পেরেই সংসদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় আইন তৈরির জন্য। তাই গণপরিষদের ১৯৪৯ সালের ১০ আগস্টের বিতর্ক সভায় সংবিধান সভার চেয়ারম্যান বি. আর. আম্বেদকর বলেছিলেন— …it is not possible to cover every kind of case for a limited purpose, namely, the purpose of conferring citizenship on the date of com mencement of the Constitution. If there is any category of people who are left out by the provisions contained in this amendment, we have given power to Parliament subsequently to make provision for them.” সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে দেশের সংসদকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে দেশের নাগরিকত্ব লাভ ও নাগরিকত্বের অবসান নিয়ে প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করার জন্য। ওই অনুচ্ছেদের শিরোনাম হলো :“Parliament to regulate the right of citizenship by law”, আর সেই ক্ষমতা অনুসারেই সংসদে ১৯৫৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরে পাশ হয়। নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫। এছাড়া সংবিধানের ২৪৬ (১) নম্বর অনুচ্ছেদেও স্পষ্ট বলা হয়েছে :
“…Parliament has exclusive power to make laws with respect to any of the matters enumerated in List I in the Seventh Schedule.”
এই সপ্তম তফশিলে মোট ৯৭টি আইটেম রয়েছে আর তার মধ্যে ১৭ নম্বর আইটেমে রয়েছে নাগরিকত্ব, দেশীয়করণ ও বিদেশি সংক্রান্ত বিষয়। এক কথায় বলা যায় নাগরিকত্ব বিষয়টি সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত এবং সংসদের সম্পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে এই বিষয়ে যথাযথ আইন প্রণয়নের। রাজ্যসভায় আলোচনার সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের তাবড় তাবড় আইনজীবীরা প্রশ্ন তোলেন মুসলমানদের এই বিলে কেন রাখা হয়নি। অমুসলমানদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য বিলে যে ধর্মীয় শ্রেণীবিভাজন করা হয়েছে তা আইনসঙ্গত নয়। এদের স্লোগান হচ্ছে-‘ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব বিল মানব না। এদের এক প্রকার মুখপাত্র হয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ এবং বুদ্ধিজীবীরা বলছেন এই বিল সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা করেছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উত্তরে সংসদে জানিয়েছেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এই তিনটিই ইসলামিক দেশ। তাই সেখানে মুসলমানদের সঙ্গে ধর্মীয় নির্যাতনের সম্ভাবনা কম। ফলে এই সংশোধনী বিলে তাদের কথা রাখা হয়নি। তবে কোনও মুসলমানের সঙ্গে অবিচার হলে, তাকেও ভিসা দেওয়া হয়েছে (উদাহরণ তসলিমা নাসরিন আদনান সামি প্রমুখ)। সঙ্গে তিনি একথাও জানান গোটা পৃথিবী থেকে যদি মুসলমানরা এসে এদেশের নাগরিকত্ব চান, তাহলে তা দেওয়া সম্ভব নয়। এভাবে দেশ চলতে পারে না।তার জন্য আইন তৈরি হয়েছে।
সকলের জানা সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে সাম্যের অধিকার (Right to Equality) এবং ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে ধর্ম, জন্মস্থান, ভাষা, বর্ণ, লিঙ্গ ও জাতির ভিত্তিতে বৈষম্য করা যাবে না (Prohibition of discrimination on grounds of re ligion, race, caste, sex or place of birth)। উল্লেখ্য, সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রে। ওই অনুচ্ছেদের বলে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি, শিখ এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোক দেশীয়করণের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অতএব, ১৫ নম্বর অনুচেছদ যতদিন পর্যন্ত ওইসব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন ততদিন পর্যন্ত প্রযোজ্য বা লঙ্ঘন হবে না।
