এরকম একটা প্রবন্ধ যে কোনওদিন লেখবার প্রয়োজন হবে তা-ই আগে ভাবতে পারিনি। এ বাঙালি হিন্দুর দুর্ভাগ্য যে, নিয়তি তাকে এমন পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যখন তাকে লেখনী হাতে নামতে হয় নিজের দুই আরাধ্য দেবতাই যে তার, তা বোঝাতে! যাই হোক, করতে যখন হবেই তখন, করেই ফেলি। প্রবন্ধকার নিজেই এক বাঙালি হিন্দু যখন, তখন তার শৈশব দিয়েই না হয় শুরু করা যাক!
আমার প্রপিতামহী জ্যোতিরিন্দু দেবী প্রয়াত হন আমার চার কি পাঁচ বছর বয়সে, অথর্ব অবস্থায়। উনি একটা খাটে শুয়ে থাকতেন। আমি প্রতিদিন সকালে একবার ওঁর খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। উনি একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বড়নাতির বড়ছেলেকে আদর করতেন। আর, একটা ছোট্ট ছড়া, শুনলেই বোঝা যাবে তা এক মহাকাব্যের সূচনা, বারবার করে তাঁর ছোট্ট পুতিকে শেখাতেন। সেটি ছিল :
“এক দেশে এক রাজা ছিল দশরথ তার নাম
তিনটি রাণী, চারটি ছেলে, বড়টির নাম রাম।”
তা, এই ছিল আমার শ্রীরামের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। কল্পনা করতাম, আমার চাইতে সামান্য বড় একটি বালকের। বাকি গল্প বাবা-মা-ঠাকুর্দা-ঠাকুমার কাছে শুনেছিলাম। সেই বালকের ছবি দেখেছি তারপর অজস্র “ছোটদের রামায়ণ ” আর “ছেলেদের রামায়ণ”-এ।
উপেন্দ্রকিশোর, যোগেন্দ্রনাথ প্রমুখের বইগুলোই ছিল সবথেকে বহুপঠিত। দাদুর কাছ থেকে তাড়কা রাক্ষসী বধের বৃত্তান্ত বারবার শুনতাম। দাদু কক্ষনও কিন্তু শুধু রাম বলতেন না। রামচন্দ্র বলতেন সবসময়। “ঋষি বিশ্বামিত্র এসে দুই ভাইকে নিয়ে গেলেন রাজা দশরথের কাছ থেকে। রামচন্দ্রের তখন কত আর বয়স? মাত্র ষোলো!” — শুনতাম আমরা দুই ভাই। খুব রোমাঞ্চিত হয়ে অপেক্ষা করতাম ইতিমধ্যেই বহুবার শুনে নেওয়া এর পরের ঘটনাগুলোর জন্য। ঠামমার কাছে শিখেছিলাম,
“ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি!
রাম লক্ষ্মণ সাথে আছে করবে আমার কী?”
