তৎকালীন বাংলার বিরোধী দলনেত্রী এবং তাঁর দলের একমাত্র সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “বাংলাদেশ থেকে বাংলায় অনুপ্রবেশ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এটি এখন পশ্চিমবঙ্গের কাছে এক অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে”। তিনি এটিও তখন বলেছিলেন যে, ভোটার তালিকায় অনেক বাংলাদেশি নাগরিকের নামও রয়েছে।
ওই সময় লোকসভায় তিনি এই ব্যাপারটিকে ‘অত্যন্ত গুরুতর’ বলে বিতর্ক করতে চাইলে, তৎকালীন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে থামিয়ে দেন। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পক্ষপাতিত্ব করছেন বলে তারপর অভিযোগ করেছিলেন মমতা। শুধু তাই নয়। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সহকারী, প্রিসাইডিং অফিসার, চরঞ্জিৎ সিংহ অটওয়ালকে লক্ষ্য করে তাঁর হাতে থাকা একগাদা কাগজ ছুঁড়ে মেরে গোটা সংসদ কক্ষকে স্তম্ভিত করে নিজের পদত্যাগপত্র দিয়ে আসন ছেড়ে বেরিয়ে যান।
যদিও, সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি লোকসভার অধ্যক্ষ। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পরে বলেছিলেন, পদত্যাগপত্রটি যথাযথভাবে পেশ না করার কারণে গ্রহণ করা হয়নি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) (সিপিআইএম) এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (সিএবি) বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা করছে। তবে এমন এক সময় ছিল যখন তাদের কণ্ঠস্বর বাংলাদেশি হিন্দুদের নাগরিকত্বের অধিকারের পক্ষে ছিল। এটি কোনও সুপ্রাচীন অতীতের ঘটনা নয়। ২০১২ সালে সিপিআইএম নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করার দাবি করেছিল, যাতে বাঙ্গালী হিন্দুরা ভারতে মর্যাদাবান জীবনযাপন করতে পারে।
২০১২ সালের এপ্রিলে সিপিআই (এম)-এর বিংশ কংগ্রেসে গৃহীত একটি প্রস্তাবনায় উক্ত দলটি দাবি করেছিল যে, “বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের ক্ষেত্রে উক্ত নাগরিকত্ব আইনের ধারা ২(১)(খ)-এর উপযুক্ত সংশোধন করা উচিত। অসম চুক্তিটি সুরক্ষার সময় এটি করা উচিত যা আসামের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে প্রাসঙ্গিক। কেন্দ্রীয় সরকার সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনে এ জাতীয় সংশোধনী আনার দাবি জানিয়েছে।”
২০০৩-এ সংসদীয় আলোচনায় সিপিআইএম বলেছিল “দেশ জুড়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলের ঐতিহাসিকভাবে পরিস্থিতির শিকার এই নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সংশোধনী বিলকে সমর্থন করা উচিত।” তারা দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিল যে “এত বছর পরেও আইন তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে বিবেচনা করে। তাদের ক্ষেত্রে অপরাধীদের মতো আচরণ করা হয়েছে।”
সেখানে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে তারা সংসদে সমর্থনের পক্ষে সওয়াল করে।
সিপিআই(এম) দ্বারা প্রেরিত এই আলোচনায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বলেছিলেন, “আমাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা যদি পরিস্থিতি মানুষকে বাধ্য করে, এই হতভাগা মানুষ , আমাদের দেশে আশ্রয় নিতে, এই দুর্ভাগ্য ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও উদার হতে হবে।”
তারপর অনেক জল বয়ে গেছে। এখন কেবল বিরোধিতা করবার জন্যই বিরোধিতা করে মনমোহন সিংয়ের দল ইসলামিক দেশের এথনিক ক্লিনজিংকে সমর্থন করে। তার সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে বাঙ্গালী হিন্দু খেদানোকে সমর্থন করে। একইভাবে, সিপিআই(এম) এর নেতা সীতারাম ইয়েচুরি সিএবিকে “জিন্নাহ এবং সাভারকারের স্বপ্নের বিল” বলে অভিহিত করেন।
সেখানে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “আমরা জিন্নাহ এবং সাভারকারের স্বপ্নের এই বিলটিকে প্রত্যাখ্যান করি। এটি অসাংবিধানিক, এবং আমাদের জনগণকে বিভক্ত করে। আমরা সম্ভাব্য সকল ফোরামে এর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব।”
একইরকম ভাবে কেরালার কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এটিকে ধর্মীয় ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করার একটি কূটকৌশলপূর্ণ পরিকল্পনা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “ভারতের সংবিধান সমস্ত ভারতীয়দের নাগরিকত্বের অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়; তাদের ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, লিঙ্গ বা পেশা নির্বিশেষে এই অধিকারটি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল দ্বারা বাতিল করা হচ্ছে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণের পদক্ষেপ সংবিধানের প্রত্যাখ্যানের সমান। জনগণকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত করার এটি একটি মহড়া।”
তাহলে বিরোধিতা কেন? কেবল ভোট ব্যাংকের স্বার্থই কি বিরোধিতার কারণ? মাননীয়ার সেই সংসদে বিশেষ বিরোধিতার দিন মনে আছে নাগরিকত্ব বিলের জন্য? ক্যাব নিয়ে বামপন্থী ধান্দাজীবীরা বলছে ভারতের অন্তরাত্মাকে নাকি হত্যা করা হয়েছে! বলি কমরেড ২০১২ সালে (এপ্রিল ০৪-০৯) কোঝিকোডে, বিংশ কংগ্রেসে যে রেজল্যুশন নিয়েছিলেন, সেটা কি মনে পড়ে?
“Party congress demands a suitable amendment in clause 2(i)(b) of citizenship amendment act- 2003 in relation to Bangladesh minority community refugees”
তবে আজ বিরোধিতা কেন? সেদিন ও মনের থেকে নয়, শুধু ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থে ধান্দাবাজির জন্য ঐ রেজল্যুশন নিয়েছিলেন এবং উপাধ্যক্ষকে চিঠিও লিখেছিলেন আর আজও ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থেই পালটি খেয়েছেন। শুধু মানুষকে ভুল বোঝানো, মুখে পৃথিবী উদ্ধার করার ভণ্ডামি আর মেকি শ্রেণী শত্রুতার নাম করে হত্যালীলা চালানো–এর বাইরে আর কিছু কি ভাবতে জানেন?
কংগ্রেসের এই সদস্য এবং তাদের সঙ্গীরা হৈ হল্লা করে ঝড় তুলেছে। তাদের কথা কেউ না মানলে সব জায়গায় আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই যে আগুন লাগার দৃশ্য টিভির পর্দায় দেখানো হচ্ছে সেখানে আগুন কারা লাগাচ্ছে তা তাদের পোশাক থেকেই প্রমাণিত। কংগ্রেসের লোক এবং তাদের সঙ্গীরা যাঁরা আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করছেন, যা ঘটছে তাতে তাঁদের মৌন সমর্থন রয়েছে। আজ যে অন্যায় ঘটছে তার থেকে আপনারা যদি চোখ বন্ধ করে মুখ ঘুরিয়ে রাখেন, দেশ তা দেখছে এবং দেশের মানুষের ধারণা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। দেশের মানুষের বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে যে ভারত সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের সংসদ যা বিধি করেছে তা দেশকে বাঁচানোর জন্যই।