বুধবার ‘বিশ্ব শিরদাঁড়া দিবস’! দ্রোহের বাংলায় বদলেছে শিরদাঁড়ার অভিঘাত, কী ভাবছে এই নাগরিক সমাজ

শিরদাঁড়া বিক্রি নেই। এ এখন এই বাংলায় যাকে বলে ‘হট’ স্লোগান। মঙ্গলবার রাজ্য সরকারের পুজো কার্নিভালে দায়িত্বে থাকার সময়ে যে সরকারি চিকিৎসককে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, তাঁর পরনেও ছিল ‘শিরদাঁড়া বিক্রি নেই’ লেখা টি-শার্ট। সমাপতন। কিন্তু ক্যালেন্ডার বলছে সেই গ্রেফতারির পর দিন বুধবার হল ‘বিশ্ব শিরদাঁড়া দিবস’। মূলত শারীরিক গঠনে শিরদাঁড়ার গুরুত্ব প্রচারের জন্যই ২০১২ সাল থেকে এই দিবস পালন শুরু হয়েছে। শিরদাঁড়ার স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য চলতি বছরের থিম ‘সাপোর্ট ইয়োর স্পাইন’। বঙ্গের এই আন্দোলনের আবহে সমাপতনই বটে!

আরজি কর-কাণ্ড এবং তার জেরে তৈরি দ্রোহের আবহে ‘শিরদাঁড়া’ এখন রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে। সরকার বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই চলে আসছে শরীরের এই বিশেষ অস্থির উল্লেখ। শুরুটা জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযান দিয়ে। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে একটি প্রতীকী শিরদাঁড়া নিয়ে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা। পরে ধর্মতলায় অনশনমঞ্চের সামনে পুলিশকে আক্রমণ করে শিরদাঁড়া নিয়ে স্লোগানও ওঠে। বলা হয়, ‘কলকাতা পুলিশ তোমার নাকি শিরদাঁড়াটা নাই, সে দিন যেটা দিয়ে এলাম বেচে দিলে ভাই!’

What is the impotance of spine in society

তবে সে দিন বিনীতকে প্রতীকী শিরদাঁড়া দেওয়া ঠিক হয়নি বলেই মনে করেন প্রাক্তন আইপিএস অধীর শর্মা। তাঁর কথায়, ‘‘শিরদাঁড়া মানে দায়িত্ব নিয়ে সমাজ নির্মাণ।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা শিরদাঁড়া উপহার দিলেন, তাঁদের বলি, আপনারা যদি সত্যিই সমাজের শিরদাঁড়া সোজা করতে চান, তা হলে নিজেরা রাজনীতিক বা আইপিএস হয়ে ভাল কাজ করে দেখান।’’ অসমের ছাত্র আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল তৈরির উদাহরণ দিয়ে প্রাক্তন আইপিএস অধীর বলেন, ‘‘চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায় তো মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। আপনারাও আসুন। শিরদাঁড়া সোজা রেখে দেখান। তাতেই কাজের কাজ হবে।’’

তবে ‘অরাজনৈতিক’ জুনিয়র ডাক্তাররা শিরদাঁড়া নিয়ে এখনও একই অবস্থানে রয়েছেন। ধর্মতলায় ‘আমরণ অনশনে’ বসা জুনিয়র ডাক্তার রুমেলিকা কুমার বলেন, ‘‘চিকিৎসার পরিভাষায় দেখলে শিরদাঁড়া তো অত্যন্তই গুরুত্বপূর্ণ। তার তো অনেক কাজ। কিন্তু মেটাফোরিক্যালি দেখলে শিরদাঁড়া আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের সত্তা এবং সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বোঝাতেই আমরা শিরদাঁড়ার অনুষঙ্গ টেনে আনি।’’ একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘কিছু মানুষ নিজেদের শিরদাঁড়া বিক্রি না করলে এই ঘটনা ঘটত না। সমাজ অনেক সুন্দর হত। কিছু মানুষের শিরদাঁড়া আছে বলেই আন্দোলনটা এত দিন ধরে চলছে। আবার কিছু মানুষের শিরদাঁড়া নেই বলেই ৬৪ দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হচ্ছে।’’

অধুনা সমাজ যেমন ভাবছে, তেমন বলছে অভিধানও। সংসদ বাংলা অভিধান বলছে, ‘শিরদাঁড়াহীন’ অর্থ ‘দুর্বল, ভীরু’।

