১. মল্লিকা একটি উন্নত সংকর জাত:
‘নীলাম’ এবং ‘দশেরী’ জাতের মধ্যে সংকরায়ন করে উদ্ভব হয়েছে ‘মল্লিকা’ (Mallika)। উদ্ভাবন হয়েছিল নিউদিল্লির ‘ইণ্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ থেকে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহনপুর কেন্দ্রে (Mohanpur Center) ‘সর্বভারতীয় সমন্বিত ফল গবেষণা প্রকল্প’ (ICAR-AICRP on Fruits)-এর অধীনে ফল সংক্রান্ত নানান গবেষণা কর্ম সংগঠিত হয়। এই কেন্দ্রের গবেষণা তথ্যে জানা গেছে ‘মল্লিকা’ জাতটি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে অর্থকরী আমচাষের জন্য উপযুক্ত, অতি উত্তম।
মোহনপুর কেন্দ্রটি গাঙ্গেয় নবগঠিত পলিমাটি অঞ্চলের অন্তর্গত। আর্থিক সহায়তার ৭৫ শতাংশ বহন করে ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ। এই কেন্দ্রে একাদিক্রমে ১৫ বছর ব্যাপী আমের বিবিধ জাতের উপর একটি পরীক্ষা করা হয়। কুড়িটি জাতের মধ্যে থেকে সবচাইতে নিয়মিত (Regularity in bearing), অধিক ফলনদায়ী (High yielding behaviour) এবং উৎকৃষ্টমানের (Better qualities) জাতটি ‘মল্লিকা’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এই জাতের ফল স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে সবচেয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য বলেও প্রমাণিত হয়েছে। এই জাতের আমগুলিকে খোসা ছাড়িয়ে কেটেকুটে রেকাবিতে নিয়ে পরিবেশনের যোগ্য (Table Type)। এই জাতে ফলন অন্যান্য জাতের চাইতে আগেই আসে (Precocity in bearing)। কলমের চারা লাগানোর চার বছরের মধ্যেই অর্থকরী ফলন দিতে শুরু করে গাছ। ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে অন্যান্য জাতের তুলনায় মল্লিকা হাইব্রিড আমের শাঁস অধিক দ্রবীভূত ঘন-পদার্থ সমন্বিত (High TSS)। পাকা আমের শাঁসে অম্লত্ব একেবারেই স্বল্প, তাই জাতটি আম-রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷
২. মল্লিকা আমের বৈশিষ্ট্য:
১৫ বছরের বাগিচায় দেখা গেল মল্লিকা জাতের আমগাছের উচ্চতা ৮.৪০ মিটার, গাছের গুঁড়ির গড়-বেড় ৯৮.৫০ সেন্টিমিটার, গাছের পত্রল-বিস্তার ৭.৮৫x৮.১০ মিটার। এ থেকে অনুমান করা যায় এই জাতটি বাগানে রোপণ করলে তা অন্যান্য জাতের তুলনায় মাঝারি-উচ্চ স্বভাবের হবে। ফলের ওজন গড়ে ৩৭৪ গ্রামের কাছাকাছি, বীজের ওজন গোটা আমের প্রায় ১৪ শতাংশ, খোসার ওজন প্রায় ১৬ শতাংশ। প্রতিটি গাছে গড়ে ২২৩ টি আম (১২-১৩ বছরের গাছ) ফলতে দেখা গেছে। ১০x১০ মিটার দূরত্বে লাগিয়ে গাছ প্রতি ফলন পাওয়া গেছিল প্রায় ৮৩ কেজি। TSS-এর মান গড়ে ১৯ ডিগ্রি ব্রিক্স, শাঁসের অম্লত্ব ০.৩১ শতাংশ। TSS:অম্লের অনুপাত প্রায় ৬৩, মোট শর্করার পরিমাণ ১৭.৩১; ফলগুলি ১০ দিন পর্যন্ত তাজা থাকতে সক্ষম বলে জানা গেছে।
