ঢাক বাজছে। মাইকে গান। সিঙ্গুর স্টেশন লাগোয়া লেভেল ক্রসিংয়ের ভিড়ে মোটরবাইকে যুগলদের ঢল। তবে সপ্তমীর সকালের এই ভরপুর উৎসবের আবহেও আলোচনায় তিনি, রতন নভল টাটা। স্বাভাবিক। সম্পর্কচ্ছেদ ঘটলেও রতন টাটা এবং সিঙ্গুর পরস্পরের সঙ্গে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে গিয়েছেন।
রতনের স্বপ্নের ন্যানো প্রকল্পের ঠিকানা হওয়ার কথা ছিল সিঙ্গুর। যে কারখানার ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে যাওয়ার পরেও রতন তাঁর প্রকল্প গুটিয়ে নিয়েছিলেন ২০০৮ সালে। সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ (জমি অধিগ্রহণ আইনে কেউই অনিচ্ছুক হতে পারেন না) কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে কৃষিজমি রক্ষার সেই আন্দোলন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসকে ভিন্ন বাঁকে বইয়ে দিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। সেই জমি আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল নন্দীগ্রাম। যার ‘সাফল্যে’ ভর করে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি বুধবার রাতে রতনের প্রয়াণের পরে শোকপ্রকাশ করে বলেছেন, শিল্প ও বাণিজ্য জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল।
ঘটনাচক্রে, সিঙ্গুর থেকে গুজরাতের সানন্দে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরেও ন্যানো ‘বাণিজ্যসফল’ প্রকল্প হয়নি। কিন্তু সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর যুগন্ধর উদ্যোগীর ছায়া থেকে গিয়েছে। পুজোর মধ্যেও চায়ের দোকান থেকে সাইকেলের গ্যারাজের জটলায় ফিরে ফিরে আসছেন তিনি। কেউ বলছেন, ‘‘স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন রতন টাটা।’’ কেউ বলছেন, ‘‘অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ছেড়ে দিয়ে কারখানাটা হলে লাভই হত।’’ তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিঙ্গুরের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা সবচেয়ে বেশি, স্বভাবতই, পুজো এবং রতন টাটার অনুষঙ্গ নিয়ে। ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর রতন ঘোষণা করেছিলেন, সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প তিনি গুটিয়ে নিচ্ছেন। সেই দিনটা ছিল দুর্গাপুজোর অষ্টমী। বুধবার ছিল দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী। সে দিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন রতন।
সিঙ্গুরের গোপালনগর মৌজায় ১২ কাঠা জমি ছিল অমিয় ধাড়ার। তিনি ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের একজন। যুক্ত হয়েছিলেন কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনে। সেই অমিয় বলছেন, “রতন টাটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল না।” তাঁর কথায়, “আমাদের আন্দোলন কিন্তু টাটার বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে। আমরা চেয়েছিলাম তিন-চার ফসলি জমি বাদ দিয়ে বাকি অংশে কারখানা হোক।” সিঙ্গুর আন্দোলনের একটা পর্বে টাটা-বিরোধিতা ‘উগ্র’ এবং ‘জঙ্গি’ রূপ নিয়েছিল। টাটার পণ্য বয়কটের ডাকও দেওয়া হয়েছিল আন্দোলনকারীদের তরফে। সানাপাড়ার কাছে রাস্তায় ফেলা হয়েছিল কেজি কেজি টাটা সংস্থার লবণ। কিন্তু ১৬ বছরের ব্যবধান পেরিয়ে এসে অমিয় বলছেন, “একটা সময়ে টাটা আর রাজ্য সরকার সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। ফলে আন্দোলনকারীদের একাংশ হয়তো সরকার-বিরোধী ক্ষোভ প্রদর্শনে টাটাদের কঠোর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সেটা সার্বিক ছবি ছিল না।”
সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি মৌজায় দেড় বিঘার মতো জমি ছিল জিয়ারুল হকের। কিন্তু তিনি কারখানা চেয়ে জমি দিতে অনিচ্ছা দেখাননি। তাঁর কথায়, “কারখানা যখন গড়ে উঠছিল, তখনই এই এলাকার চেহারা পাল্টে গিয়েছিল। এখানকার ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু কারখানাটা হয়নি। ছেলেমেয়েগুলোর স্বপ্নও সফল হয়নি। সেই আক্ষেপ সারা জীবন থাকবে।” একটু থেমে জিয়ারুল বলেন, “জমির মায়া করে কী লাভ হয়েছে, তা অবশ্য এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন!”
