“নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ” হিন্দু শরণার্থীদের আত্মমর্যাদা, সুরক্ষা ও স্বস্তি দিল #IndiaSupportsCAA

হিন্দু উদ্বাস্তু বা শরণার্থী এবং বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর পার্থক্য :-

 রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক দপ্তর ‘ ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশন অফ রিফিউজিস’ (U N H C R) ১৯৪১ সালের জেনেভা কনভেনশন এবং ১৯৬৭ সালের উরুগুয়ে প্রটোকল অনুসারে উদ্বাস্তু বা শরণার্থীর সংজ্ঞা :

“যদি কোনও দেশের কোনও মানুষ জাতি, ধর্ম, রাষ্ট্রীয়তা, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনও বিশেষ দলের সদস্য হওয়ার জন্য নিজের দেশে অত্যাচারিত হন এবং গভীর ভয়ের জন্য দেশে ফিরতে না চান, তবে ওই মানুষটি দ্বিতীয় বা আশ্রয়দাতা দেশে উদ্বাস্তু
বা শরণার্থী হিসেবে গণ্য হবেন।”

সেই কারণে ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য বাংলাদেশে উচ্চবর্ণ/ নিম্নবর্ণ নির্বিশেষে নির্যাতিত হয়ে ভারতে আসা প্রত্যেক হিন্দুই শরণার্থী বা উদ্বাস্তু। কিন্তু ভারতকে কর্মসংস্থান ও ব্যবসার বিরাট বাজার মনে করে বা বিনা যুদ্ধে ভারত দখলের নীতিকে কার্যকর করার জন্য বা খাগড়াগড়ের মতো বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য যেসব বাংলাদেশি মুসলিম ভারতে এসেছে তারা সবাই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। তাই ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ মাত্রই স্পষ্ট ভাবে ভারতে প্রধানত বেআইনিভাবে প্রবেশ করা মুসলিমদের বুঝতে হবে।

আপনারা কখনও ভেবে দেখেছেন কি?

 ১) দেশভাগের যোজনা অনুযায়ী ১৯ শতাংশ মুসলমানদের জন্য ২৩ শতাংশ জমি দেওয়া হয়। বাবাসাহেব আম্বেদকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সহ আরো অনেকের সম্পূর্ণ লোক-বিনিময়ের প্রস্তাব  নেহরু অগ্রাহ্য করেন।

২) পরিণামে, হিন্দুদের উদারতায় অধিকাংশ মুসলমান ভারতে থেকে যায়।  কিন্তু পাকিস্তানে ধারাবাহিক নির্যাতনের ফলে হিন্দুরা বিতাড়িত হতে হতে পাকিস্তান প্রায় হিন্দু শূন্য হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান থেকেও বিতাড়ন চলতে থাকে।

৩) এমতাবস্থায়, বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেওয়ার সময়, ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখের পর ভারতে বাংলাদেশ থেকে কোনও হিন্দু আসবেন না এই মর্মে মুজিবের সঙ্গে চুক্তি করেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যাতে একজনও হিন্দুকে নির্যাতিত হয়ে ভারতে আসতে না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার  সক্রিয় ও আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশের উপর কোনও ধারাবাহিক চাপ  বজায় রাখেনি । ফলে বাংলাদেশ থেকে  নির্যাতিত হিন্দুর শরণার্থী হয়ে ভারতে আসা বন্ধ হয়নি। পরিনামে,  হিন্দুর সংখ্যা সেখানে ১৯৫১ সালে ছিল ২২ শতাংশ। ২০১১ সালে তা কমে ৮.৫ শতাংশ হয়েছে। এর বিপরীতে, ১৯৪৭ সালে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ৯.৮ শতাংশ,  ২০১১ সালে তা বেড়ে ১৪.২ শতাংশ হয়েছে। এই একই সময়ে হিন্দু জনসংখ্যা ৮৫ শতাংশ থেকে কমে ৭৯.৮ শতাংশ হয়েছে।

৪) এই বাড়তি হিন্দু শরণার্থীর চাপ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা – কে নিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে পরিকল্পিতভাবে ভারতে আসা বেআইনি  মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের চাপ।