একা উঠোন পেরোতে ভয় পেতাম সূর্যাস্তের পর। মা বলেছিলেন, ভয় করলেই রামের বা কৃষ্ণের নাম করবি। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না আর। ঠামমা বলেছিলেন মধুদাদার গল্পও। মধসূদন শ্রীকৃষ্ণ। বুঝেছিলাম রাম বা কৃষ্ণ, যে নামেই ডাকো না কেন, সাড়া দেবেন সেই তিনিই! পরাঞ্জপের দুই খণ্ড বিশিষ্ট কমিকস ‘মহাভারত’-এ দেখেছিলাম এবং বারবার দেখতাম সেই “তিনি” কে। সেই ছোটবেলাতেই। তাঁর চার হাত। চার হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম! কত নাম তাঁর! হরি, বিষ্ণু, জনার্দন, কেশব, মাধব, আরও অগুনতি! কত রকমের রূপ তাঁর! মীন, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, রাম, বলরাম, পরশুরাম, বুদ্ধ, কালান্তক কল্কী, এমনকি রূপসী শ্রেষ্ঠা মোহিনী! কোচবিহার রাস উৎসবে মদনমোহনবাড়িতে মা ভবানীর মন্দিরের বারান্দায় পেতলের তৈরি দশাবতার সাজিয়ে রাখা বহু পুরোনো রেওয়াজ। নিয়ম করে দেখতে যেতাম প্রতিবার। মেলার প্রতিদিন। পাড়ায় দোলের সময় হওয়া অষ্টপ্রহর কীর্ত্তনে শুনতাম,
“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”।
রাম আর কৃষ্ণকে আলাদা করা যায়, তাঁরা দুজন একে অপরের থেকে পৃথক হয়ে অবস্থান করতে পারেন, এটাই কখনও মাথাতে আসেনি। এই ত, খুব সম্প্রতি, তা হাতে গোনা কয়েক বছর ধরে কিছু উন্মাদ এবং শয়তানের মুখে এহেন উদ্ভট কথা প্রথম শুনছি! তেমনই, কোনওদিনও মাথায় আসেনি মা কালী / দুর্গার সঙ্গে রামচন্দ্রের বিরোধ থাকতে পারে। খুব ছোটবেলাতেই আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের রান্নাঘরে ক্যালেন্ডারে সেই ছবিটা দেখেছিলাম। রামচন্দ্র হাঁটু গেড়ে মাদুর্গার সামনে বসে। একটা তীর নিয়ে এসেছেন নিজের পদ্মের মতো চোখের কাছে। মাদুর্গা এক হাত বাড়িয়ে তাঁর সেই হাত চেপে ধরছেন।
বড়রা বলেছিলেন ছবিটার গল্প। শ্রীরামচন্দ্র সীতা-উদ্ধারে সাফল্য পাওয়া সুনিশ্চিত করতে পুজো করতে শরণ নিলেন মহামায়া মা দুর্গার৷ দেবী ঠিক করলেন পূজা গ্রহণ করার আগে তিনি তাঁর ভক্তরূপী শ্রীহরিকে পরীক্ষা করবেন। সে অনুযায়ী পুজোর জন্য আনা একশ আট পদ্মের একটিকে তিনি লুকিয়ে রাখলেন। রাম যখন কিছুতেই সেই লুকোনো পদ্মটিকে খুঁজে পেলেন না তখন, নিজের একটি পদ্মাক্ষিকেই উপড়ে মহাশক্তি-মায়ের চরণে নিবেদন করতে উদ্যত হলেন। মা, বলাই বাহুল্য, সন্তানরূপী জনার্দনের ভক্তি দেখে প্রীত হলেন, পুত্রের চোখ রক্ষা করলেন এবং সাফল্যের আশীর্বাদ দিলেন। এত বড় হয়ে এখন শিখতে হচ্ছে, এই মা আর ছেলে নাকি পরস্পরের শত্রু!!! যারা ছেলেকে পুজো করে তারা নাকি মাকে অভক্তি করে! তা, এসব উদ্ভট “তত্ত্ব” বাজারে নামাচ্ছে কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী? বিশ্বাসই বা করছে কারা এবং কেন? এবার দেখা যাক।