কিছু বলতে চাইলেন না সিঙ্গুরের মনোরঞ্জন মালিক। নির্মীয়মাণ ন্যানো কারখানার পাঁচিলের ধারে যাঁর কন্যা তাপসীর দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, তাপসীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। সেই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল সিপিএমের সিঙ্গুর জ়োনাল কমিটির তৎকালীন সম্পাদক সুহৃদ দত্ত এবং সিপিএম কর্মী দেবু মালিককে। সিবিআই তদন্তও হয়েছিল। মনোরঞ্জন আর অতীতচারণ করতে চান না। প্রশ্নের জবাবে শুধু বললেন, ‘‘আমার কিছু বলার নেই। আমার তো সমস্তই ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল! আমার আর কোনও কিছু নিয়েই কিছু বলার নেই।’’
সন্দেহ নেই সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতাকে অন্য পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রেও সিঙ্গুর হয়ে উঠেছিল অন্যতম ‘পৃষ্ঠভূমি’। মমতার আন্দোলনের জেরে দেশে ব্রিটিশ জমানার জমি অধিগ্রহণ আইন বদল করতে বাধ্য হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ক্ষমতায় আসার পরে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরত দিয়েছেন মমতা। তবে সে জমির অধিকাংশই আর ‘চাষযোগ্য’ হয়নি বলে দাবি অনেকের। বৃহস্পতিবার সকালে দেখা গেল, যে জমিতে কারখানা গড়ে উঠেছিল, তার অনেকটা জুড়েই শরতের কাশবন। ‘অনিচ্ছুক’ দুধকুমারও মানছেন, ফেরত পাওয়া বিঘে পাঁচেক জমির অধিকাংশই ‘চাষযোগ্য’ করা যায়নি। ‘ইচ্ছুক-‘অনিচ্ছুক’ নির্বিশেষে সকলে বলছেন, কারখানা হলে ভাল হত। তবে পাশাপাশিই ‘গায়ের জোরে’ জমি অধিগ্রহণ করার ক্ষোভ মিলিয়ে যায়নি এখনও।
টাটার কারখানা যখন নির্মীয়মাণ, তখন হুগলির বৈদ্যবাটি থেকে পাউরুটি আর ছানার জিলিপি নিয়ে সিঙ্গুরের কারখানার সামনে বিক্রি করতে যেতেন পরেশ দলুই। তার আগে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। ২০০৫ সালে উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে গিয়েছিল। প্রায় দেড় বছর লেগেছিল সারতে। চিকিৎসক বলে দিয়েছিলেন, ভারী কাজ করা যাবে না। তাই পরেশ তাঁর বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের সিঙ্গুরে যেতেন পাউরুটি-মিষ্টি বিক্রি করতে। তাঁর কথায়, “দেড় বছরের মধ্যে ওই কাজ করে আমি বাড়ির ছাদ ঢালাই দিয়েছিলাম। কারখানাটা হয়ে গেলে কী হত আমি অন্তত জানি।”
কেউ জানেন। কেউ কল্পনা করতে পারেন। কেউ আফসোস করেন। মুম্বইয়ের হাসপাতালে ৮৭ বছরের রতনের মৃত্যুর পর সিঙ্গুরের আনাচকানাচে ফিরে এসেছে ন্যানো প্রকল্পের ‘অকাল বিদায়’। ফিরে এসেছে দুই পুজো। ১৬ বছর আগের সেই পুজোয় প্রকল্প চলে গিয়েছিল সিঙ্গুর থেকে সানন্দে। ১৬ বছর পরের এই পুজোয় চলে গেলেন সেই সিদ্ধান্তের মালিক।
চারদিকে সপ্তমীর উৎসবের আবহ। তার মধ্যেও সিঙ্গুরের বাতাসে ভাসছে অপূর্ণ স্বপ্নের গাথা।