জেএনইউ তে বিবেকানন্দের মূর্তি ভাঙা নিয়ে বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা চুপ কারণ, বিবেকানন্দের পরিচয়ে হিন্দু হিন্দু গন্ধ। অতএব তার মূর্তি ভাঙ্গা নিয়ে পথে নামলে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ উত্তর কালে বিবেকানন্দের আবির্ভাবের সময় সেই অর্থে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ ছিল না। বরং অধিকাংশ মানুষের মনোভাব ছিল ‘এই বেশ ভাল আছি’। ইসলামি শাসনের দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ম্লান হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের জাগতিক জাঁকজমক সমৃদ্ধ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উন্নত ব্রিটিশ জাতিকে তৎকালীন ভারতীয় শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও অভিজাতবর্গ (যাঁরা সাধারণত দেশ বা সমাজকে নেতৃত্ব দেন) দেবদূত মনে করতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের হাত ধরেই ভারতের উত্থান হবে এরকম অনেকেরই বিশ্বাস ছিল। তাই সেই নবজাগরণ প্রকৃত অর্থে ছিল “ব্রিটিশ সৃষ্ট ও ব্রিটিশের জন্য”।
এরকম অবস্থায় বিবেকানন্দ এক আত্মপরিচয়হীন, বিদেশি ভাবধারার দাসানুদাস, অন্ধ অনুকরণ প্রিয়, পরমুখাপেক্ষী সর্বোপরি আত্মবিস্মৃত জাতিকে আত্মপরিচয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “হিন্দু শব্দে ও মুসলমান শব্দে একই পর্যায়ের পরিচয়কে বোঝায় না। মুসলমান একটি ধর্ম। কিন্তু হিন্দু কোনও বিশেষ ধর্ম নয়। হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম।” বিবেকানন্দ আত্মবিস্মৃত জাতিকে সেই ‘হিন্দু’ পরিচয়ে গর্বিত করেছিলেন। এই হিন্দুত্ব কোনও বিশেষ উপাসনা পদ্ধতিকেন্দ্রিক, গোঁড়া ও কুসস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুত্ব নয়। এই ‘হিন্দুত্ব’-কে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় পর্যন্ত জীবনচর্যা রূপে অভিহিত করেছেন। তাই সন্ন্যাসী হয়েও তিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের প্রেরণা হয়ে ওঠেন। সুভাষচন্দ্র, অরবিন্দ তার রচনা পড়েই স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ পান।
সুভাষচন্দ্র তার ‘তরুণের স্বপ্ন’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন যে, ” বিবেকানন্দের কন্ঠে ‘Freedom is the song of the soul’ এই বাণী সমগ্র দেশবাসীকে উন্মত্ত ও মুগ্ধ প্রায় করিয়া তোলে।” ব্রিটিশ বিরোধী চরমপন্থী নেতৃত্ব লাল-বাল-পাল এর প্রত্যেকে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হন। তৎকালীন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এই সব প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব নিঃসন্দেহে চিন্তনে ও মননে যাদবপুর, জেএনইউ বা ওরকম কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুর্বিনীত ও অর্বাচীনদের থেকে উচ্চকোটির ছিলেন। বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের উপর বিবেকানন্দের এই প্রভাবকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ওকাকুরাকে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষকে জানতে হলে বিবেকানন্দকে দেখুন।’ অর্থাৎ বিবেকানন্দ প্রভাবিত নবজাগরণ ছিল “ভারতীয়দের দ্বারা, ভারতীয়দের জন্য ও ভারতীয়দের”। রবীন্দ্রনাথের কথাকে মান্যতা দিলে বিবেকানন্দ হচ্ছেন একাধারে সনাতন ও আধুনিক এবং স্বাবলম্বী ভারতের প্রতীক। এক কথায় ভারতাত্মার প্রতীক। তিনি শুধু আরএসএস, বিজেপি, বিদ্যার্থী পরিষদ -এর আইকন নন। তাই তাঁর মূর্তি ভাঙা, অশ্লীল কথা লেখা আসলে ভারতাত্মার অপমান, ভারতের বহুত্ববাদী চেতনার উপর আঘাত। অথচ গণতান্ত্রিক উদারতা আমাদের মজ্জাগত হওয়ায় এরকম বহু আঘাত আমাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে।