৫) কেন্দ্রের কংগ্রেস এবং এই তিনটি রাজ্যের রাজ্য সরকারগুলি একদিকে  হিন্দু বাঙালি শরণার্থী/ উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের বিষয়ে কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।   তাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার বরাবর নীরব থেকেছে; অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে বেআইনি মুসলিম অনুপ্রবেশ বন্ধ করারও কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।

৬) পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং বর্তমান রাজ্য সরকার  হিন্দু শরণার্থীদের স্থায়ী নাগরিকত্বের বিষয়ে কেন্দ্রের কাছে তদ্বির করেনি।  অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে আসা বেআইনি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় বন্ধে কোনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

৭) কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার অবস্থার বিপাকে শরণার্থী হয়ে আসা বাঙালি হিন্দুদের পুনর্বাসনের জন্য দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে দেয়, যে দণ্ডকারণ্য স্বাধীনতার এত বছর পরেও কৃষি-শিল্প কর্মসংস্থান – আর্থিক উন্নতি সব দিক থেকে এতটাই পিছিয়ে যে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেখানে মাওবাদীদের ঘাঁটি তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ  অসহায় হিন্দু শরণার্থীরা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অবহেলা ও অবিচারের শিকার হয়েছে। সেখানকার স্থানীয় মানুষদেরই যখন এই দুরবস্থা তখন ছিন্নমূল বাঙালি হিন্দুরা সেখানে গিয়ে জীবন – জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছুই করতে পারত না বা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে অথৈ জলে পড়তো এ ব্যাপারে কোনও  সন্দেহ নেই।

৮) এই প্রথম কোনও কেন্দ্রীয় সরকার আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত মূলত হিন্দু শরণার্থীদের স্থায়ী নাগরিকত্ব প্রদানে উদ্যোগী হয়ে “নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ” এনে তা আইনে পরিণত করল।এর জন্য বর্তমান কেন্দ্র সরকার এর জন্য কোনও ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। 

হিন্দু শরণার্থী ও বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নিয়ে মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংশয় আশঙ্কা ও বিভ্রান্তি দূর করে কেন্দ্র সরকার সংশোধনীতে স্পষ্টভাবে বলেছে যে:-

আফগানিস্তান,বাংলাদেশ ,পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ ভাবে হিন্দু-বৌদ্ধ – শিখ – জৈন – পারসি-খৃষ্টান যাদেরকে কেন্দ্রীয় সরকার পাসপোর্ট আইন ১৯২০ – র ধারা ৩ এর উপধারা (২)  অনুসারে অথবা  ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬ প্রযুক্ত হওয়া থেকে ছাড় দিয়েছে, তারা এই আইনের (নাগরিকত্ব আইন) জন্য “বেআইনি অনুপ্রবেশকারী” হিসাবে বিবেচিত হবেন না। 

৯) শুধু তাই নয়,  দীর্ঘদিন ধরে ইন্দিরা- মুজিব চুক্তিতে উল্লিখিত যে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখটি পরবর্তী সময়ে আসা হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটির পরিবর্তে  ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে আগত সমস্ত হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার শুভ উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ।

১০) নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় শরণার্থী/ উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। তারা দেশ ভাগের আগে থেকে ভারতে থাকা নাগরিকদের মতই আত্মমর্যাদা ও স্বাভিমানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে এদেশে বসবাস করবেন। হিন্দু শরণার্থী ও বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কোনও জটিলতা বা  ধোঁয়াশা থাকবে না। ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো তো দূরের কথা বরং, এর ফলে কোনও অসাধু আধিকারিক অনুপ্রবেশকারীর তকমা লাগিয়ে কোনও হিন্দু শরণার্থীকে হেনস্তা করতে পারবেন না।       

১১) প্রথমে নাগরিকত্ব সংশোধনীর মাধ্যমে ৩১ ডিসেম্বর,২০১৪  পর্যন্ত ভারতে আসা সমস্ত  হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করা হবে।

১২) নাগরিকত্ব প্রমাণে কোনও নথিপত্রের প্রয়োজন নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং লোকসভায় বলেছেন  রেশন কার্ড থাকুক না থাকুক কোনও সমস্যা নেই। হিন্দু যে শরণার্থীরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তারাই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

