দেশজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে প্রবল বিতর্কের মধ্যেই সোমবার সংসদে পেশ হল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। কিন্তু এনআরসির মতই এই নতুন বিলটি কি, তা নিয়ে অনেকেই ধোঁয়াশায়। তারই সুযোগ নিয়ে সংসদের দু’কক্ষেই বিল আটকানোর জন্য মরিয়া বিরোধীরাও। কিন্তু এই বিলের মাধ্যমে আদতে যে জনগণের উপকারই হবে, তা বোঝাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় অভয় বাণী দিয়েছেন বিজেপি, আর এস এস সহ সংঘ পরিবার। আসুন, সংসদে এই বিল পাশ হওয়ার আগেই জেনে নেওয়া যাক বিল সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি. . .
১। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সংক্ষেপে CAB কি?
উ: নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যা বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে আগত সেদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন, শিখ, পার্শীদের অধিকার ভারতবর্ষে সুনিশ্চিত করবে।
২। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা CAB-এর সুবিধা কারা কারা পাবে?
উ: এই আইনের সুবিধা পাবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, জৈন, পার্শীরা।
৩। বাঙালি হিন্দুদের এই আইনে কি উপকার হবে?
উ: বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়ে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই এই আইনের সুবিধা পাবেন। বস্তুত এই আইনের ফলে সব থেকে বেশী লাভবান বাঙালি হিন্দুরাই হবেন। কারন দেশভাগের পরেও বিশাল সংখ্যক হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়ে এদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই বৈধ নাগরিক বলে গণ্য হবেন এই আইন পাশ হলে।
৪। এই আইনে নাগরিকত্বের সুবিধা নিতে গেলে কি আগে নিজেদের শরনার্থী বলে ঘোষণা করতে হবে এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ৬ বছর অপেক্ষা করতে হবে?
উ: না, কখনই এদের নিজেদের শরনার্থী বলে নিজেদের ঘোষনা করতে হবেনা। যারা ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষে ৬ বছরের বেশী আছেন এবং ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৪-এর পূর্বে এসেছেন এবং শেষ এক বছর ভারতবর্ষেই আছেন তারা প্রত্যেকেই এই আইনের সুবিধা পাবেন। হয়ত এমনও হতে পারে যেহেতু ২০১৬ তে প্রথম বার বিল পেশ করার সময় থেকে আরও তিন বছর পার হয়ে গেছে, তাই ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখটিকে আরও বাড়ানোও হতে পারে। বিল পেশ হলে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। কোনও কোনও স্বার্থান্বেষী মহল থেকে এইসব অপপ্রচার করা হচ্ছে।এদের কথার কোনও বিশ্বাস যোগ্যতাই নেই।
৫। যারা বাংলাদেশ থেকে ১৯৭১ সালের আগে ভারতবর্ষে চলে এসেছেন, তাদেরও কি নতুন করে নাগরিকত্বের আবেদন করতে হবে?
উ: না, তারা ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষের নাগরিক বলে স্বীকৃত। এই আইন মূলত যারা ১৯৭১ সালের পরে এসেছেন তাদের জন্য।
৬। ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখটি নিয়ে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে?
উ: কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই ২০১৫ সালে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত অন্য দুটি আইন যেমন – ১৯২০ সালের পাসপোর্ট এক্ট (এন্ট্রি টু ইন্ডিয়া) এবং ১৯৪৬ সালের বিদেশী আইনে পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, জৈন, পার্শী যারা ৩১শে ডিসেম্বর,২০১৪-এর আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে ঘোষণা করেছে যে কোন অবস্থাতেই এদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য করা হবে না।
৭। এই যে বলা হচ্ছে অত্যাচারিত হলে বা অত্যাচারের ভয়ে এদেশে চলে এসেছে যারা। কিন্তু এই অত্যাচার বা অত্যাচারের ভয়ের প্রমান কিভাবে দেওয়া যাবে?