কীভাবে মল্লিকা জাতের আম চাষ করবেন?:
সামান্য শুষ্ক আবহাওয়ায় যেমন মল্লিকা ভাল জন্মে, অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলেও তার জন্মাতে অসুবিধা হয় না। পলিমাটি থেকে শুরু করে লাল-কাঁকুরে মাটি, স্বল্প আম্লিক দোঁয়াশ মাটি যেখানে জল জমে থাকে না, তা উপযুক্ত বলে চিহ্নিত। মাটির গভীরতা ২ থেকে ২.৫ মিটার হলেই সেখানে মল্লিকা লাগানো যায়। অ-ক্ষারীয় শিলাময় বা কঙ্কর বা কাঁকুড়ে মাটিতেও মল্লিকা ভালোই ফলন দেয়।
এই জাতের বাগিচা রচনা করতে হলে গ্রীষ্মের মরশুমে ৯০x৯০x৯০ সেন্টিমিটার মাপের একটি গর্ত খুঁড়ে রাখতে হবে। গর্ত থেকে তুলে রাখা উপরস্থ মাটি এবং একটু নিচের দিক থেকে তোলা মাটি পৃথক ঢিপিতে থেকে রোদ-হাওয়া খাইয়ে নিতে হবে। এইভাবে মাটি তুলে পাশে ঢিপি করে রাখতে হবে প্রায় দুই থেকে চার সপ্তাহ আগে, পনেরো দিন থেকে এক মাস আগে। তারপর এই মাটি দিয়েই গাছ লাগানোর সময় গর্ত বুজে দিতে হবে। তোলা মাটির সঙ্গে মেশাতে হবে ২০ কেজি খামার পচা সার (FYM), ৫ কেজি কেঁচোসার (Vermicompost) এবং খানিকটা জীবাণু সার (Biofertilizers) যেমন অ্যাজোস্পাইরিলাম এবং ফসফো-ব্যাক্টেরিয়া। মিশ্রণ ভরাট হয়েও গর্ত পার্শ্বস্থ জমির চাইতে একটু উঁচু থাকবে।
মল্লিকা আমের চারা তৈরি হয় ইনার্চিং বা ভিনিয়ার জোড়-কলম পদ্ধতিতে। তবে ইদানীং এপিকটাইল জোড় অথবা সফ্ট-উড জোড়কলম বেশ গ্রহণযোগ্য এবং সাফল্য-সম্পন্ন বলে জানা গেছে। জোড়-কলমের আদর্শ সময় আগষ্ট মাস। জোড়-বাঁধার জন্য ৮ সেন্টিমিটার মাপের মল্লিকার পরশাখী বা সায়ন (Scion) প্রয়োজন হয়৷ কাঠির আকারের এই পরশাখী বীজ বা গুটিআমের এলাগাছগুলিতে (Rootstock) জুড়ে দিতে হবে ৬ থেকে ৮ সেন্টিমিটার উঁচুতে। এটিই উপযুক্ত উচ্চতা। যেহেতু ওলুর নামক রুটস্টক (Olour Rootstock) গাছের পত্রল বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করে এবং উচ্চতা কমিয়ে দিতে পারে প্রায় অর্ধাংশ এবং ফলনের বিন্দুমাত্র কমতি হয় না, তাই ওলুর জাতের বীজ থেকে তৈরি আঁটির আমগাছ এলাগাছ রূপে উত্তম। অবশ্য নেক্কার জাতের এলাগাছে জোড়-কলম বাঁধলে ফলন বাড়ে।
আমের ক্ষেত্রে দ্বি-বেড়া সারিতে (Double Hedge Row System) গাছ লাগালে বাগিচায় মোট ফলন বেশি হয়। এতে B:C ratio বা খরচের চাইতে বেনিফিট বেশি। মল্লিকার বাগানে প্রথম দিকের বছরগুলিতে নানান স্বল্পমেয়াদী ফসল, শাকসব্জি, ডালশস্য, অর্থকরী ফুল ইত্যাদি লাগানো চলে। পরেও যদি না গাছের ডালপালায় খুব ছায়া হয়, ততক্ষণ খানিক সূর্যালোকিত ফাঁকা স্থানে সাথী-ফসল লাগানো চলে। সাথী-ফসল