What is the impotance of spine in society

আন্দোলনজনিত শিরদাঁড়ার ‘কপিরাইট’ অবশ্য দাবি করতে পারেন কবি শ্রীজাত। যিনি লিখেছিলেন, ‘তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ, তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়’। আরজি কর আন্দোলনের প্রথম পর্বে সেই শ্রীজাত নিজে কেন ‘শিরদাঁড়া’ দেখিয়ে সমর্থন করে রাস্তায় নামছেন না, সেই প্রশ্ন উঠেছিল সমাজমাধ্যমে। তখন নিজের একটি পুরনো কবিতা পোস্ট করেন শ্রীজাত। যার প্রথম লাইন ছিল, ‘যোনি মানে তো চিরে রাখা রাস্তাই একটা, একটা সরু গলিপথ’। তাতেও সমালোচিত হতে হয়েছে কবিকে। তবে ‘বিশ্ব শিরদাঁড়া দিবস’ সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানা যায়নি। বারংবার ফোন করা হলেও শ্রীজাত সাড়া দেননি।

কবি মৃদুল দাশগুপ্ত অবশ্য স্পষ্ট করে জানিয়েছেন ‘শিরদাঁড়া’ শব্দ তাঁকে কী মনে করায়। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে শিরদাঁড়া মানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছুতে প্রতিক্রিয়া জানানো। রাগে বা দুঃখে যা সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে, সেটাই শিরদাঁড়া।’’ নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় আবার একটি শব্দ বলেছেন। তাঁর মননে শিরদাঁড়া মানে ‘আত্মসম্মান।’ আবার অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কাছে শিরদাঁড়া মানে অনেক কিছু। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে শিরদাঁড়ার অর্থ খুব সহজ। শিরদাঁড়া থাকা মানে সত্যি কথা বলা, সত্যকে স্বীকার করা। অন্যায় মেনে না নেওয়া। অন্যায় হলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কখনও আপস না করা। বরাবরই শিরদাঁড়ার মানে এমনই ছিল। আগামীতেও এই অর্থের কোনও পরিবর্তন হবে না।’’

চিকিৎসার পরিভাষায় শিরদাঁড়া আর মস্তিষ্কের যোগের কথা জানাচ্ছেন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তবে পাশাপাশিই তাঁর দাবি, শরীর ও সমাজের ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ সমান গুরুত্বপূর্ণ। সুপর্ণের কথায়, ‘‘শিরদাঁড়া আর মস্তিষ্কের মধ্যে যোগ রয়েছে। মস্তিষ্ক যদি ঠিক থাকে তবে শিরদাঁড়া সোজা রাখা যায়। মস্তিষ্কে ঠিকঠাক অনুভূতি তৈরি হলে সামাজিক ভাবে এবং শারীরিক কাঠামোগত ভাবে এক জন মানুষ সুস্থ থাকবেন।’’ আইনজীবী কল্লোল বসু মনে করেন, ‘‘গোটা দেহটা দাঁড়িয়ে থাকে শিরদাঁড়ার জন্যই। এটাই মানুষের চলচ্ছক্তির উৎস। মানুষের জীবনের যে চলন সভ্যতাকে তৈরি করে তা সহৃদয় সহযোগিতা, নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা নয়। বিবেকহীন লোভের তাড়নায় বাঁচা নয়।’’ কল্লোল এমনও মনে করেন যে, ‘‘পাকস্থলীকেন্দ্রিক জীবনবোধ যদি শেষ কথা হয় তবে অশিক্ষার রাজনীতি শেষ সত্য হয়ে দাঁড়াবে। মানবতা নয়। তাই শিরদাঁড়াকেন্দ্রিক জীবন প্রয়োজন।’’

দ্রোহকালের বাংলায় কিছু দুর্গাপুজোরও ‘থিম’ হয়ে দেখা দিয়েছিল শিরদাঁড়া। তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কিছু পুজো কমিটিকে পিছু হটতেও হয়েছে। তবে ভাবনা থেকে সরে দাঁড়ায়নি কেষ্টপুরের ‘মাস্টারদা স্মৃতি সঙ্ঘ’। তাঁদের পুজোয় ‘সভ্যতার রক্ষাকবচ’ থিমের ভাবনা ছিল শিল্পী মানস রায়ের। প্রশাসনিক বাধা এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানস তাঁর লক্ষ্য বোঝাতে পারেন। বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে মানস বলেন, ‘‘মানুষকে সোজা করে দাঁড় করানোর জন্য শিক্ষাই একমাত্র অস্ত্র। আমি তাই অক্ষর-মুদ্রিত শিরদাঁড়া বানিয়েছিলাম। সেটা বোঝাতে পারায় আমাদের পুজোয় শিরদাঁড়া সোজাই ছিল।’’ একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি মনে করি সমাজের শিরদাঁড়া সোজা রাখতে গেলে ইন্টারনেটে নয়, মুদ্রিত বই পড়ায় আগ্রহ ফেরাতে হবে।’’ মনে করান, মুদ্রিত পুস্তকেও ‘শিরদাঁড়া’ থাকে। বইনির্মাতারা তাকে ‘স্পাইন’ বলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.