#দ্বিতীয়_পর্ব : খাঁচার ভিতর অচীন মৎস কেমনে ধরা দেয়?
চিংড়ির মালাইকারী কে না ভালোবাসে অথবা চিংড়ি ভাতে? সর্ষের তেল , নুন আর একটু কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখা চিংড়ি ভাতে খাইয়ে এক সময় অতিথিদের আপ্যায়ন করা আমার বাপের বাড়ির নিয়ম ছিল। অথবা, কোনো এক রবিবার দুপুরে গরম ভাত, লাউ চিংড়ি বা কুচো চিংড়ি আর ছোলা বা ডালের বড়া দিয়ে মোচার ঘন্ট…আহা…বাঙ্গালী আত্মীয় বন্ধুজন এমনকি আমাদের অবাঙ্গালী আত্মীয় পরিজনরাও সেসব চেটেপুটে খেতেন আবার বেঁধেও নিয়ে যেতেন। হয়ত এমনটি নাম করা হোটেল রেস্তোরাঁতেও মেলে না। বর্ষাকালে গাঁ ঘর বা মফঃস্বল এমনকি কলকাতার আবালবৃদ্ধবনিতার ভাত পাতে চিংড়ি ভাতে দেখা যেত।
এখন সেই চিংড়ি উধাও।বাজারে যদিও কাটাপোনার টুকরো এক দেড়শো টাকায় পাওয়া যায় , চিংড়ি ছুঁতে গেলে হাতে ফোস্কা পড়ে। বাঙ্গালী কিনবে কোথা থেকে? মুগরী কৈ? মাঠ নেই …মাঠে মাছ নেই তাই মুগরীও নেই।এবার প্রশ্ন হল কলকাতা বা শহরাঞ্চলে মাঠ নেই তাই মাছ নেই কিন্তু গাঁ ঘরে যেখানে মাঠ আছে সেখানে মাছ নেই কেন? কারন হল রাসায়নিক মেশানো কীটনাশক ও সার ….।
বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অধিক ফলনের জন্য নানা ধরনের রাসায়নিক সার, ওষুধ ইত্যাদি আমদানি হল। যার মধ্যে বেশকিছু বিষাক্ত ছিল।ফলে সেই ওষুধের প্রভাবে বাস্তুতন্ত্র শেষ হল। সাপ, ব্যাঙ , কেঁচো ও মাটিতে থাকা আরো নানা প্রাণী মরল।গেঁরি, গুগলি, শামুকও শেষ।
এখন রোজকার মৎস প্রিয় বাঙ্গালীর ভরসা কুচো ,কাঁচা, ফ্যাসা, ভোলা…..মাঠের চিংড়ি ভেটকি সবই গেছে। চল্লিশ বছর আগেও শুনেছি গাঁ গঞ্জের ঘরে মুগরী , পাঙ, ঘুনি দেখা যেত। চাষের জমির আল কেটে মুগরী বসানো হত। সন্ধ্যার পর রাতের আঁধারে মাছেরা চলাচল করার সময় মুগরীর কুলি ঠেলে ঢুকে পড়ত। আর বের হতে পারত না। মূলত চিংড়ি ধরার জন্য ছিল মুগরী। কই মাগুর ধরা হত পাঙ দিয়ে।আর চাঁদা মাছের জন্য ঘুনি। আরো কত নাম না জানা মাছ মুগরী বা ঘুনিতে ধরা পড়ত তা আজকের বরফের মাছ খাওয়া শহুরে বাবুরা মনে রাখেন কি না জানি না….