কী নেওয়া হবে তা নির্ভর করে স্থানীয় জলবায়ু, মাটি এবং বাজারের চাহিদার উপর। প্রথমদিকে শিম্বগোত্রীয় ফসল যেমন ডালশস্য, বরবটি, বীন, শিম্বগোত্রীয় গোখাদ্য চাষ লাভজনক এবং ছায়াসুলভ পরবর্তীকালে আদা-গোত্রীয় হলুদ, আদা অথবা আনারস চাষ হতে পারে। যেখানে অন্য মরশুমে সেচের জলের অপ্রতুলতা, সেখানে বর্ষার মরশুমে মরশুমি সব্জি, ডালশস্য ইত্যাদি নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যেখানে সেচের ব্যবস্থা থাকে সেখানে শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ফসল চাষ করা যায়, এমনকি বহুবর্ষজীবী ফসলও নেওয়া যায়।
চাষের প্রথম কয়েক বছর খড় দিয়ে জমির উপরিভাগ ঢেকে রাখা হয় (Mulching), তাতে আগাছার প্রাদুর্ভাব কমে। পুরোনো বাগানে আগাছা কম, সেখানে গাছের তলায় ভূমিভাগে ছায়া থাকে, যা আগাছা বিস্তারের অনুকূল নয়। পুরোনো বাগানে মাটির মেঝেতে গাছের পরিপক্ব, শুকনো পাতা পড়ে। তাতে একটি জৈবস্তর গড়ে ওঠে, তাও আগাছা বিস্তারে অনুকূল নয়। লাল ল্যাটেরাইট ও কাঁকুড়ে মাটি অঞ্চলে ‘ড্রিপ ইরিগেশন’ বা বিন্দুপাতি সেচের বন্দোবস্ত করা হলে জলের সুষম এবং দক্ষ ব্যবহার সম্ভব। এই পদ্ধতিতে সেচ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অল্প জলেই অনেকটা এলাকা সেচ দেওয়া সম্ভব হয়।
প্রতি বছর প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক গাছে ২৫০ গ্রাম অ্যাজোটোব্যাক্টর, ৫০ কেজি খামারপচা সার দিলে সুপারিশকৃত রাসায়নিক সারের পরিমাণ কিছুটা কম লাগে। এমনকি ৫০% রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে আনা যায়। সুপারিশকৃত রাসায়নিক সারের পরিমাণ এই রকম: নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম যথাক্রমে ১ কেজি, ৫০০ গ্রাম এবং ৭৫০ গ্রাম (প্রতিটি গাছ, প্রতি বছর)।
আমগাছের যত্ন নিতে তার মড়া ডালপালা, কীট ও রোগাক্রান্ত ডালপালা, কমজোরি, দুর্বল, অ-ফলা ডালপালা যেখানে রোদ পায় না, তা ছেঁটে দিতে হবে। একটি ডালের উপর আরেকটি ডালের অবস্থানে যদি ক্রশ বা গুণিতকের মতো হয়, তাও ছেঁটে দিতে হয়। এই ছাঁটাই পর্ব চলতে পারে বার্ষিক আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। কলমের গাছের নীচে রুটস্টক বা এলাগাছ অংশ থেকে বেরোনো স্প্রাউট বা তেউড় ভেঙে দিতে হয়।
মল্লিকার ফল চয়ন করা হয় সকাল ১০ টার আগে অথবা বিকেল চারটের পর, যাতে ফলগুলি সতেজ, পরিপুষ্ট, রসালোভাবে থাকে। এতে ফলের সংরক্ষণকালও বেড়ে যায়। মল্লিকার পরিপক্বতা বিচার করে সঠিক সময়ে চয়ন করে নিতে হবে ফল, যাতে আঘাত না লাগে, সংরক্ষণে সমস্যাও তৈরি না হয়৷
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী