লালবাজারে ‘ছবি বিশ্বাস’, সিবিআই চার্জশিটের পর অনেক কর্তার ডিপি বদলে ‘সত্যমেব জয়তে’র বার্তা!

সত্যমেব জয়তে। সত্যের জয় হবে। এই আপ্তবাক্য এখন কলকাতা পুলিশের একাধিক পদস্থ কর্তার হোয়াট্‌সঅ্যাপ ডিপি। অনেকে ডিপি না বদল করলেও স্টেটাসে দিচ্ছেন সেই পরিচিত ছবি— অশোকস্তম্ভের নীচে লেখা ‘সত্যমেব জয়তে’। ঘটনাচক্রে, এই ছবির বদল ঘটেছে যখন, তার অব্যবহিত আগে আরজি কর-কাণ্ডে সিবিআই চার্জশিট পেশ করেছে। সেই কারণেই প্রশাসনিক মহল এই ছবি বদলকে কাকতালীয় ঘটনা হিসেবে দেখতে চাইছেন না। বরং তাঁদের বক্তব্য, কলকাতা পুলিশের কর্তাদের অভিন্ন এই ছবির প্রদর্শন আসলে ‘বার্তা’। যার মর্মার্থ— সত্যের জয় হবে।

কোন সত্য? যে ‘সত্য’ বলছে, আরজি করের ঘটনায় ‘ঠিক’ লোককেই গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা পুলিশেরই সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। তার পাঁচ দিন পরে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআইয়ের কাছে যায়। ৫৫ দিন পরে সিবিআই গত সোমবার যে চার্জশিট নিম্ন আদালতে পেশ করেছে, তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ধৃত সিভিকই ওই ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় জড়িত। চার্জশিটে সেই সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ এবং নথিও পেশ করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। যা, কলকাতা পুলিশের বাহিনীর কাছে সত্য। অতএব, সত্যমেব জয়তে।

মঙ্গলবার দুপুর থেকেই সিবিআই চার্জশিটের বয়ান প্রকাশ্যে আসতে থাকে। দেখা যায়, তার পর থেকেই কলকাতা পুলিশের একাধিক ডিসি, ওসি, অতিরিক্ত ওসি পদমর্যাদার পুলিশ আধিকারিক তাঁদের ডিপি বদল করেছেন। ক্রমশ সে সংখ্যা বাড়ছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে না বললেও একান্ত আলোচনায় পুলিশকর্তাদের অনেকেই বলছেন, সিবিআই চার্জশিট পেশ করার পরেই তাঁরা এই ছবি দিয়ে বার্তা দিতে চাইছেন যে, নাগরিক সমাজের একাংশ এবং ওই ঘটনায় আন্দোলনকারীরা যে আস্থা এবং বিশ্বাস পুলিশবাহিনীর উপর থেকে হারিয়েছিলেন, সেই ‘বিশ্বাস’ ফিরে আসা উচিত।

তবে একই সঙ্গে কলকাতা পুলিশের একাধিক পদস্থ অফিসার একান্ত আলোচনায় এ-ও মেনে নিচ্ছেন যে, খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় শুধু ধৃত সিভিক জড়িত থাকলেও তদন্তে ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’র কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এক অফিসারের বক্তব্য, ‘‘এমন একটি স্পর্শকাতর ঘটনায় যতটা সতর্ক হয়ে তদন্ত করা উচিত ছিল, প্রথম দিকে তা করা হয়নি। তার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কিন্তু তদন্ত শুরুর সময় কিছু ভ্রান্তি যে হয়েছে, সেটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’ প্রসঙ্গত, সিবিআই-ও তাদের চার্জশিটে তেমন কিছু ‘ত্রুটি’র কথা উল্লেখ করেছে। তার মধ্যে অন্যতম, চিকিৎসক তরুণীর মৃত্যুর ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরে ময়নাতদন্তের কথা।

সিবিআই চার্জশিট পেশ করার পরে প্রত্যাশিত ভাবেই শাসক তৃণমূল ময়দানে নেমে পড়েছে। দলের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাই বলতে শুরু করেছেন, গোড়ায় যে ভাবে কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে ‘ঘৃণা’ ছড়ানো হয়েছিল, অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছিল, তা নস্যাৎ করে দিয়েছে সিবিআইয়ের চার্জশিট। তবে রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের নেতারা যা বলতে পারেন, কলকাতা পুলিশের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর পক্ষে তা সম্ভব নয়। অনেকের মতে, সেই কারণেই ছবির মাধ্যমে বার্তা দিতে চাইছেন লালবাজারের কর্তারা।

আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল ওই সিভিক ভলান্টিয়ারকে। সিবিআই গত সোমবার তাদের প্রথম চার্জশিট পেশ করে জানায়, ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় জড়িত রয়েছেন এক জনই। তিনি ওই সিভিক ভলান্টিয়ার। ঘটনাচক্রে যাকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশই। সিবিআই তদন্তে নেমে ধৃতকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করে। পরে গ্রেফতার করে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে। উল্লেখ্য, সন্দীপকে প্রথমে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তারা ৪৫ পাতার প্রথম চার্জশিটে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে— ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় জড়িত এক জনই। সন্দীপ এবং অভিজিৎ ওই ঘটনার তথ্যপ্রমাণ লোপাটে যুক্ত থাকতে পারেন। তবে সে বিষয়ে প্রথম চার্জশিটে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কথা জানায়নি সিবিআই। তারা বলেছে, ওই বিষয়ে এখনও তদন্ত চলছে।

চার্জশিটে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছিল সিবিআই। যার নেতৃত্বে ছিলেন দিল্লি এমসের ফরেন্সিক মেডিসিনের অধ্যাপক আদর্শ কুমার। পুলিশের একাংশ একান্ত আলোচনায় জানাচ্ছে, সিবিআই চার্জশিটে বলেছে, ময়নাতদন্তেও কোনও ‘অনিয়ম’ হয়নি। তা জানিয়েছে ওই মেডিক্যাল বোর্ড। তবে তার মধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের ‘চাপে’ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। সরানো হয়েছে ডিসি (নর্থ) অভিষেক গুপ্তকেও। সামগ্রিক ভাবে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে কলকাতা পুলিশের বাহিনীকে। সেই কারণেই সিবিআই চার্জশিটের পরে বাহিনীর পদস্থ অফিসারদের একাংশ ‘সত্যমেব জয়তে’ বার্তা দিতে শুরু করেছেন। এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘নানা গুজব রটিয়ে আমাদের গোটা বাহিনী সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কুৎসা করা হয়েছিল। সিবিআই চার্জশিট স্পষ্ট করে দিয়েছে, আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছিলাম। বাকি সত্যও প্রকাশ্যে আসবে। সে বিশ্বাস আমাদের আছে।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.