তো ধরা পড়া মাছের মধ্যে বেশ কিছু সুন্দরী মৎস ছিল।যেমন – কেঙ পুঁটি ।সাধারণ পুঁটির গড়ন, কিন্তু আকারে অর্ধেক। গায়ে তার কমলারঙ ,তার উপরে ও নিচে মোটা কালো ডোরা। ধীর গতিতে ঘুরে বেড়ায়। খলসে তো রীতিমতো চলচ্চিত্র নায়িকা। রঙ চঙ মেখে ঘোরে।আগে ছোটবেলায় তার রূপের মোহে পাগল হয়ে কাঁচের শিশিতে কলের জল ভরে টেবিল সাজাতাম।
এরা ছাড়াও আরো যেসব মাছ এসব যন্ত্রে ধরা পড়ত বা এখনো গাঁ ঘরে বর্ষাকালে ধরা পড়ে তারা হল দেঁড়ে , ভুদগুলি, ভোলা, ট্যাংরা, গোড়ই , চেঙ, চাং, ন্যাদস, গাংদাঁড়া, চেলা, পেটো, চিংড়ি, রুসুনে চিংড়ি। কখনো কখনো ভেটকির বাচ্চাও মুগরীতে ধরা পড়ে। আর আছে তেচোখা মাছ। আমাদের বাড়িতে এগুলো খেত না। পিসিরা বলতেন এঁটো খেকো মাছ। এরা সর্বদা ই জলের উপর তলে ভেসে থাকে। ঘাটের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। মানুষ ঘাটের ধারে এঁটো থালা বাসন রাখলেই ছুটে যায়। মুখ ধুয়ে জল ফেললে ছুটে যায় খেতে। তাই মাছ আমাদের বাড়িতে কেউ খেত না।
আর একটা জলে ভেসে থাকা মাছ আছে। তাকে তারই মাছ বলে। এগুলো বড় হয়। বড় বলতে দুশো থেকে আড়াইশো গ্রাম পর্যন্ত।এরা জলের উপর গোল গোল চোখ ভাসিয়ে ঘোরাফেরা করে। কোনো পুকুরে যদি পাঁচ ছটি থাকে তাহলে তাহলে একস্থানে সবগুলো দলবেঁধে চোখগুলো জাগিয়ে ঘোরা ফেরা করে। তারই চেহারায় অনেকটা পার্শে মাছের মত দেখতে। পার্শে , ভাঙন বা তারই এরা সব্বাই নদীর মাছ।কিন্তু সেচের সময় বা বর্ষাকালে নদীর জল মাঠে এসে পড়ে । সেই জলের সঙ্গে তারই, ভাঙন ,পার্শেরাও আসে ও ধরা দেয় মুগরীতে।তবে ভেসে থাকা মাছদের মধ্যে সব থেকে সুন্দরী হল গাংদাঁড়া। গাংদাঁড়া মানে হল বক বা বগো মাছ। কারন বকের মতো ঠোঁট এদের তাই এরা বক মাছ। যদিও এখন সেই গ্রাম সেই নস্টালজিয়া নেই তবুও রাঢ় বঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গের কিছু স্থানে মাছ ধরার কাজে মুগরী ব্যবহার হয়।
এসব মাছদের কে কিভাবে খাবেন , কেমন ধারা মশলা দেবেন , কোনটা ঝাল হবে আর কোনটা ঝোলে হবে তা মানুষের নিজ নিজ ইচ্ছা….
বাংলা আমার সরষে ইলিশ,চিংড়ি কচি লাউ,
বাংলা পার্শে মাছকে ধুয়ে,
জিরের বাটায় দাও….
পূর্ব পর্বে মাছ ধরার মুগরী নির্মাণের বিবরণ দিয়েছি তাতে স্বভাবত মনে হতেই পারে যারা এই কাজ যাঁরা করছেন তাঁরা প্রতিদিন আর কত টাকা আয় করতে পারে না? না সত্যি সত্যি তাঁরা তেমন কিছু আয় করতে পারেন না। গ্রাম্য খেটে খাওয়া মানুষের ভাষায় বলতে গেলে বসে থাকার থেকে বেগার ঠেলা ছাড়া আর কি ?বস্তুত সব কিছু হিসেব করলে এরা দু টাকা হতে তিন টাকার বেশি রোজ পায় না। তবে চাষবাস যখন শেষ হয় অবসর সময়টা এভাবে কাটিয়ে দেওয়া যায় । এতে সময়টা কেটে যায় আর সঙ্গে কিছুটা আয় হয় ।
এরকম মুগরী শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, গরমকালে যখন মাঠে কাজ থাকেনা…. যখন খুব গরম হয় ,গরমে ঘুম ধরে না …তখন সঙ্গী সাথীদের নিয়ে গল্প করতে করতে মুগরীর কাজ করতে থাকেন।
মুগরী একটি কুটির শিল্প । তথাপি এই শিল্প অংশীদার হিসেবে নির্মিত হয়নি বা এর মধ্যে ফঁড়ে এসে লাভের ভাগ বসায় নি। একেকটি পরিবারে মুগরী তৈরি হয় এবং তাঁরাই হাটে বাজারে বিক্রি করতে যান। সাধারণত আষাঢ় হতে কার্তিক মাস পর্যন্ত মুগরী বিক্রি হয়। কিন্তু মুগরী বিক্রির প্রধান সময় আষাঢ় শ্রাবণ মাস। এই বর্ষাকালে এতই চাহিদা বেড়ে যায় যে এই সময় মুগরী তৈরি না করে গ্রীষ্মকালে বোনা বাড়কে পাতাশে মুগরী করে বাজারে ছাড়ে। পূর্বেই বলেছি এই শিল্পে তেমন লাভ নেই। তবে বাড়ির মেয়েরা এই কাজে যথেষ্ট সাহায্য করে থাকেন। তাই মোটামুটি রোজগন্ডা পুষিয়ে যায়।
মুগরীর আকার হয় বিভিন্ন । সব থেকে ছোট মুগরীর মাপ হল ৫ বান আর সবথেকে বড় মাপের মুগরী হল ১৫ বা ১৬ বান। জলের গভীরতা অনুযায়ী মুগরী ব্যবহার হয়। জল যত গভীর হয় তত বড় মুগরী বসানো হয়।
মুগরী বসাতে হলে দুপাশ দুটি বাড় দিয়ে ঘিরে দিতে হয়। পরে এর মাঝামাঝি জায়গায় মুগরী বসানো হয়।এই বাড়টিও অবশ্য বাঁশ দিয়ে তৈরি , তবে প্রায় সিকি ইঞ্চি বা তার কিছু কম হতে আরম্ভ করে আধ ইঞ্চি চওড়া পর্যন্ত কাঠি তৈরি করে পূর্ব উল্লিখিত ভাবে বিনুনি আকারে বুনেই বাড় প্রস্তুত হয়।
মুগরী, ঘুনি ইত্যাদি মাছ ধরার যন্ত্র পাতার কয়েকটি নিয়ম আছে-
ধান রোয়া সাঙ্গ হলে মাঠে বর্ষার জল জমে যখন মাঠ ভরে ওঠে , সংলগ্ন ডোবা ,পুকুর, নালা, খাল, বিলের থেকে সব রকমের মাছ উঠে আসে ধানের মাঠে।মাঠের সীমানার আল থাকে জলের তলায় ডুবে। ফলে কার মাঠের মাছ কার জমিতে গেল , কে তাকে ধরে খেলো তার কোনো ঠিক থাকে না। এই জমির মাছ গভীর রাতে ঘোরাফেরা করার সময় জমিতে জল বাহিত হয়ে যার মুগরীতে ঢোকে মাছ তারই হয়ে যায়। ঘনঘোর বর্ষার রাতে এই মাঠের মাছের লোভে কেউ কেউ পেখে ( বেত বা তাল পাতার বড় ছাতার মত টুপি) মাথায়, ব্যাটারী লাগানো টর্চ আর ছাকনি জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তাঁদের সন্ধান থাকে কোথায় কোন খালের ধারে কোন নালাটার এখন জল বইবে , সেখানে কেমন মাছেরা ভিড় করতে আসবে।
বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ শ্রাবণের শেষে বা ভাদ্র মাস নাগাদ মাঠের মাছেরা বেশ বড় হয়ে ওঠে। এসময় অমাবস্যা পূর্ণিমায় , কোটালের সময় এক এক মুগরীতে দুসের আড়াই শের মাছ পড়ত। মানে আমি সেই সময়ের কথা বলছি যখন প্রকৃতি জীবিত ছিল, মাঠ, সবুজ ইত্যাদি বেঁচে ছিল।মুগরী সুদ্ধ মাছেদের এনে বড় চুপড়িতে ঢেলে দেওয়ার সময় তাদের লাফালাফি দেখার দৃশ্য যাঁরা দেখেছেন তাঁরা স্মরণ করতে পারলে বড় আপ্লুত হবেন।আমার ভারী লোভ হত বড় বড় চিংড়িগুলো দেখে। সেগুলো আমাকে পিসিরা সেই চিংড়ি ভাতে করে দিতেন। সে এক মজার দিন ছিল…..
মুগরীর বিভিন্ন সাইজ অনুসারে দামও বিভিন্ন হয় , শুধু তাইই নয় , বিশেষ করে অর্থাৎ বর্ষাকালে যখন মাঠ আর খালে মাছ হয় তখন মুগরীর দাম বৃদ্ধি পায়।এই সময় এক একটা ৯ বা ১০ বানের মুগরীর দাম দাঁড়ায় ১০ বা ১২ টাকা দাঁড়ায়। সুতরাং মুগরীর খরচ যখন এক , তখন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লাভের পরিমান কম বেশি হবে।
মুগরীর শিল্পীরা বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করলেও এই শিল্পে প্রতিযোগিতা নেই আর এতে নক্সা করবার মতো অবকাশও নেই। মুগরী শিল্পীরা বর্তমানে আর্থিক সমস্যার জন্যে কাঁচামাল স্বরূপ বাঁশ আনতে বেশি টাকা খরচ করতে পারেন না। বাঁশ সংগ্রহ করতে হয় নারাজোল , জগৎপুর ইত্যাদি অঞ্চল হতে। ওখান থেকে বাঁশগুলোকে মাড় করে ( এক জায়গায় কিছু ক্ষণ বাঁধন দিয়ে) নদীর জলে ভাসিয়ে নিয়ে আসে।
মুগরীর সেরম বিরাট বাজার নেই সেকথা আগেই বলেছি। কোলাঘাট, হাওড়া, হুগলীর গ্রামগুলোর পাশাপাশি সমস্ত হাটেও মুগরী পাওয়া যায় না।কোলাঘাট ও কোলাঘাটের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের হাট বাজারের সংখ্যা প্রায় ১০ টি হলেও , দুধকোমরা, জোতঘনশ্যাম , কোলাঘাট, বেলডাঙ্গা হাটেই মুগরী বিক্রি হয়।
কোনো শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত দিতে হয়। কিন্তু মুগরীর বাজার যেহেতু ব্যাপক নয় তাই এর ভবিষ্যৎ কি বলা মুশকিল।আসলে যতদিন মাঠ, সবুজ, খাল, বিল ,পুকুর এরা বেঁচে থাকবে ততদিন মাছ থাকবে। ততদিন বাঁচবে এই শিল্প। বাঁচবেন একদল মানুষ – যাঁদের ছোট্ট খোকা খুকুরা ঘাড় দুলিয়ে দোলনায় দুলতে দুলতে ছড়া কাটবে –
দুধ ভাত মাছ,
বাঁচি বারোমাস,
যদি করি চাষ
তবেই সুখের বাস….
#সমাপ্ত
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কোলাঘাট : ইতিহাস ও সংস্কৃতি