২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী সাফল্য ছিল এক চোখ ধাঁধানো ব্যাপার। ১৯৮৪ তে ইন্দিরা-মৃত্যুর সমবেদনা-ঢেউকে কাজে লাগিয়ে, নির্বাচন চলাকালীনই সমস্ত ধরনের মিডিয়াকে নির্লজ্জের মতো ব্যবহার করে, জাতীয় কংগ্রেস [তখন কংগ্রেস (আই)]-এর কাণ্ডারী রাজীব গান্ধী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসেছিলেন ক্ষমতায়। ১৯৮৯-এর সাধারণ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর থেকে এদেশে শুরু হয়েছিল এক বিশ্রী বহুদলীয় খেয়োখেয়ির যুগ। কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছিল না। অজস্র স্থানীয় দল তাদের ক্ষুদ্র আঞ্চলিক ও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে দেশের উন্নতিকে শিকেয় তুলে দিয়েছিল। ওরই মধ্যে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন যতটা পারা যায় জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার। কিন্তু তা অত্যন্ত কঠিন ছিল। অবশেষে জাতীয় স্তরে উঠে এলেন নরেন্দ্র মোদী। ছুঁয়ে ফেললেন এক চিরকালীন,স্বতঃস্ফূর্ত, অথচ দীর্ঘকাল যাবত সুপ্ত এক আবেগকে। আবেগের নাম “হিন্দুত্ব”। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর নিজস্ব সভ্যতা, নিজের আবেগ, নিজের গর্ব। সেই সূত্র যা গোটা ভারতভূমি, যার অপর নাম হিন্দুভূমি,তাকে এক সঙ্গে অতি সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই বাঁধতে সক্ষম। সেই সূত্র, যাকে বারে বারে বহিরাগত শাসকেরা ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছে প্রবল ভয়ে। সেই আদি সূত্র, যার সম্পর্কে হিন্দুদেরকেই সম্পূর্ণ উদাসীন করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী, যারা ভারতীয় হলেও মনে প্রাণে ভারতীয়ত্বকে, হিন্দুত্বকে চিরকাল কেবল ঘৃণাই করে এসেছে। নরেন্দ্র মোদী সেই সুপ্ত কিন্তু অবিনশ্বর আবেগকে জাগিয়ে দিলেন।
হিন্দুকে মনে করিয়ে দিলেন, তুমি পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। বোঝালেন, নিজের অতীত স্মরণ করলে এ জাতির গর্ব হবে। সেই গর্ব ঘটাবে উন্নতি। হিন্দু জেগে উঠল। বহু, বহু কাল পর কেন্দ্রে গঠিত হল এক সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তিশালী সরকার। এবং, আটশ বছর পর, হস্তিনাপুরের সিংহাসন হিন্দুরা ফিরে পেল। ভারতবর্ষে সূচিত হল প্রকৃত স্বাধীন যুগ। আর? আর প্রমাদ গুনল হিন্দু ও হিন্দুস্থানের শত্রুরা। জাগ্রত হিন্দু কী হতে পারে তা স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র দেখিয়েছিলেন তাঁর উপন্যাসে। নরেন্দ্র মোদী বাস্তবে দেখিয়ে দেওয়া শুরু করলেন। ২০১৪ থেকে ২০১৯, একের পর এক দুঃসাহসিক, দেশহিতৈষী পদক্ষেপ করে করে তিনি তখন হিন্দুহৃদয় সম্রাট! হিন্দু