১৩) অবৈধভাবে থাকার জন্য কারও বিরুদ্ধে চালুমামলাও  নতুন আইন অনুযায়ী সেই ব্যক্তি নাগরিকত্ব পেলে বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি যে শরণার্থীরা  অবৈধভাবে থাকার সময়কালে জমি বাড়ি কিনেছেন, বা চাকরি করছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।

সুতরাং এককথায় বলা যায় যে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ‘ হচ্ছে বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের সুরক্ষা – কবচ। বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের এ দেশ থেকে তাড়ানো বা ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার জন্য নয়। বরং, যাতে আবার অসমের মতো অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি না হয় তার জন্য একটি স্থায়ী ,শুভ ও মহৎ উদ্যোগ। 

অথচ বিগত কিছু দিন ধরে গুজবের ঢেউ উঠেছে। বাঙালিদের না কি দলে দলে এদেশ থেকে তাড়ানো হবে –  এই বলে স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী, নিহিত ক্ষুদ্র ও দলীয় স্বার্থান্বেষী  রাজনৈতিক দল,নেতা সহজ সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ব্যস্ত। অধিকাংশ সংবাদপত্রে এই মর্মে উত্তর সম্পাদকীয় ও ওয়েব  পোর্টালে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে। যারা ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী’ – র স্বপক্ষে তারা বাঙালি বিরোধী এই মর্মে আলোচনা চক্র আয়োজিত হচ্ছে। এ সবের আসল উদ্দেশ্য কি?

১) এ সব রাজনৈতিক দল ও নেতাদের উদ্দেশ্য হলো, বাঙালি আবেগের আড়ালে  হিন্দু  বাঙালি শরণার্থীদের  সঙ্গে বাংলাদেশি বেআইনি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের একই গোত্রভুক্ত করে তাদেরকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া। ভারতের অখন্ডতা, নিরাপত্তা, জন বিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট করে; ভারতীয় নাগরিকদের সরকারি সুযোগ সুবিধা, কর্মসংস্থানে ভাগ বসানোর ব্যবস্থা করার বিনিময়ে বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে ব্যবহার করা এবং তাদের ভোটে জিতে নিজেদের দলীয় ও ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থকে চরিতার্থ করা , দীর্ঘ দিন ক্ষমতার মধু চেটেপুটে খাওয়া।

২) ইন্দিরা – মুজিব চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ – এর ২৪ মার্চ এর পর ভারতে আসা হিন্দু শরণার্থীদেরকেও বেআইনি অনুপ্রবেশকারী রূপে গণ্য করার অধিকার প্রশাসনের ছিল। শাসক দল (পূর্বতন ও বর্তমান) এই অধিকার  নিজেদের স্বার্থে  ব্যবহার করেছে।  বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের প্রতি পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তারা রেশন কার্ড, সন্তানদের বিদ্যালয় ভর্তি সহ অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা সবই পাবে কিন্তু শর্ত একটাই, তাদেরকে সবসময়  শাসকদলের তাবেদার হয়ে থাকতে হবে। সংশোধনী আইনে পরিণত হওয়ায় বাঙালি হিন্দু শরণার্থীরা স্থায়ীভাবে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন এবং তারা আর শাসকগোষ্ঠীর তাবেদের হয়ে থাকতে বাধ্য হবেন না। কারণ, নাগরিক হিসাবে সমস্ত রকমের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে হিন্দু শরণার্থীদের আর শাসকগোষ্ঠীর শরণাপন্ন হতে হবে না। এবং সেই সুযোগে ১৯৭১ এর ২৪ মার্চ তারিখের অজুহাতে  রেশন কার্ড, বি পি এল কার্ড, আই কার্ড, আধার কার্ড এবং জমির পাট্টা ও জমি বাড়ি কেনা সহ অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার ভয় দেখিয়ে শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে আর ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে না। হিন্দু শরণার্থীরা স্বাধীনভাবে  রাজ্য ও দেশের স্বার্থে তাদের রাজনৈতিক মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন বা রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। অন্য কোনও দলের মিটিং মিছিলে যোগ দিলে  তাদেরকে আর শাসকগোষ্ঠী সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। এর জন্যই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ও পূর্বতন শাসকগোষ্ঠী , যারা নিজেদের মিটিং-মিছিল বা  ব্রিগেড ভরানোর জন্য কিংবা অন্য দলের কর্মীদের  বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য এসব অসহায় হিন্দু শরণার্থীদের ব্যবহার করে আসছে, তারা সে সুযোগ হারাল। তাই তারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখটির আইনি বৈধতা  সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বজায়  রাখতে চাইছিল যাতে  হিন্দুরা ওপার বাংলায় আওয়ামী লীগ বা বি এন পি-র দলদাস আর অত্যাচারিত হয়ে এপার বাংলায় আসলে শাসকগোষ্ঠীর দলদাস হয়ে থাকতে বাধ্য হন।  এরকম অবস্থায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় হিন্দু শরণার্থীদের ব্ল্যাকমেইল করার প্রধান অস্ত্রটাই তাদের হাতছাড়া হল। তাই যে কোনও মূল্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ঠেকাতে  তারা এ জন্যই এত মরিয়া ছিল।

