১৯০২ সালের মার্চ মাসে দোল পূর্ণিমার দিনে বাংলার ১০ই চৈত্র (২৪ মার্চ) কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় অনুশীলন সমিতি। ঐ বছরই জুলাই মাসে প্রয়াত হন স্বামী বিবেকানন্দ যিনি রবীন্দ্রনাথের মতন নির্বীর্য দেশবাসীকে সাহস অবলম্বন করতে, কাপুরুষতা, দুর্বলতা দূর করে মানুষ হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। বাঙালি দুর্বল, ভীরু এবং কাপুরুষ — এই কলঙ্ক মোচনের জন্য কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় অাখড়া গড়ে তরুণ ও যুবকদের শারীরিক বলে বলীয়ান করে তুলতে প্রতিষ্ঠিত হয় অনুশীলন সমিতি। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার কাছে মদন মিত্র লেনে সতীশচন্দ্র বসুর উদ্যোগে প্রথম প্রতিষ্ঠিত একটি অাখড়াকে কেন্দ্র করেই অনুশীলনের জন্ম। পরে তা কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়। সতীশ বসু অনুশীলনের জনক হলেও ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব- এর অনুশীলন তত্ত্বের কথা মাথায় রেখে সমিতির নাম — ভারত অনুশীলন সমিতি রাখেন নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলের প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ব্যারিস্টার পি মিত্র (প্রমথনাথ মিত্র) ভারত শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখেন অনুশীলন সমিতি। অনুশীলন সমিতি এবং সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারা প্রায় সমার্থক। বাংলার যত গুপ্ত সমিতি সবেরই এক কথায় রোল মডেল ছিল অনুশীলন সমিতি। যুগান্তর ছিল একসময় অনুশীলন সমিতিরই প্রচার মাধ্যম। যদিও পরে সমিতির লক্ষ্য কী হবে ( শুধু শারীরিক দক্ষতা অর্জন নাকি অত্যাচারী শাসকদের দমনের মাধ্যমে দেশের মানুষের জাগরণ) তাকে কেন্দ্র করে বিরোধের থেকে যুগান্তর একটি পৃথক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।অাত্মোন্নতি সমিতি ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে অনুশীলনের সাথে একীভূত হয়ে যায়। অনুশীলন ও যুগান্তরের মধ্যে দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্য নিয়ে কোনদিন কোন বিরোধ ছিল না। দুই সমিতির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যেও যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। স্বাধীনতার বেদীমূলে অনুশীলন ও যুগান্তরের বিপ্লবীদের অাত্মোৎসর্গ ছিল অতুলনীয়। পুলিশের গোপন রিপোর্টে বলা হয়েছে —- ” The Anushilan Samiti became the most influential and hostile of all the samities. . . . this society had as its ultimate object, the independence of India to be obtained by the overthrow of Government. ” অনুশীলন সমিতির সংগঠন ও শাখাসমূহের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় sedition committe report (rowlatt) ৫ম অধ্যায়ে। সমিতির দুইটি অঙ্গ ছিল – প্রকাশ্য ও গুপ্ত এর মধ্যেও আবার স্তরের বিভেদ ছিল। প্রতিটা স্তরেই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হতো। সমিতির সভ্যবৃন্দদের শিক্ষার জন্য নানা রকমের পাঠ্যসূচি স্থির করা হয়েছিল যথা —ভগবতগীতা , বিবেকানন্দের রচনাবলী , ম্যাটসিনী ও গ্যারীবল্ডি জীবন চরিত প্রভৃতি। শক্তি উপাসনার জন্য ‘ ভবানী মন্দির ‘ নামক বই পড়তে হতো । ‘ বর্তমান ‘ রণনীতি নামক একটি বইয়ের মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল যে সহজে বৈদেশিক নিষ্পেষণ বন্ধ করা না যায় তবে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। দেশের যুব শক্তিকে গেরিলা যুদ্ধে নিয়োজিত করতে হবে । তবেই তাঁরা নির্ভীক ও অসিযুদ্ধে পারদর্শী হবে । তাঁদের কে বীর্যবান বিপদের সম্মুখীন হতে হবে ।
অনুশীলন সমিতির সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগযোগ ছিল তিনি বেশ কয়েকবার সমিতির কার্যালয়ে যান সমিতির যুবকদের সাথে মিলিত হন এবং তাঁর নব রচিত কয়েকটি বাউল গান গেয়ে শোনান। জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দা লেনের শিবমন্দিরে সামনে অনুশীলন সমিতির একটা শাখা খোলা হয়েছিল । সেইখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ সদস্য হয়েছিলেন ।