নতুন করে শিখল, “আমি হিন্দু” কথাটা গর্বের। লজ্জার নয়। শিখল, সংখ্যালঘুর অনুভূতির মতো তার অনুভূতিরও মূল্য আছে এবং তার অনুভূতির সঙ্গে খেললে যেকোনও রাজনৈতিক দলকে, শাসককে, সে ইচ্ছে করলেই আকাশ থেকে টেনে মাটিতে ফেলে দিতে পারে। ২০১৯এ তাই হিন্দু তার প্রিয় দল ভাজপাকে আরও বেশি শক্তি উপহার দিয়ে ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিয়ে এল। হিন্দু ও হিন্দুস্থান বিরোধী ভাইরাসেরা বুঝল, এখন বাঁচার আর একটিমাত্র উপায়ই রইল। তা হল, এই হিন্দুদের মধ্যে আবার বিভেদ সৃষ্টি করা। এবারে একটু অন্যভাবে। ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, উপাসনা, প্রাদেশিক আবেগ ইত্যাদিকে ভিত্তি করে হিন্দুর সঙ্গে হিন্দুকে লড়িয়ে দেওয়ার এক নীচ, ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু হল। ২০১৯এ নয়, মোদীর প্রথম শাসনকালেই তা শুরু হয়েছিল। ২০১৮য় এই ভাইরাসেরা নির্বাচনী যুদ্ধে মুখ থুবড়ে পড়ার পর সেই ষড়যন্ত্র রূপায়ণে আরও মরিয়া হয়ে উঠল। আর তাই, শ্রীরামচন্দ্রকে বহিরাগত বলে লাগাতার প্রচার শুরু হল।
কিন্তু, দেবসেনাপতি কার্ত্তিকও ত দক্ষিণে যতটা জাঁক জমকের সঙ্গে পূজিত হন, বাংলায় বা ভারতের অন্যত্র ততটা নন। তবে তাঁকে ছেড়ে রামকেই বেছে বেছে কেন এত আক্রমণ? দ্বারকা বা বৃন্দাবনও ত বাংলায় নয় তবে, শ্রীকৃষ্ণকে বহিরাগত না বলে শুধু অবধবিহারী দশরথনন্দনকেই শুধু ‘বাইরের দেবতা’ তকমা দেওয়ার প্রচেষ্টা কেন? একটু তলিয়ে দেখলেই উত্তর পাওয়া যাবে।
হিন্দুপুরাণের পাঠ গভীর না হলে কার্তিকগাথার সঙ্গে খুব গভীর পরিচয় দক্ষিণ ছাড়া ভারতের অন্য কোথাও হিন্দুদের মধ্যে সেভাবে আশা করাটা ভুল। তাঁকে ঘিরে আবেগ তৈরি হওয়া ত অনেক দূরের কথা (আমি কিন্তু এখানে আবেগের কথাই বলছি, বিশুদ্ধ ভক্তির কথা নয়।)কার্তিক তাই হিন্দুবিরোধীদের মাথাব্যথার কারণ নন। তবে শ্রীকৃষ্ণকে আক্রমণ কেন নয়? বলেন কী!আক্রমণ নয়? তাঁকে লম্পট, নীচ, দুশ্চরিত্র ইত্যাদি ‘অভিধা’য় ভূষিত ত নিয়মিতই করে থাকেন হিন্দু হয়েও যা়ঁরা হিন্দুবিরোধী! শিশুপাল একশ’য় থামতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরা ত থামেই না! কিন্তু কই? রামচন্দ্রকে যেভাবে বহিরাগত বলে এঁরা প্রচার করেন শ্রীকৃষ্ণকে ত ততটা নয়! হ্যাঁ, ঠিক কথা। এবার সেটার কারণ দেখা যাক। প্রথমত, শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র সরলরৈখিক নয়। প্রচণ্ড জটিল। এতটাই জটিল যে, তাঁকে কেন্দ্র করে যে-ভক্তি ও –আবেগ, তাকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়াটা কঠিন।
দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রেমধর্মের জন্য স্বভাব-প্রেমিক, প্রকৃতিগত ভাবেই প্রবল আবেগতাড়িত বাঙালির তিনি এতটাই ঘরের লোক যে, হিন্দু নামধারী হিন্দুর শত্রুরা তাঁর বিরূদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রচার চালাতে ভয় পায়। সেক্ষেত্রে নিজের মা-স্ত্রীর কাছ থেকেই প্রবল প্রতিরোধ আসার সম্ভাবনা। সেখানে শ্রীরামচন্দ্র প্রায় সবদিক থেকেই আলাদা–একই ব্যক্তির অবতার হয়েও। চরিত্রটির সারল্য তাঁকে খুব সহজেই এক গণ-আবেগে পরিণত করতে পারে।
আদর্শ বীর, আদর্শ পুত্র, আদর্শ স্বামী, আদর্শ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, এবং, সর্বোপরি এক আদর্শ নেতা ও রাজা। রামায়ণের এই অতি সরল স্টোরিলাইনের মধ্যে পলিটিক্যাল হিন্দুত্ব রেজিমেন্টেশনের রাস্তা খুঁজে পায়। অতি জটিল লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ প্রতিটি ব্যক্তি-হিন্দুর হৃদয়ে রাজত্ব করতে সক্ষম হলেও, সরলরৈখিক মর্যাদাপুরুষোত্তম রামই হিন্দু মাস-কে তাদের আইকন হয়ে উঠে একটি সুসংবদ্ধ পলিটিক্যাল কমিউনিটিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন : কেন, শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ করেননি? কুরুক্ষেত্র পরিচালনা করেননি? কংস প্রমুখ বহু দুরাত্মাকে বধ করেননি? করেছেন। কিন্তু, তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একজন ব্যক্তি। একজন ইনভিনসিবল “ইনডিভিজুয়াল প্লেয়ার”। ধরা দিতে গিয়েও দেন না। সবসময়ই আছেন কিন্তু, কখনওই যেন পুরোপুরি নেই। “স্বয়ং ভগবান” যে! অবতার নন। সেখানে, অবতার শ্রীরামচন্দ্রের আবেদন সমষ্টির কাছে অনেক বেশি। এখন, যেই রেজিমেন্টেশন আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর মূল শক্তি, তা যদি সর্বংসহা বলে পরিচিত হিন্দুধর্মের পালনকারীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তবে সে ত ভয়ানক কথা! ইসলাম বা খ্রিষ্টধর্মের ‘ছায়াতলে’ কেমন করে সেক্ষেত্রে আর এই পৌত্তোলিকদেরকে আনা সম্ভব হবে? দার উল ইসলাম তৈর হবে কেমন করে? এতদিন ত কোনও প্রতিরোধ ছিল না। এই কাফেরগুলো কেউ শিবের পুজো করে, কেউ দুর্গার, কেউ কার্তিকের, কেউ গণেশের . . .!
কেউ বাংলা বলে, কেউ তামিল, কেউ মারাঠি, কেউ তেলুগু, কেউ অসমীয়া, কেউ হিন্দি, কেউ বা অন্য কিছু! তাই খুব সহজেই আলাদা আলাদা করে আক্রমণ ও পরাজিত করা যায়। সেখানে, আমরা “নারায়ে তকদির” বলে একবার চিৎকার করলে সারা বিশ্বে ইসলামের অনুসারী যে যেখানে আছে, অন্য সব ধরনের বিভেদ-পার্থক্য ভুলে তরোয়াল-বোমা-লুঠ করা উড়োজাহাজ ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায় ইসলাম রক্ষার্থে প্রাণ নিতে এবং দিতে! হ্যাঁ, এই রেজিমেনন্টেশন-এর আন্টিডোট, পালটা স্লোগানের অভাব ছিল হিন্দুদের। এখন আর নেই। হিন্দু-ত্রিমূর্তির দ্বিতীয় মূর্তির সপ্তমাবতার, শালপ্রাংশু মহাভূজ অযোধ্যা নরেশের আইকন এখন