গণতন্ত্রে বিরোধী মতের পরিসর থাকবেই। কিন্তু এরা আমাদের উদারতার কারণে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমাকে অতিক্রম করে কোনও বিশেষ দল বা সংগঠনের বিরোধিতা করার পরিবর্তে রাষ্ট্রবিরোধিতায় মেতে উঠেছে। ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’, ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদী’ এই হুংকার কিংবা বিবেকানন্দের মূর্তি ভাঙা- এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। এরা যে মতবাদের অনুসারী সেই কমিউনিস্টরা নিজের দেশের ছাত্র আন্দোলন নির্মমভাবে ট্যাংক দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। অথচ এই ছাত্ররা দীর্ঘদিন ধরে গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌরসি পাট্টা জমিয়ে নিরাপদে এই ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী আচরণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা নির্বাক দর্শক।
এই সব অর্বাচীনরা ডেনিম জিন্স, চে- র ছাপ মারা জামা পরে, হাতে কোকের বোতল নিয়ে কে এফ সি চিবোতে চিবোতে বা আইনক্সে সিনেমা দেখতে দেখতে যখন শখের বামপন্থী বুলি আওড়ায় কিংবা প্রকাশ্যে চুম্বনের কথা বলে তখন এরা বিপিএল ভুক্ত হয় না।( মাসে একদিন হলেও ন্যূনতম ৫০০ টাকা খরচ অর্থাৎ প্রায় ২৫ মাসের হোস্টেল ভাড়ার সমান কিন্তু যখন প্রশাসন হোস্টেল ভাড়া বাড়াতে চায় তখন এরা সমান অধিকারের কথা বলে ‘হল্লা বোল’ শুরু করে। (অবশ্য যারা প্রকৃতই দরিদ্র তাদের কথা ভিন্ন)
সাধারণত বিজ্ঞান – প্রযুক্তি , অর্থনীতি, মৌলিক সাহিত্য ও অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ছাত্র- ছাত্রীরা এ ধরনের কার্যকলাপে যুক্ত থাকেন না। ভর্তুকির হোস্টেলে আরামে থেকে-খেয়ে ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বা ‘ইসলামি ইতিহাস’ নিয়ে পড়াশোনা করে ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদীর’ মতো শয়তানি করা যায় এবং বেকার ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া যায় যা বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে থাকে, রুটি রুজির কোনও কাজেই লাগে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মৌলিক সাহিত্য বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করলে ও সব শয়তানি মাথায় আসে না আর আসলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বা ডক্টরেট হওয়াও যায় না। ”ভর্তুকির মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা”-র এক আদর্শ উদাহরণ।
ধনীদের দেওয়া আয়কর নয় বরং শ্রমিক, কৃষক– এর মতো কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষ ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের কেনা সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের মধ্যে যে জিএসটি থাকে সেটাই সরকারের বার্ষিক আয়ের সিংহভাগ। রাজকোষের সেই অর্থ থেকে ভর্তুকি দিয়েই এদেরকে মাত্র ২০ টাকার হোস্টেল ভাড়ায় রাখা হয়। তাই যে কোনও উদার সাধারণ মানুষের তাদেরকে এ প্রশ্ন করার সময় হয়েছে যে রাম মন্দির তৈরি করলে যদি রুটি-রুজির সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে মাত্র ২০ টাকার হোস্টেল ভাড়ায় থেকে ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ পড়ে আর ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদী’ বা ‘প্রকাশ্য চুম্বনের’ মতো গুলতানি করে এরা দেশের রুটি-রুজির কোন সমস্যার সমাধান করছে? এদেরকে খাইয়ে-পরিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী তৈরি করলে সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির কী সমাধান হবে?