সমিতির সভ্যরা বিশেষ পরোপকারী ছিলেন বিপন্ন মানুষদের বিভিন্ন রকম সাহায্য করতেন। দুঃস্থ মধ্যবিত্ত পরিবারদের সাহায্যের জন্য প্রতি রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল সংগ্রহ করতেন। সভ্যরা কেউ অসুস্থ হলে সেবা করবার বন্দোবস্ত হতো । সেই সময় কোন সৎকার সমিতির অস্তিত্ব ছিলনা । সমিতির সভ্যরা খবর পেলেই দ্বিধাহীন ভাবে অসহায় মৃতের সৎকারের কাজও করতেন ।
অনুশীলন সমিতিই সর্বপ্রথম কলকাতায় শ্রমজীবী বিদ্যালয় প্রবর্তন করেন। এ বিষয়ে প্রধান উদ্দ্যোগী ছিলেন সোদপুরের তেঘরার বাসিন্দা শশিভূষণ রায়চৌধুরী। তাঁরই উদ্যোগেই গরীবশ্রেণীর নিরক্ষর জনগণের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । রাত্রে ও ছুটির দিনে সভ্যরা দরিদ্র শ্রমিক সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতেন। শিক্ষাব্রতী সুশীলকুমার আচার্য মহাশয় এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এটা আরম্ভ করেন শরৎচন্দ্র ঘোষ , যতীন শেঠ প্রভৃতি। এই নৈশ বিদ্যালয়ের শিক্ষা কিরূপ ফলবতী হয়েছিল তাঁর একটি উদাহরণ সিমলার জৈনিক মুটিযার ছেলে যথাক্রমে ম্যাট্রিক, আই.এ ., বি .এ .পাশ করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন । আরও আশ্চর্যের কথা এই , তখনও তাঁর পিতা মুটিয়াগিরি করতেন।
অনুশীলন সমিতিই বাংলদেশে প্রথম স্বেচ্ছাসেবক প্রথা প্রচলন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলামী শিক্ষা পরিত্যাগ করে জাতিগঠন মূলক শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্যেশ্যে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠা এই সময়ে অপর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা । রাজা সুবোধ মল্লিক , স্যার রাসবিহারী ঘোষ , ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রভৃতির অর্থদানে সম্ভবপর হয়েছিল। এই শিক্ষাপরিষদের সাথে অনুশীলন সমিতির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। অনেক সভ্য এই সংগঠনের সহয়তা করেছিলেন । এই শিক্ষায়তন পরবর্তী কালে ..Collage of Engineering and Technology , Jadavpur , নামে খ্যাতি অর্জন করে। বর্তমানে যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত।
বাংলার বিপ্লববাদ প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অনুশীলন সমিতি recruiting centre এ পরিণত হয়েছিল। এর ফলে নানা প্রতিষ্ঠানে বহু মৃত্যুঞ্জয়ী বীর সভ্য বাংলার বিপ্লবে যোগদান করেছিল। মানিকতলা মুরারিপুকুর ” বোমা আড্ডা ” রডা কোম্পানির পিস্তল সংগ্রহ , তথাকথিত রাজনৈতিক ডাকাতি , ব্রিটিশ রাজ কর্মচারীদের হত্যা প্রভৃতির দ্বারা বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিপ্লব উদ্যোগে চলতে লাগল । ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিপ্লবী ও সেনা দলের সাথে যোগযোগ স্থাপন হতে লাগল। অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ আঈ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হলো । ১৯১৪-১৬ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করবার জন্য জাপান জার্মানী প্রভৃতি দেশের সাথে যোগযোগ স্থাপন হয় ।
এই রকম একটি সংগঠনকে মুজাফ্ফর আহমেদ ‘ আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি ‘ নামক বইতে চরম সম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সুক্ষ্মতায় আচ্ছন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন।তাই জন্য বাংলা বিপ্লবীদল অনুশীলন সমিতির সম্মন্ধে বলতে পারেন এই কথাটা- অনুশীলন সমিতির এই অনুশাসনের জন্যই সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা চরম হিন্দু জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। এই অনুশীলন সমিতির সাথে জড়িত ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ওনার সেটা অজানা নয় সাহিত্যক বনফুল উচ্চধরণা পোষন করতেন । মুজাফ্ফর আহমেদ সাহেব হয়তো ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন অনুশীলন সমিতিতে যিনি তরবারি চালানো শেখাতেন তাঁর নাম ছিলেন মার্তজা সাহেব তিনিও জন্মসূত্রে মুসলিমই ছিলেন । অথচ মুজফফর আহমেদ বইতে লিখেছেন অনুশীলন সমিতিতে নাকি মুসলিম অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল আবার চরম সম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সুক্ষতায় তা আচ্ছন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন।
সৌমেন ভৌমিক