‘কালীঘাটের মাটি’ ফোঁপরা হয়ে বিপদের মুখে নবান্নও, কলকাতা-হাওড়ায় বহুতল হেলে পড়ছে সেই কারণেই

বিপন্ন ‘কালীঘাটের মাটি’। তলায় তলায় এতই ভঙ্গুর কলকাতা যে, ক্রমশ চাপ বাড়ছে ‘কালীঘাট ফর্মেশনে’। একের পর এক বহুতল হেলে পড়েছে সেই কারণেই। ভূবিজ্ঞানীদের এক গবেষণাপত্রে তেমনই দাবি করা হচ্ছে। বাঘাযতীন- কাণ্ডের পর থেকে শহরের বহুতলগুলির পরিস্থিতি নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। কিন্তু শহরে কর্মরত ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা বছর ছয়েক আগেই বিপদটা টের পেয়েছিলেন। তাঁদের গবেষণা বলছে, বিপদের মুখে রয়েছে নবান্নও।

কলকাতা এবং লাগোয়া জেলাগুলিতে মাটির উপরের স্তর নির্মাণকাজের জন্য ভাল বলে ভূবিজ্ঞানী এবং নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের মত। তা হলে একের পর এক উঁচু বাড়ি হেলে গিয়েছে কেন? ভূবিজ্ঞানী সুজীব কর বলছেন, ‘‘মাটির উপরের স্তর ভাল হলেও ঠিক তার নীচের স্তরেই বিপদ। ভূবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে কালীঘাট ফর্মেশন বলা হয়, সেই মাটি আঠালো এবং থকথকে। কিন্তু ঠিক তার নীচেই ভঙ্গুর, ঝুরঝুরে উপাদান রয়েছে। সেখানে নানা কারণে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। তার প্রভাব উপরের স্তরে পড়ছে।’’

‘কালীঘাট ফর্মেশন’ কী?

ভূবিজ্ঞানী সুজীবের কথায়, ‘‘হাজার দেড়েক বছর আগে কালীঘাট অঞ্চল ছিল এক দ্বীপ। সেই দ্বীপকে কেন্দ্র করে পলি জমার একটা প্রক্রিয়া আবর্তিত হয়েছিল। সেই প্রক্রিয়াই ছড়াতে ছড়াতে কলকাতার অন্যান্য অংশ এবং হাওড়া, হুগলি ও দুই ২৪ পরগনার মাটির উপরের স্তর তৈরি করেছে।’’ কালীঘাটকে কেন্দ্র করে মাটির এই স্তর তৈরি হওয়া শুরু, তাই ভূবিজ্ঞানীরা একে ‘কালীঘাট ফর্মেশন’ বলেন।

কালীঘাট ফর্মেশনের নীচের ভঙ্গুর স্তরের অবস্থা নানা কারণে মাঝেমধ্যেই বদলে যাচ্ছে বলে গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে। কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর ক্রমশ নীচে নামতে থাকায় এই সমস্যা বাড়ছে বলেও দাবি করা হয়েছে সেখানে। সুজীবের কথায়, ‘‘কলকাতায় প্রতিদিন মাটির তলা থেকে যে পরিমাণ জল টেনে তোলা হচ্ছে, তার তুলনায় ভূগর্ভে জল ফিরে যাওয়ার পরিমাণ নগণ্য। কারণ, অজস্র জলাশয়-পুকুর ভরাট করে বাড়ি উঠে গিয়েছে। ফলে জলস্তর ক্রমশ নামছে। মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে। কালীঘাট ফর্মেশনের নীচের স্তর আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।’’

শুষ্ক ভূগর্ভ নিজে থেকে জল টেনে নেওয়ার যে চেষ্টা করছে, তাতেও বিপদ ঘনাচ্ছে বলে ভূবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তরে যে হেতু ডায়রেক্ট রিচার্জ (মাটির উপর থেকে সরাসরি ভূগর্ভস্থ জলস্তরে জল পৌঁছনো) খুব কম, তাই শহরের শুষ্ক ভূগর্ভ আশপাশের অপেক্ষাকৃত আর্দ্র অঞ্চল থেকে জল টানতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় জল টেনে আনার সময়ে মাটির নীচে কোনাকুনি জলপ্রবাহের চ্যানেল তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ডায়রেক্ট রিচার্জ হলে জল উল্লম্ব ভাবে উপর থেকে নীচে নামে। এতে ভূস্তরের কোনও ক্ষতি হয় না। কিন্তু মাটির তলা দিয়ে যে সব কোনাকুনি চ্যানেল তৈরি হচ্ছে, সেগুলি দিয়ে জল প্রবাহিত হওয়ায় ভূগর্ভে অনেক ফাঁপা জায়গা তৈরি হচ্ছে।’’ গবেষণাপত্রটিতে দাবি করা হয়েছে, কলকাতার মাটির তলায় তৈরি হওয়া ওই সব চ্যানেল দিয়ে পলি সরে গিয়ে গঙ্গা এবং বাগজোলা খালে জমা হচ্ছে। সুজীবের কথায়, ‘‘২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গঙ্গায় পলির স্তর বৃদ্ধির পরিমাণ মেপে দেখা গিয়েছে, স্বাভাবিক মাত্রার প্রায় পাঁচ গুণ পলি জমা হয়েছে গঙ্গাবক্ষে। কলকাতা এবং হাওড়ার মাটির তলা থেকে ক্রমশ বেরিয়ে যেতে থাকা পলি গঙ্গাবক্ষে গিয়ে জমা হয়েছে।’’