এখন সংবিধানের ১৪নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করে নেওয়া যাক। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : The State shall not deny to any person equality before law or the equal protection of the law within the territory of India’. এই অনুচ্ছেদ ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকা নাগরিকের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি সমান প্রযোজ্য ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকা প্রতিটি মানুষের ওপর অর্থাৎ দেশি-বিদেশি সবার ক্ষেত্রে। ওই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আইনের দৃষ্টিতে সমতা (equality before law) এবং ‘সবাই আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত’(eaual protection of the law)—এই দুটি ধারণার অনুপ্রেরণা আমাদের সংবিধান প্রণেতারা লাভ করেছিলেন আয়ারল্যান্ড ও আমেরিকার সংবিধান থেকে। দুর্গা দাশ বসুর লেখা সংবিধানের বইয়ে equal protection বলতে গিয়ে বলা হয়েছে : ‘all individuals and classes will be equally subjected to the ordinary law of the land administered by the law courts’। কিন্তু ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটি একটি বিশেষ আইন।
আর সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যে বেশ কিছু মামলার রায় প্রদান করেছে। তার মধ্যে। উল্লেখযোগ্য রায়টি ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯৫২ সালের ১১ জানুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বনাম আনোয়ার আলি সরকার। মামলায়। বলা বাহুল্য ওই রায়টি আজও বহাল রয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের তৎকালীন মুখ্যবিচারপতি এম. পতাঞ্জলি শাস্ত্রীর নেতৃত্বে সাত বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ ওই রায় প্রদান করে। ওই রায় অনুসারে ন্যায়সঙ্গত শ্রেণীকরণ করা যায়। পিছনে থাকতে হবে ন্যায়সঙ্গত কারণ। অবশ্য শ্রেণীভিত্তিক আইন তৈরি করা যাবে না। ওই রায়ে মুখ্যবিচারপতি স্পষ্ট বলেছেন : ‘– Article 14 of the Constitution does not mean that all laws must be general in character and universal in application. The State must possess the power of distinguishing and classifying persons or things to be subjected to particular laws and in making a classification the legislation.’ ওই মামলায় সুপ্রিমকোর্ট আরও বলেছে যে, Just cause for discrimination is permissible on the basis of a real and substantial distinction relating to the objects sought to be achieved. ২০০৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কারাগারে বন্দি এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করে অভিযোগ করেছিলেন, কারাগারে বন্দিদের দুটি ভাগে ভাগ করা একটি বৈষম্যমূলক আচরণ। অর্থাৎ তখন অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য সরকার মহিলাদের বিরুদ্ধে করা অপরাধের বন্দি এবং অন্যান্য অপরাধের বন্দিদের মধ্যে বিভাজন করেছিল। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট বলেছিল, this is reasonable classification to achieve some objective.’ এছাড়াও সেদিন রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদ ভূপেন্দ্র যাদবের মুখে উচ্চারিত হয়েছে ১৯৫৫ সালের হ্যানস মুলার মামলার কথা। এইটুকু আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে প্রকৃত বা উপযুক্ত বাস্তবসম্মত পার্থক্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য আইনে বৈষম্য বা শ্রেণীবিভাজন করা যায়।
সবশেষে বলা যায়, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে যে ধর্মীয় বিভাজন রয়েছে সেটা আইনসঙ্গত এবং যুক্তিসঙ্গত। সেই সঙ্গে রয়েছে মানবিকতা এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতি। এটা কোনোভাবেই সংবিধান বিরোধীনয়।নাগরিকত্ব লাভ কীভাবে সহজ থেকে সহজতর হবে তা কেন্দ্রীয় সরকারের রুলস ও প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করবে। অন্যদিকে খেয়াল রাখতে হবে অসমের এন আর সি নবায়নের মামলা এখনো সুপ্রিমকোর্টের বিচারাধীন। সামনেই ইংরেজির নতুন বছর ২০২০। নতুন বছর মানেই নতুন কিছু আশা, নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা। নতুন কিছু পাওয়ার আশায় প্রত্যেকের পথচলা শুরু হয়। তাই সমগ্র ভারতের উদ্বাস্তুদের পথ চলা ইংরেজির নতুন বছরে শুরু হোক পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় নাগরিক হিসেবে।
উর্মীশ্রী দেব
2019-12-26