৩)  বাঙালিয়ানার জিগির তোলা স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা কল্পনার ফানুস আকাশে উড়িয়ে বলে চলেছেন যে , বাঙালির অবস্থা রোহিঙ্গাদের মতো হবে। নাৎসিদের ইহুদি নির্যাতন, প্যালেস্তিনীয়দের  দুরবস্থা ইত্যাদির গল্প বলে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য এদের চোখে জল কিন্তু দুঃখের বিষয় পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু নির্যাতন, কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের  উপর নির্যাতন এদের চোখে পড়ে না তাই চোখে জল আসে না। হিন্দু শরণার্থীদের দুরবস্থা,  ২৪ মার্চ ১৯৭১- এর পরে আসা হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ইত্যাদি নিয়ে লেখার সময় এদের কলমের কালি, চোখের জল শুকিয়ে যায়। বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্বের পক্ষে বাধা স্বরূপ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখটি বাতিলের জন্য এদের কলম কখনও গর্জে ওঠেনি।

৪) এই বাঙালিত্বের জিগির তোলা বুদ্ধিজীবীরাআসলে  না ‘বাঙালি’, না ‘হিন্দু’, না ‘ভারতীয়’। এরা আদ্যপ্রান্ত পেশাজীবী। এদের একমাত্র লক্ষ্য হল অর্থ ও প্রতিষ্ঠা। এদের সাহিত্য, চলচ্চিত্র, কবিতা সবই বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক। বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে কথা না বলে আসলে এরা দুই বাংলারই বাংলাভাষী মুসলিমদের (বাঙালি নয়, অবশ্য অতি নগণ্য কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। ) মন জয় করতে চায় যাতে এদের সাহিত্য, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র, নাটকের পাঠক, শ্রোতা  বা দর্শক বাড়ে এবং তাদের উপার্জন ও প্রতিষ্ঠাও বাড়ে।