সেই সামূহিক আবেগের জন্ম দিয়েছে হিন্দুভূমির প্রতিটি হিন্দুর মধ্যে (প্রতিটি হিন্দু নামধারী ব্যক্তির মধ্যে নয় যদিও)– জয় শ্রী রাম! তেত্রিশ কোটি, অর্থাৎ তেত্রিশ স্তরের বহু দেবদেবীর মধ্যে ব্যক্তি হিসেবে আমার ইষ্টদেবতা যেই হোন না কেন, আমার রাজনৈতিক ঐক্যের স্লোগান: “জয় শ্রী রাম “! আর ঠিক এই কারণেই শ্রীরামচন্দ্রকে “অবাঙালির দেবতা” বলে প্রমাণ করার হাস্যকর প্রচেষ্টা। কিন্তু তা কি সম্ভব? না, একেবারেই না। কেন? এবার দেখি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (আজকাল এমনকি বামেরাও এঁকে সেরা বাঙালি মানে) যোগীন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত “সরল কৃত্তিবাস” গ্রন্থের ভূমিকায় (দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৯৫) লিখছেনঃ “বাঙ্গলা দেশে যে এক সময়ে সমস্ত জনসাধারণকে একটা ভক্তির প্লাবনে প্লাবিত করিয়া তুলিয়াছিল; সেই ভক্তিধারার অভিষেকে উচ্চ-নীচ, জ্ঞানী মূর্খ, ধনী দরিদ্র সকলেই, এক আনন্দের মহাযজ্ঞে সম্মিলিত হইয়াছিল — বাঙ্গলা রামায়ণ, বিশেষভাবে, বাঙ্গলাদেশের সেই ভক্তিযুগের সৃষ্টি। বাঙ্গলাদেশে সেই যে, এক সময়ে, একটি নবোৎসাহের নব বসন্ত আসিয়াছিল, সেই উৎসবকালের কাব্যগুলি বাঙ্গালির ছেলে যদি শ্রদ্ধাপূর্বক পাঠ করে, তবে দেশের যথার্থ ইতিহাসকে সজীবভাবে উপলব্ধি করিতে পারিবে।” প্রসঙ্গত, এই “সরল কৃত্তিবাস” বইয়ের প্রচ্ছদে দেওয়া আছে,
“অমৃত মধুর এই সীতা-রাম-লীলা।
শুনিলে পাষাণ গলে, জলে ভাসে শিলা।।”
বাঙালির রামনামে আসক্তির প্রাচীনত্ব খুঁজতে কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ভণিতায় নিজের জন্ম সম্পর্কে কী বলেছেন দেখি। তাঁর বক্তব্য, “আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাসে”, মানে সেই বছরেরই দিন যেদিন মাঘমাসের শেষ দিনটি ছিল রবিবার এবং শ্রীপঞ্চমী তিথি বা সরস্বতী পুজো। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধিও জ্যোতিষ গণনায় তা নির্ণয় করেছেন ১৩৮৬ থেকে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনও এক মাঘী পঞ্চমীতে। তাহলে ব্যাপারটা এমনি দাঁড়াচ্ছে যে, শ্রীরাম পাঁচালীর বঙ্গজীবনে আগমন আজ থেকে অন্ততঃ ছয়শ বছর আগে।
সহজেই অনুমেয় যে, তার আগে থেকেই বাংলার বৌদ্ধিক জগতে সংস্কৃত রামায়ণের চর্চা ছিল বিস্তর এবং, লোককথায় তার বিস্তার ছিল অবাধ। সাধারণ মানুষের মনে শ্রীরাম যদি ইতিমধ্যেই গভীরভাবে প্রবেশ না করে থাকতেন তবে, কৃত্তিবাস এমন কেন লিখলেন? বাঙালি কি ভুলে যাবে, রাণী রাশমণির রঘুবীর-সাধনা? বাঙালি কি ভুলতে পারবে যে, শ্রীরামকৃষ্ণের পিতামহ মাণিকরাম চট্টোপাধ্যায়ের দিন কাটত রঘুবীরেরই সেবায়? এবং তাঁর পিতা ক্ষুদিরাম শ্রীরামচন্দ্রের পূজা না সেরে জলও স্পর্শ করতেন না?