মাওবাদীরা যখন নিজেরাই বিচার করে কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয় বা গুলি করে মারে তখন এরা নীরব থাকে। মাইন বিস্ফোরণের মাধ্যমে আধাসেনাদের নির্মম ভাবে হত্যা করলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না, কিন্তু প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে এরা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে মায়াকান্না শুরু করে।
লিঞ্চিং হিন্দু সংস্কৃতির অঙ্গ নয়। পশ্চিমবঙ্গে ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাইয়ে মৃত্যু বা ডাইনি হত্যা (যেখানে একজনকে নিজের সমাজের মানুষই পুড়িয়ে মারে) নিয়ে এরা নীরব যখন তা অবশ্যই নিন্দনীয়। অথচ দেশের অন্য কোথাও সংখ্যালঘু গণধোলাইয়ে মারা গেলে (যা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়) সেটা নিয়ে উদার হিন্দুত্ববাদীদের বদনাম করতে এরা সচেষ্ট।
ইসলামি জিহাদি, নকশাল ও মাওবাদীরা যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না সেটা স্পষ্ট। কিন্তু যে বামপন্থীরা ভোটের রাজনীতিতে অংশ নেয় তারাও একইরকম গণতন্ত্র বিরোধী। যেহেতু তারা রাজনৈতিক ভাবে সংখ্যালঘু সেই জন্য নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে তারা গণতন্ত্রপ্রেমীর ভেক ধরে। কিন্তু যখনই নিজেদের হাতে ক্ষমতা আসে তখনই এদের আসল চেহারা বোঝা যায়।
মাত্র দেড়টি রাজ্যে টানা ৩০-৩৫ বছর ক্ষমতায় থেকে বামপন্থীরা গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল।কোনও সন্দেহ নেই এরা যদি তালেগোলে কখনও সারাদেশে ক্ষমতায় আসে তবে গণতন্ত্র কে চিতায় তুলে সব বিরোধী দল বা সংগঠনের কার্যালয় ট্যাংক দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবে এবং নেতাদের স্তালিনীয় কায়দায় হত্যা করবে। অথচ এরাই এখন রাজ্যপাট হারিয়ে গণতন্ত্র, সহিষ্ণুতা, বহুত্ববাদ সবকিছুই ভারতে বিপন্ন বলে নাকি কান্না কাঁদছে ও যাদের এরা সব সময় গালি দেয় সেই নাৎসি গোয়েবেলস কে আদর্শ করে একই মিথ্যাকে বার বার বলে সত্যি প্রমাণ করতে চাইছে।
যারা বিশ্বের সবথেকে বেশি অগণতান্ত্রিক, অসহিষ্ণু ও স্বৈরাচারী ভাবনার অনুসারী তারাই এদেশে গণতন্ত্রের সব থেকে বড় প্রবক্তার নির্লজ্জ ভূমিকা নিয়েছে। আরও একটি গভীরভাবে অনুধাবনের বিষয় হল ভারতের বাইরে ইসলামি জিহাদি এবং মাওবাদী বা কম্যুনিস্টদের মধ্যে পারস্পরিক অহি-নকুল সম্পর্ক (মাওবাদী চীনাদের অত্যাচারে উইঘুর মুসলমানদের শেষ টান উঠেছে। আবার ইন্দোনেশিয়ায় মুসলিমরা হাজার হাজার কম্যুনিস্টকে হত্যা করেছে।) গণতান্ত্রিক উদারতায় ট্যাঙ্ক পাঠানো বা চিনে উইঘুর মুসলমানদের মগজ ধোলাইয়ের মতো ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ পাঠানো তো দুরের কথা আমরা এদের ন্যূনতম ঘাড় ধাক্কাও দিই না। তাই এদের সাহস আকাশ ছুঁয়েছে। সেজন্য এদের ডানা ছাটার সময় হয়ে এসেছে।
বোধিসত্ত্ব সমাজপতি
মতামত সম্পূর্ণত লেখকের নিজস্ব