এমনিতে দুঃখ বেছে কাঁদার নিয়ম নেই, কিংবা অন্যায় বেছে তবে প্রতিবাদ, তবু রাজনীতি বিষম বস্তু। সেখানে এসব নিয়ম ঘটে ঘ হয়ে যায়! এই যেমন ধরুণ না, উন্নাও ধর্ষণ কান্ডে, হায়দরাবাদের পশু চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন কেঁদেছে! কাঁদাই স্বাভাবিক, গোটা দেশ কাঁদছে। তো আজ উন্নাওয়ে নির্যাতিতার মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করে মমতা টুইটও করেছেন। তিনি লেখেন, ‘নৃশংসতার সীমা নেই!’ ঠিক কথা। হায়দরাবাদে যা হয়েছে তাও ভয়ঙ্কর তা আগেই জানিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তবে যেভাবে অভিযুক্তদের খতম করেছে পুলিশ তাতে আপত্তি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘পুলিশ আইন মেনে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে আদালতে তুলবে, বিচারালয় তার বিচার করবে।’ এইসঙ্গে মহিলাদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পেলে যে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সেকথাও বলেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। তাও তো ঠিক! কিন্তু প্রশ্ন হল, হায়দরাবাদ, উন্নাওয়ের আবহেই নিজের রাজ্যে পর পর ঘটা দু’দুটি ধর্ষণ নিয়ে নিরব কেন সংবেদনশীল মুখ্যমন্ত্রী?
বাংলার মানুষও তো জানেন, একটি ঘটেছে মালদার ইংলিশবাজারে, আরেকটা খোদ মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায়, কালীঘাটে। কালীঘাটের মন্দির চত্ত্বরে বসবাসকারী দুই ভিক্ষাজীবী নাবালিকাকে আদিগঙ্গার কাছে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে কয়েকজন। এবার ভাবুন, কোন দূরে উন্নাও, হায়দরাবাদ, যেখানকার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর মন কাঁদল, টুইট করে সেই কেঁদে ওঠা মনকে ভাষায় প্রকাশও করলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর নিজের রাজ্যে, নিজের শহরে, এমনকী কালীঘাটের তাঁর বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ঘটে যাওয়া নৃশংস অপরাধে কেঁদে উঠল না মন! মন যে কেঁদেছে তার প্রমাণ অন্তত নেই। এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী এখনও অবধি স্পিকটি নট। নবান্ন থেকে ধর্ষকদের ধরতে পুলিশকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানা নেই। ইংলিশবাজার গণধর্ষণ কান্ড নিয়েও এমন কোনো বিবৃতি দেননি, যেমনটা দিয়েছেন ভিনরাজ্যের ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে। তার মানে এমন নয় যে দেশের দূর প্রান্তে মহিলাদের সঙ্গে ঘটা অপরাধে মন কাঁদতে পারে না এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর। নিশ্চয়ই কাঁদতে পারে। এই তো, তেলেঙ্গানা পুলিশের গতকালকের এনকাউন্টারের পর গোটা দেশের সঙ্গে ভালো-মন্দ মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজ্যবাসীও। কিন্তু চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম বলেও তো একটা কথা আছে, মানে ঘর সামলে পর। যে রাজ্যের দায়িত্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই রাজ্যে দু’দুটি গণধর্ষণ ঘটে গেল, তার ন্যায় বিচারে তাঁর কোনও মন্তব্য বা উদ্যোগ নেই, আর তিনি হায়দরাবাদ, উন্নাও নিয়ে কান্না গাইবেন! সেখানে কীভাবে বিচার হবে বা হবে না তার নিদান দেবেন! এটা কী উপযুক্ত দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয়?
তবে ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যে ধর্ষণ ঘটলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন রহস্যময় কারণে কাঁদতে চায় না, সে এতদিনে রাজ্যবাসী জেনে গিয়েছেন। তাই তো পার্কস্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ড হয়ে যায় ‘সাজানো ঘটনা’ বা ‘ছোট ঘটনা’। কাটোয়া ধর্ষণ কাণ্ডে মহিলার উপর যৌন অত্যাচারটা বড় হয় না, বড় হয় ওঠে নির্যাতিতার স্বামীর রাজনৈতিক পরিচয়। মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দেন, ”খোঁজ নিয়ে দেখুন, নির্যাতিতার স্বামী সিপিএম করতেন।” দুর্ভাগ্য, খোঁজ নিয়ে জানা যায় নির্যাতিতার স্বামী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলই করতেন। কামদুনির নৃশংস ধর্ষণের প্রতিবাদে নির্যাতিতার দুই বান্ধবী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অপরাধীদের বিচার চাইলে তাঁদের ‘মাওবাদী’ তকমা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও মারাত্মক কী জানেন?
বুঝে বা না বুঝে ধর্ষণ প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বচন এরকম—“শরীর থাকলে যেমন জ্বর, সর্দি কাশি হয় তেমন ধর্ষণও হয়।” তাই হয়তো ‘চন্দননগরের মাল’ প্রকাশ্য সভায় নোংরা মন্তব্য করেও পার পেয়ে যান। ২০১৪ সালের জুন মাসে ঘটনা। তৎকালীন কৃষ্ণনগরের অভিনেতা সাংসদ তাপস পাল জনসভায় দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি চন্দননগরের মাল। সব সময় মাল নিয়ে ঘুরি। যদি কোনও সিপিএম আমার তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের কোনও রকম হুমকি দেয়। তাহলে তাদের ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেব। রেপ করে চলে যাবে।”
এমন অসভ্য, বর্বর মন্তব্যের পরেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তাপস পালের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি। এই জন্যই শুরুতে বলা হয়েছে, এমনিতে দুঃখ বেছে কাঁদার নিয়ম নেই, কিংবা অন্যায় বেছে প্রতিবাদ, তবু রাজনীতি বিষম বস্তু। সেখানে এসব নিয়ম ঘটে ঘ হয়ে যায়!
মমতাও তাই সময় মতো কখনও সাদা মমতা কখনও বা কালো!