কোন কোন এলাকা সবচেয়ে বিপন্ন?

গঙ্গার দু’পারে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত এলাকা সবচেয়ে বিপন্ন বলে ভূবিজ্ঞানীদের অভিমত। কলকাতার ৪০ শতাংশ এবং হাওড়ার ৩৫ শতাংশ এলাকাই এই অংশের মধ্যে পড়ছে। বাবুঘাট থেকে শুরু করে বড়বাজার, শোভাবাজার, কাশীপুর, দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত এলাকায় মাটির নীচে বিপদ দ্রুত বাড়ছে বলে গবেষণায় প্রকাশ। মাত্রা কিছুটা কম হলেও গার্ডেনরিচ, মানিকতলা, বিধাননগর এলাকাতেও বিপদ রয়েছে। একই মাত্রায় বিপদ গঙ্গার পশ্চিম কূলে নবান্ন ও কোনা এক্সপ্রেসওয়ে সংলগ্ন এলাকা এবং ডোমজুড়ের দিকে।

নির্মাণ বিশেষজ্ঞ তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাসও মানছেন যে, ভূগর্ভস্থ জলস্তর ক্রমশ নেমে যাওয়া বড় সমস্যা। পার্থের কথায়, ‘‘মাটির একটা নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা রয়েছে। খুব সহজসরল ভাষায় বলতে গেলে, নির্দিষ্ট এলাকা কতটা চাপ নিতে পারবে, সেটাই তার ধারণক্ষমতা। শুধু মাটির চরিত্র পরীক্ষা করে বহুতল তুললেই হবে না। কলকাতা শহর সর্বোচ্চ কতগুলো বহুতল ধারণ করতে পারবে, তারও হিসেব থাকতে হবে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বহুতল মানে শুধু তার ওজন নয়। সেই বহুতলে কত মানুষ থাকবেন, কত জন কাজ করবেন, কতটা জল লাগবে, কত জল মাটির তলা থেকে তুলে ফেলা হবে— এই সব কিছুর হিসেব থাকাও জরুরি।’’ কিন্তু সে ভাবে হিসেব করে শহরে বহুতলের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া সম্ভব? পার্থের দাবি, ‘‘অবশ্যই সম্ভব। অনেক উন্নত শহরেই তেমন হচ্ছে। শহরের কোনও অঞ্চলকে শুধু অফিস-কাছারির জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কোনও অঞ্চলে শুধু বাসস্থান।’’

আর এক ভূবিজ্ঞানী তথা সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ পৃথ্বীশকুমার রায় অবশ্য বলছেন, ‘‘অত কঠিন কিছু করার দরকার নেই। খুব সহজ একটা পদ্ধতি রয়েছে। মূল সমস্যা মাটির তলায় জল কমে আসা। সুতরাং ডায়রেক্ট রিচার্জ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’’ সেটা কী ভাবে সম্ভব, তা-ও জানিয়েছেন পৃথ্বীশ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমত, প্রতিটা বহুতলকে বাধ্য করতে হবে ব্যবহৃত জল নর্দমায় না পাঠিয়ে মাটির তলায় পাঠাতে। বহুতল চত্বরে ছোট ছোট কূপ তৈরি করে তার মধ্যে জল ফেলার ব্যবস্থা করলে সেটা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, শহরের মাটি থেকে কংক্রিটের আচ্ছাদন কমাতে হবে। কংক্রিটের চাদরবিহীন খোলা জায়গা রাখতে হবে। যাতে জল মাটিতে সরাসরি ঢুকতে পারে। তা হলেই কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর আবার বাড়িয়ে তোলা সম্ভব।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.