এখন, এসব উদ্দশ্যপ্রণোদিত বামৈস্লামিক ভাষ্য শুনে যদি আমার আপনার মতো প্রতিটি বাঙালিই কৌতুকে হেসেই উড়িয়ে দিত তবে, আজ এই প্রবন্ধেরই কোনও প্রয়োজন পড়ত না। দুঃখের এবং দুশ্চিন্তার এই যে, স্বভাব-আবেগপ্রবণ এই জাতির মনে, গোদের উপর বিষের ফোঁড়ার মতো ১৯৭৭ – ২০১১’র প্রত্যক্ষ, এবং ২০১১ থেকে বর্তমান তারিখের বামভাষ্যের শাসন অনেকক্ষেত্রেই অনেককেই এসব হাস্যকর গল্পকেও গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে প্ররোচিত করে। এই বামেরা ভারতের শত্রু, হিন্দুর শত্রু, এবং চিরকালই মায়াবী। তারা যুগের এবং প্রসঙ্গের প্রয়োজনে বারবার নিজেদেরকে অভিযোজিত করে মারণ জীবাণুদের মতোই। সরাসরি নিজেদের কমিউনিস্ট বললে লোকে প্রথমেই উদ্দেশ্য বুঝে নেবে বলে, ভাষা-সংস্কৃতি-খাদ্যাভ্যাসের আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে কখনও এরা “বাঙালি জাতীয়তাবাদী “, কখনও ” বাংলা পক্ষ”, কখনও তৃণমূল কংগ্রেস, কখনও বা আরও অন্য কিছু। কিন্তু, পোশাক যাই হোক না কেন, এরা আদতে আদি ও অকৃত্রিম ঘৃণ্য বাম। সেই গা ঘিনঘিনে নরকের কীট যারা হিন্দুর সবথেকে বড় শত্রু এবং দার-উল-ইসলামের প্রতিষ্ঠাভিযানের শরিক।
বাঙালিকে তাই নিজের ভালো নিজেকেই বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, শ্রীরামচন্দ্রকে ত্যাগ করলে তারা বৃহত্তর হিন্দুসমাজ ত বটেই, এমনকি নিজের ঐতিহ্য থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। হয়ে যাবে নেকড়েদের সহজ শিকার। তাকে ত্যাগ করতে হবে রামপ্রসাদকে, তার সঙ্গে তার পরমারাধ্যা মাকালীকে। যে মহাকালী স্বয়ং কালকে গলাধঃকরণ করেন, স্বয়ং ভগবান, কৃষ্ণবর্ণ মাধবের মর্যাদাপুরুষোত্তম রূপ শ্রীরামকে তাঁর থেকে আলাদা করবেন কেমন করে? রক্ত আর মাংস–আপনার শরীরকে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করেছেন কখনও, কে বেশি অপরিহার্য তার কাছে? নাকি, এসব রক্তবীজের কাছ থেকে ‘সেরা বাঙালি’র শংসাপত্র নেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্ষুদিরাম, রামতনু লাহিড়ী, শিবরাম চক্রবর্তী প্রমুখ সব্বাইকে অবাঙালি ঘোষণা করে নিজের মন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে তাড়িয়ে দেবেন? “সাধারণ দু চারটে মানুষ” বোঝাতে রাম-শ্যাম-যদু-মধু আর বলবেন না? সর্বনাশ দেখলে নিজের ভেতর থেকে “এ রাম!” বা “এ রামো!” বেরিয়ে এলে আপন গলা টিপে ধরবেন নাকি, এখন থেকে? অথবা, হাওড়ার রাজারামতলায় গিয়ে গোটা এলাকাটাকে উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে চলে যেতে বলবেন?
অতএব, সময় এসেছে, জয় মা কালীর সঙ্গে একই নিঃস্বাসে জয় শ্রীরামও বলার। হিন্দুবিরোধী, বাংলা ও বাঙালি বিরোধী, পেট্রোডলারপুষ্ট আরবি জিহাদি দালালদের মিথ্যা বাঙালিপ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খুলে বলুন, রামও আমার, কালীও আমার। মরুভূমি আমার নয়। আমি বাঙালি। আমি শুধু বাংলা বলি না, বাঙালির ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা ও পালন দুইই করি। একজন ‘বাংলা’ বলা আরবি নামধারী ব্যক্তির চাইতে একজন রামের উপাসক হিন্দিভাষী বিহারী আমার অনেক বেশি আপন। এবার মায়ের পুজোয় তাই একই নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করুন, “জয় মা দুর্গা!”, ” জয় মা কালী!”, “জয় শ্রীরাম”! ” হর হর মহাদেব!”
দেখবেন, হিন্দুর শত্রুরা পালানোর পথ পাচ্ছে না!