ঊনবিংশ শতাব্দীতে অন্যায়ের সঙ্গে আপসহীন এক ওজস্বিনী, বিধবা বঙ্গনারী সরকারি খেতাব ছাড়াই ‘রানী’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি রানী রাসমণি (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৭৯৩ — ১৯ ফেব্রয়ারি, ১৮৬১), বঙ্গ নবজাগরণের এক অন্যতম পথিকৃৎ, নীলবিদ্রোহের সূত্রপাতেরও প্রকৃত পথপ্রদর্শক। তাঁর নামের মধ্যে এবং আচরণে ছিল সাহসী মাতৃত্বের যথাযথ পরিপূর্ণতা; সেই সঙ্গে তেজস্বিতা, বুদ্ধিমত্তা, নির্ভীকতা, এমনকি সামাজিক-বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেওয়ার সক্ষমতা। রানী রাসমণির দানের কথাও দেশসুদ্ধ লোক জানতেন। তাঁরই ঐতিহাসিক কীর্তি ধর্মসমন্বয়ের মর্মস্থল দক্ষিণেশ্বরের মন্দির (১৮৫৫)। তাঁর মন্দির চত্বরে তিনি বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে। ভারতের আধ্যাত্মিক জগতে এক নতুন যুগের সূচনা হল। ঠাকুরের ‘রানী-মা’ তিনি। আর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেখেছেন শ্রীশ্রীজগদম্বার অষ্টনায়িকার অন্যতমা রূপে। রানীর মানবী সত্তা এবং দেবী সত্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল। ।
তাঁর অতুল্য গুণগুলি তাঁকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালেই তুলে ধরেছিল এক মহতী হৃদয়বেত্তার প্রকাশে, স্বাধীনতাচেতা ও বীরোত্তমার প্রকাশে৷ ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের ঔদ্ধত্য কখনো মেনে নেন নি তিনি। নিজ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত মকিমপুর পরগণায় নীলকরদের উৎপীড়ন একেবারে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। পাকা লাঠিয়াল নিযুক্ত করে নিজের এলাকার অত্যাচারী নীলকরদের প্রবল মারধর করে প্রায় মৃতপ্রায় করে দেন। পাশাপাশি মামলা রুজু করেও নীলকর সাহেবদের জমিদারি এলাকা থেকে পুরোপুরি বহিষ্কার করেন। কর্মচারীদের আদেশ দিয়ে বলেন, কোনো চাষী যেন নীলকরদের কাছে জমি বিক্রি না করে।
মহিলা ও অসহায় ভেবে একবার রানীর জগন্নাথপুর তালুকের পার্শ্ববর্তী জমিদার নড়াইলের রামরতন রায় সুযোগ বুঝে তাঁর প্রজাদের উপর অমানুষিক উৎপীড়ন করতে শুরু করলেন। এর প্রতিশোধ নিতে রানী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাছাইকরা এবং ভীষণাকার লাঠিয়াল, পাইক ও সড়কিওয়ালাদের পাঠালেন। তারা প্রবল কলরবে ‘জয় রানী রাসমণির জয়’ হুঙ্কার তুলে এগোতেই রামরতনের বাহিনী পিছু হটে গেল। এরপর প্রজাদের নিশ্চিত করতে আগ্রাসী জমিদারের বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করলেন। রানীর জয় হল।