৫) শুধু তাই নয়, এরা বলছেন যে বাঙালি হিন্দু শুধু বাঙালিয়ানার  গর্ব  করবে হিন্দুয়ানির নয় কারণ, হিন্দুয়ানি হলো সাম্প্রদায়িক।  রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারায়’ প্রবন্ধে লিখেছেন  ,” হিন্দু শব্দে ও মুসলমান শব্দে একই পর্যায়ের পরিচয়কে বোঝায় না। মুসলমান একটি ধর্ম। কিন্তু হিন্দু কোনও বিশেষ ধর্ম নয়। হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিনাম।” স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথ এখানে ধর্ম বলতে ইংরেজি রিলিজিয়ন বা  নির্দিষ্ট উপাসনা ভিত্তিক সম্প্রদায়কেই বোঝাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ তার মতে মুসলমান একটি সম্প্রদায় হিন্দু কোনও সম্প্রদায় নয়। হিন্দু যখন সম্প্রদায়ই নয় তখন তা সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। তাই বাঙালি হিন্দু বাঙালিয়ানার সঙ্গে হিন্দুর এই জাতিগত অস্মিতা নিয়ে অবশ্যই গর্ববোধ করতে পারে। এর মধ্যে যদি কেউ সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খোঁজেন তবে করুণাময় ঈশ্বর তাকে  সুবুদ্ধি দিন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের থেকেও স্বঘোষিত বড় পন্ডিতরা বলছেন যে হিন্দুত্ব নয়,বাঙালি হিন্দুর বাঙালিয়ানা নিয়ে গর্ব করা উচিত। কারণ হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িক আর যারা হিন্দুত্বের কথা বলে তারা আসলে বাঙালি বিরোধী এবং বাঙালিদের উপর জোর করে হিন্দি ও হিন্দুত্ব চাপিয়ে দিতে চায়। এবং পশ্চিমবঙ্গে যারা হিন্দুত্বের কথা বলে তারা আসলে সেই বাঙালি বিরোধীদের চাটুকার।  অথচ এই সরল সত্যটি স্বীকার করার সৎ সাহস এদের নেই যে , সাধারণ বাঙালি হিন্দু এই অতি পন্ডিতদের মুখে ছাই দিয়ে তার ‘বাঙালিত্ব’ – র সঙ্গে ‘হিন্দুত্ব’ নিয়েও সমানভাবে গর্বিত। সেজন্য তারা হিন্দুত্ব বজায় রাখতেই পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে এসেছেন। না হলে তো তারা নিজেদের হিন্দু সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও পরম্পরা হারিয়ে শুধু বাংলাভাষী মুসলমান হয়েই বাংলাদেশে থাকতে পারতেন।

কল্পনাপ্রবন হয়ে এভাবে যাদের পছন্দ নয় তাদের ফ্যাসিবাদী, নাৎসী, বাঙালি বিরোধী ইত্যাদি মনগড়া তকমা লাগিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো গণতন্ত্র ও  মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহার মাত্র।

এই ক্ষুদ্র, নিচ, দলীয় ও ব্যক্তিগত নিহিত স্বার্থের জন্যই এক দিকে যেমন বামফ্রন্টের এক কুখ্যাত মন্ত্রী মহারাষ্ট্র থেকে ধরে আনা মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের, ট্রেন থামিয়ে মহারাষ্ট্র পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, অন্য দিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বিতারণের বিরুদ্ধে  কলম ধরেছিলেন।

সব শেষে যারা এত ‘বাঙালি’ অস্মিতার ধূয়ো তুলেছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বিনীত প্রশ্ন-

ক)  যদি ‘বাঙালি’ পরিচয়ই হিন্দু-মুসলমানের  পারস্পরিক সম্প্রীতির ভিত্তি হয়, তাহলে কয়েক কোটি বাঙালি হিন্দু বাঙালি পরিচয়ের গর্ব নিয়ে বাংলাদেশে কেন থাকতে পারলেন না ?  শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে কেন তাদের উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হয়ে ভারতে আসতে হল ?

খ) ২০১০ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সে দেশের ‘স্টেট রিলিজিয়ন’ রূপে ইসলামের মর্যাদাকে পাকাপাকিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়াও, ১৯৭৭ ও ১৯৯৭- তে সংবিধানে যুক্ত হওয়া যথাক্রমে, “সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাস ও আনুগত্য” এবং “বিসমিল্লাহ – অর- রহমান-অর রহিম” অর্থাৎ “পরম করুণাময়, পরহিতকারী আল্লাহর নামে” – এই বিশেষ শব্দগুলিকেও বলবৎ রেখেছে। বৃহত্তর বাঙালি ভাবনার পরিপন্থী এবং সংকীর্ণ ইসলামী চিন্তার পরিচায়ক এসব সিদ্ধান্তের জন্য  এই অতি পণ্ডিতরা কিন্তু কখনোই গেল গেল রব তোলেন নি। এর ফলে ইসলামি ধর্মান্ধতা বেড়েছে এবং বাংলাদেশের হিন্দুদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে হিন্দুদের শরণার্থী হয়ে ভারতে আসা বন্ধ হয়নি। এ ব্যাপারে তাদের কলম বন্ধ্যা কেন?