উ: কোন প্রমান চাওয়া হবে না।শুধুমাত্র ফর্মে একটি ঘোষনার কলাম থাকবে, সেখানে উল্লেখ করতে হবে। ভারত সরকার কখনই এই প্রমান চায় না কারন এক্ষেত্রে অপরাধ যা হয়েছে, তা বাংলাদেশ সরকারের আওতাধীন। কাজেই সেই বিচারের ভার বাংলাদেশ সরকারের। যেহেতু ভারত সরকার কোন বিচার করছে না, তাই তারা প্রমান চাইছে না। কিন্তু এই অত্যাচারের ক্ষেত্রটির উল্লেখ এই কারনেই থাকছে, যাতে পরবর্তীতে কোনও স্বার্থান্বেষী মহল যদি আদালতে মামলা করে এই আইন আটকাতে চায়, তখন তা এই আইনের রক্ষাকবচ হবে।
৮। ৬ বছর বসবাসের প্রমান কিভাবে দেওয়া যাবে?
উ: পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেট, আধার কার্ড, পোস্ট আফিসের খাতা, ইলেক্ট্রিক বা ফোন বিল, ব্যাংকের পাশ বই বা অফিসের রেকর্ড সবই প্রমান বলে গণ্য হবে। যদি এসবের কিছু নাও থাকে তাহলে দুই জন পরিচিত যারা ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষের বৈধ নাগরিক তারা আপনার ছয় বছর বসবাসের কথা ফর্মে লিখে দিলেও হবে।
৯। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হলেও আসামের বাঙালিরা এই আইনের সুবিধা পাবেন না?
উ: তাঁরাও পাবেন। কারণ এবারে মূল নাগরিকত্ব আইনটিই সংশোধন করা হচ্ছে এই সংশোধনীর মাধ্যমে।
১০। কোনও কোনও সংবাদ মাধ্যম যে বলছে এই আইন উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রযোজ্য হবে না?
উ: উত্তর পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড অর্থাৎ যে রাজ্যগুলিতে যেতে ইনারলাইন পারমিট লাগে এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের ষষ্ঠ তফশীলভুক্ত অঞ্চলগুলি এই আইনের আওতার বাইরে থাকছে। তা বাদে যে অঞ্চলগুলি অর্থাৎ যে অঞ্চলগুলি বাঙালি প্রধান সেগুলি সবই এই আইনের আওতায় রয়েছে।
১১। তাহলে কি উত্তর পূর্বাঞ্চলের ষষ্ঠ তফশীলভুক্ত অঞ্চলে (প্রঃ ১০) বসবাসকারী হিন্দুরা এই আইনের সুবিধা নিতে পারবেন না?
উ: তাঁরাও পারবেন। তাঁদের অন্য যে অঞ্চলে এই আইন বলবত সেখানকার ঠিকানা থেকে আবেদন করতে হবে।তাদের ভোটার কার্ড সেখানকার হবে।
১২। যাদের এনআরসি-তে নাম ওঠেনি বা যাদের বিরুদ্ধে বর্তমানে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা চলছে তাদের কি হবে?
উ: এই আইন পাশ হলে তাদের বিরুদ্ধে চলা এই সমস্ত মামলাই খারিজ হয়ে যাবে।
১৩। পশ্চিমবঙ্গের কোনও অঞ্চল কি এই আইনের আওতার বাইরে থাকছে?
উ: না, পশ্চিমবঙ্গের কোনও অঞ্চলই এই আইনের আওতার বাইরে থাকছে না।
১৪। আচ্ছা আমি এখন যে কন্যাশ্রীর টাকা পাই বা রেশনে কম দামে চাল পাই, তা কি আমি নাগরিকত্বের আবেদন করলে আর পাব না?
উ: কেন্দ্র সরকার এই আইনে খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে আবেদনকারী ব্যক্তি বর্তমানে যেসব সরকারী অনুদান বা সুবিধা পান সেসবই বজায় থাকবে।কোনভাবেই তা বন্ধ করা যাবে না তিনি নাগরিকত্বের আবেদন করেছেন বলে। অর্থাৎ কন্যাশ্রী বা অন্যান্য অনুদানের টাকা চালু থাকবে।
১৫। আচ্ছা এই আমি এখন নাগরিকত্বের আবেদন করলে কি আমার চাকরি চলে যাবে?
উ: না কখনই যাবে না। এই আইনে শুধুমাত্র আপনার নাগরিকত্বকে বৈধতা দেওয়া হবে। আপনার কোনও অধিকারই কেড়ে নেওয়া হবে না।