বুদ্ধিমতী রানীমা ইংরেজ গভর্নমেন্টকে বোকা বানিয়ে এবং পরে আইনি লড়াইয়ে পর্যুদস্ত করে তাদের জারি করা মৎস্যজীবীদের জন্য ধার্য ‘জলকর’ চিরকালের জন্য তুলে দিয়েছিলেন। সেই সময় কলকাতার কাছে ঘুসুড়ি থেকে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত গঙ্গা ব্যবহারকারী মৎস্যজীবীদের উপর জলকর চাপায় সরকার। তারা রানীর শরণাপন্ন হলে রানী জেলেদের মাছ ধরার এলাকাটি কায়দা করে উচিত মূল্যে জমা করে নেন। এরপর কর্মচারীদের নির্দেশ দিলে তারা জলসীমায় দড়ি, বাঁশের বেড়া, লোহার চেন ফেলে গঙ্গাবন্ধন করে জাহাজ ও নৌচলাচল বন্ধ করে দিলেন। সরকারের টনক নড়লে, রানীকে কারণ দর্শানো হল। রানীর সোজা জবাব, গঙ্গা জমা নেওয়া হয়েছে, সুতরাং আইনত ঐ পথ বন্ধ করার অধিকারও আছে। জাহাজ চলাচলের শব্দে মাছ থাকে না। প্রজাদের ক্ষতি করে জাহাজ চলাচল করতে দেওয়া যায় না। রানীর যুক্তিতে প্রতি যুক্তি না দিতে পেরে সরকার আপোষ করে। আগেকার মতো কর ছাড়াই জেলেরা মাছ ধরবে৷ সেই প্রথা এখনও চলছে। আর রানীর লিজের টাকাও ফেরত দেয় সরকার।
জানবাজারে রানীর প্রাসাদের কাছে গোরা সৈন্যদের ঘাঁটি থেকে মাতাল ও উচ্ছৃঙ্খল সেনারা একবার রানীর প্রাসাদ ভাংচুর ও লুঠপাট করে এবং দারোয়ানদের হত্যা করে। রানী সেই সময় রণরঙ্গিণী মূর্তিতে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে গৃহদেবতাকে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। পরে জামাই মথুর বিশ্বাস বিশাল পুলিশ নিয়ে সেনাদের আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করান। ক্ষয়ক্ষতির পুরো অর্থটাই সরকার রানীকে দিতে বাধ্য হয়।
রানী রাসমণির জন্ম উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হালিশহরের নিকটবর্তী কোনা গ্রামে। তিনি মাহিষ্যবংশীয় বৈষ্ণব দম্পতি হরেকৃষ্ণ দাস ও রামপ্রিয়া দেবীর তৃতীয় সন্তান। সাত বছর বয়সে তিনি মাতৃহীনা হন। ১৮০৪ খ্রীস্টাব্দের ২১ এপ্রিল রাজচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় এবং শ্বশুর-শাশুড়ির জীবদ্দশাতেই সকল কর্তৃত্বের অধিকারী হন। রাজচন্দ্র সততার সঙ্গে ব্যবসা করে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন। স্বামী বিশ্বাস করতেন স্ত্রীই তাঁর ভাগ্যলক্ষ্মী। এই দম্পতি চার কন্যার জন্ম দেন। গঙ্গাস্নান ও পারাপারের সুবিধার্থে কলকাতার বাবুঘাট, বাবু রোড (রাণী রাসমণি রোড) নির্মাণ, বেলেঘাটা খালের উপর পুল রচনা, বারকপুরের তালপুকুর খনন, চাষের সুবিধার জন্য নানান দীঘি ও পুকুর প্রতিষ্ঠা, বহু দরিদ্র ছাত্রের অধ্যয়ন ও ভরণপোষণের ভার গ্রহণ প্রভৃতি ছিল এই ধনী দম্পতির জনসেবামূলক কাজ। তীর্থসংস্কারের কাজও রাসমণি করেছেন। সিস্টার নিবেদিতার মতে, দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণ না হলে আমরা শ্রীরামকৃষ্ণকে পেতাম না। তাঁর সময়ে তিনি এক বীর নারী ছিলেন। জমিদারি কাজে নিজের শিলমোহরের আপন পরিচয় বিবৃত করেন – “কালীপদ অভিলাষী শ্রীমতী রাসমণি দাসী।”
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
তথ্যসূত্র
১. নির্মল কুমার রায়, রানী রাসমণিট জীবনবৃত্তান্ত, প্রথম সংস্করণ ১৫ তম পুনর্মুদ্রণ, ২০১৮, উদ্বোধন, কলকাতা।
২. গৌরী মিত্র, রানি রাসমণি দেবী, ২০১০, গ্রন্থতীর্থ, কলকাতা।