সাংবাদিকতার সূত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাবলী খুব কাছ থেকে ক’দিন ধরে জানার এবং দেখার সুযোগ পেয়েছি। যা হল সেখানে আমার মতে রীতিমত অসভ্যতামি। গণতন্ত্রের এবং শিক্ষাব্যবস্থার একটা কালো দিক।
প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে সাংবাদিকতা করছি। যাদবপুরের মত নেতিবাচক দৃষ্টান্ত খুব একটায়চোখে পড়েনি। যাদবপুরে কয়েক বছর আগে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাম পড়ুয়ারা। সেগুলিও কভার করেছি। আমি দ্ব্যর্থকন্ঠে ওঁদের সমর্থন করেছিলাম। এখন মনে হয়, হয়ত কিছুটা ভুল করেছি। ছাত্র বলে যা খুশি করবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। পড়াশোনা করতে এসেছিস, করে চলে যা! সব কিছুর দাম বাড়ছে! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফিজ বাড়বে না? আমার ছেলেমেয়েও তো এই সেদিনও পড়ুয়া ছিল! তখনও মনে হয়নি আন্দোলন করে ফিজবৃদ্ধি ঠেকানো উচিত। এই পড়ুয়ারা বা তাঁদের অভিভাবকরা কিন্তু বিভিন্ন শখ পূরণের জন্য অনেক খরচ করেন। যত আপত্তি ফিজ বাড়লে?
প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। সিসিটিভি বসানোর সিদ্ধান্ত হল। বাধ সাধল কারা? বাম ছাত্র সংগঠন। কোন অধিকারে? কর্তৃপক্ষ মেনে নিতে বাধ্য হলেন। গতকালও যাদবপুরে অনেকক্ষণ ছিলাম। মিনিট দুই দাঁড়িয়েছিলাম গোপাল সেনের শ্বেত পাথরের স্মৃতিসৌধের সামনে। ছাত্রদরদী এবং শৃঙ্খলপরায়ণ ওই অধ্যাপককে খুন হতে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্ববে। মূল অভিযুক্ত বিত্তবান পরিবারের বাম সমর্থক। বিদেশে পালিয়ে সে যাত্রায় বেঁচে যান।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় যেদিন যাদবপুরে গিয়ে বাম পড়ুয়াদের মধ্যে আটকে পড়েন, সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যপাল ছুটে যান তাঁকে উদ্ধার করতে
কোন রাজনৈতিক দল ঠিক বা বেঠিক, সেই তর্কে ঢুকব না। যাদবপুরের ঘটনাবলী নিয়ে নিয়ে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর সম্প্রতি যে কটি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন, প্রতিটি শুনেছি। উপাচার্য এবং শিক্ষামন্ত্রীর পাল্টা বক্তব্যও শুনেছি। শেষোক্ত মন্তব্যগুলো আমার কাছে ভিত্তিহীন বলে মনে হয়েছে।
রাজ্যপাল সোমবার কোর্ট বৈঠকে অংশ নিতে গিয়ে কীভাবে চরম অপমানিত হয়েছেন, দেখে খারাপ লেগেছে। এর পরেও উপাচার্যের আমন্ত্রণে পরদিন গিয়েছেন প্রতিষ্ঠানে। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেখুন! এর প্রতিটিতে পৌরোহিত্য করার কথা আচার্যের। কিন্তু উপাচার্য তা করেননি। আচার্য-রাজ্যপাল এ ব্যাপারে ‘দূর নিয়ন্ত্রণ’-এর অভিযোগ করেছেন। মঙ্গলবার রাজ্যপালকে আটকানোয় সক্রিয় ভূমিকা নেয় তৃণমূল-সমর্থিত শিক্ষাবন্ধু সমিতি।
অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ হিসাবে রাজ্যপাল ধনকরের প্রতিষ্ঠা এবং পরিচিতি সর্বজনবিদিত। তাঁকে (আমার সামনে) বাধ্য করার চেষ্টা হয়েছিল সিএএ এবং এনআরসি-র জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে। ওনার জবাব ছিল, “একটা দেশের আইন তো সবাই মানতে বাধ্য! সেটাই তো সভ্যতা!“ ‘আজাদি’, ‘আজাদি’ ক্রমাগত শ্লোগান বাম পড়ুয়ারা দিয়েছিলেন রাজ্যপালকে। কিসের আজাদি? এত ঔদ্ধত্য কিসের? আমার দেখে মনে হয়েছে ‘গায়ের জোরে যা খুশি করব’ মনোভাব।
যা হল, কার কতটা স্বার্থসিদ্ধি হল সবাই জানেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের এবং সার্বিকভাবে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা কালিমালিপ্ত হল। এমন নয় রাজনীতির বাহুবলীরা এই প্রথম এ রকম করছে! মনে পড়ে যাচ্ছে বাম আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তোষ ভট্টাচার্যের ঘটনাবলী।
সব শেষে আবার বলি, এই লেখার মাধ্যমে কেউ অনুগ্রহ করে তৃণমূল বিরোধী বা বিজেপি-র সমর্থক বলে ঠাওরাবার চেষ্টা করবেন না। যে যাই বলুন আমি অন্তর থেকে মনে করি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত দক্ষ, অভিজ্ঞ, রাজনীতি-সচেতন নেত্রী। তাঁকে সরিয়ে এ রাজ্যে আসার নেতৃত্ব দেওয়ার মত মত তাঁর ত্রিসীমানায় কেউ নেই। কিন্তু যাদবপুর নিয়ে যা হল, তা খুব দুঃখের এবং লজ্জার।
অশোক সেনগুপ্ত