গ) বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু শরণার্থীরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে  বসবাস করছেন। অসমের বুকে চিন, আই এস আই মদতপুষ্ট আলফা জঙ্গিদের দ্বারা সংঘটিত কয়েকটি নারকীয় হিংসাত্মক ঘটনা ছাড়া বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের কোনও অবাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য থেকে বিতাড়িত করা হয়নি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু যিনি নিজে উদ্বাস্তু হয়েও মরিচঝাঁপিতে কয়েক হাজার বাঙালি হিন্দু শরণার্থীকে নেড়ি কুকুরের মতো গুলি করে কুমির, কামটের মুখে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি কি ‘বাঙালি’ পদবাচ্য ? নাকি তিনি অবাঙালি ছিলেন ? 

সরকারের সব সিদ্ধান্তেরই বিরোধিতা সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়। তাই আশা করা যায় যে সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল যদি সত্যিই  হিন্দু বাঙালি শরণার্থী বা উদ্বাস্তু প্রেমী হয়, তবে লোকসভা ও রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল  পাস করিয়ে সমস্ত হিন্দু বাঙালি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের যে শুভ ও সদর্থক উদ্যোগ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে তা বাস্তবায়িত করার জন্য সহযোগিতা করবেন যাতে একজন বাঙালি হিন্দু শরণার্থীরও নাম তালিকা থেকে বাদ না যায়।

আমাদের কী করনীয়

১)  নিম্নোক্ত বিষয়গুলি প্রত্যেকটি হিন্দু শরণার্থী/ উদ্বাস্তু পরিবারকে সহজ, সরল ও  স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে –

ক) বাঙালি হিন্দু শরণার্থী/ উদ্বাস্তু ও বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীর পার্থক্য ।

খ)  নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় শরণার্থী/ উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। কোনও জটিলতা বা  ধোঁয়াশা থাকবে না। এর ফলে কোনও অসাধু আধিকারিক বা শাসক দল অনুপ্রবেশকারীর তকমা লাগিয়ে কোনও হিন্দু শরণার্থীকে হেনস্তা বা ব্ল্যাকমেইল করতে পারবেন না।

গ) প্রথমে নাগরিকত্ব সংশোধনীর মাধ্যমে ৩১ ডিসেম্বর,২০১৪ পর্যন্ত ভারতে আসা সমস্ত  হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করা হবে।

ঘ) নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য যে যে ব্যবস্থা ( উপরে আলোচিত ) নেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে নাগরিকত্বের প্রশ্নে ১৯৭১- এর ২৪ মার্চ তারিখের আর কোনও গুরুত্ব থাকবে না, কোনও নথিপত্র লাগবে না ইত্যাদি।  

চ) কংগ্রেস, বামফ্রন্ট ও তৃণমূল প্রত্যেকে হিন্দু শরণার্থীদের ভোটার হিসাবে ব্যবহার করেছে কিন্তু  স্থায়ীভাবে তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কোনই উদ্যোগ নেয়নি।

ছ) উপরে আলোচিত ‘ নাগরিকত্ব সংশোধনী’ – র বিরোধিতার উদ্দেশ্য সম্পর্কিত (২)ও (৪) নম্বর বিন্দুর বিষয়টি সকলকে বিশেষ ভাবে বোঝানো যাতে তাদের এতদিনের ভুল ধারণা ভেঙে যায়।

২) তাই যে সব রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী, বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের সঙ্গে বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের  একই গোত্রভুক্ত করে ‘বাঙালি বাঙালি’ বলে চেঁচিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও জনমত গড়ে তুলে তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করুন।

৩)  নিজেরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখুন এবং অন্যকে সচেতন করুন যাতে এরাজ্যের অসাধু আধিকারিকরা (বিশেষভাবে ভূমি ও রাজস্ব দপ্তর – এর ) অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে একজনও বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীকে বৈধ নথিপত্র তৈরি করে দিতে না পারে।

৪) কোনও রাজনৈতিক দলের কেউ তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে আসলে বা ভয় দেখালে তারা যেন দাপটের সঙ্গে বলেন যে, তারা যদি সত্যিই  হিন্দু বাঙালি শরণার্থী বা উদ্বাস্তু প্রেমী হয়, তবে তারা লোকসভা ও রাজ্যসভায় ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল’ – এর যা বিরোধিতাা করার করেছে কিন্তুু হিন্দু বাঙালি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের যে শুভ উদ্যোগ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে তা বাস্তবায়িত করতে সহযোগিতা করে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.