ডঃ মেঘনাদ সাহা ও ‘সবই ব্যাদে আছে’

ডঃ মেঘনাদ সাহা অতি উচ্চ মানের পদার্থবিজ্ঞানী — এই নিয়ে কারো শংসাপত্রের প্রয়োজন নেই। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আয়োনাইজেশন নিয়ে তার তত্ত্ব পড়েছি এবং নক্ষত্রদের গঠন ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার প্রয়োগের ব্যাপকতা, এই বাঙালি বিজ্ঞানীর প্রতিভা চিনিয়েছে।
আর যে ব্যক্তি তাঁর সুখ্যাতি নিয়ে প্রশ্ন করবেন, তিনি অতি সহজেই নিজের মুর্খতার অকাট্য প্রমাণ রাখবেন।
‘বেদ’ না পড়েই ‘সবই ব্যাদে আছে’ এই কথাটির পেছনে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ মেঘনাথ সাহা খুঁজে পাননি কিন্তু তিনি এও বলেননি যে বেদে কিছুই নেই। মেঘনাথ সাহা স্বীকার করেছেন যে তিনি সংস্কৃত জানেন না বলে মূল বেদ তিনি পড়েননি এবং তার অনুবাদ পড়েছেন। আর প্রথম জীবনে তিনি ঋকবেদকেই সমগ্র বেদ বলে ভুল করেছিলেন সে কথাও তিনি স্বীকার করেছেন।
সবই বেদে আছে এই কথাটি যেমন ঠিক নয় ঠিক তেমনি বেদ সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন না করে বিজ্ঞানের একটি শাখায় পারদর্শী কোন বিজ্ঞানী যদি দাবি করেন বেদে কিছুই নেই তাহলে সেই কথা থেকে তার অজ্ঞানতাই প্রকাশিত হয়।

আধুনিক পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। এখন প্রচুর গবেষণা হচ্ছে , সেই গবেষণা সম্পর্কে প্রায় ৬৮ বছর আগে প্রয়াত কোন বিজ্ঞানীর ধারণা থাকা সম্ভব নয়।
হিন্দু ধর্মের তথা সনাতন শাস্ত্রের মধ্যে থাকা বিজ্ঞানের গুঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ব্যক্তিরা মেঘনাথ সাহার ‘সবই ব্যাদে আছে’ প্রবন্ধটির উল্লেখ করেন।
কিন্তু ভেবে দেখতে হবে, মেঘনাথ সাহার বেদ ও অন্যান্য সনাতন শাস্ত্র নিয়ে মন্তব্য ও চিন্তন সেইসময়ের ইতিহাস জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। এখন বিজ্ঞানেরই সহায়তায় ইতিহাসের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে।
‘আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্ম’ প্রবন্ধে মেঘনাথ সাহা এই মন্তব্যটি করেছেন— “বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে।”
স্বাভাবিকভাবেই মেঘনাথ সাহা অনিশ্চয়তা নীতির জনক হাইজেনবার্গের উপনিষদ সম্পর্কে শ্রদ্ধার খবর রাখতেন না, পরমাণু বোমার ম্যানহাটন প্রজেক্ট এর কর্ণধার রবার্ট ওপেনহাইমারের ভারতীয় শাস্ত্র সম্পর্কে শ্রদ্ধার কথা জানতেন না। এ তো গেল শ্রদ্ধার কথা কিন্তু প্রমান?
বিগত ৫০ বছরে অনেক কিছু প্রমাণ হয়েছে, যার খবর ডক্টর মেঘনাদ সাহার পাওয়ার কথাই নয়। যেমন গর্ভ উপনিষদে , গর্ভস্থ মানব ভ্রূণের শারীরিক গঠন সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা অনেক পরে পেয়েছেন। শুধু তাই নয় গর্ভ উপনিষদের অনুবাদ করেছে এক জার্মান। ভারতীয় শাস্ত্রের বিজ্ঞান নিয়ে প্রমাণসহ গত ৫০ বছরে প্রচুর স্বনামধন্য বিজ্ঞানীরা গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন।
৫০ বছর আগে ডক্টর মেঘনাদ সাহার ইতিহাস জ্ঞানের এখন পরিবর্তন প্রচুর হয়েছে তার একটা উদাহরণ দিই —- “সুতরাং আশা করি, সমালোচকগণ স্বীকার করিবেন যে, ঋগ্বেদ সংহিতা খৃঃপূঃ ২৫০০ অব্দ হইতে রচিত হইতে আরম্ভ হয় এবং ইহা যেরূপ সমাজের বা সভ্যতার চিত্র অঙ্কিত করিয়াছে, সেই সমাজ ও সভ্যতা হইতে উন্নততর সমাজ ও সভ্যতা পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ( ইজিপ্ট, ইরাক) এবং সম্ভবত এই ভারতবর্ষেও বর্তমান ছিল।” —- বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর এই মন্তব্যটি বিজ্ঞানের আলোকেই এখন ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। যে সরস্বতী নদীর উল্লেখ এবং যে অবস্থার উল্লেখ ঋগ্বেদ সংহিতায় পাওয়া যায় তা কম করেও দশ হাজার বছর আগেকার অবস্থা বলে ইসরো , আই আইটি, বার্ক ইত্যাদি ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করেছে।
ঐ একই প্রবন্ধে ডক্টর মেঘনাদ সাহা বলেছেন “এই সমস্ত ঘটনা হইতে বোধ হয় ধরিয়া লওয়া অসঙ্গত হইবে না যে, প্রাচীন আর্যগণের কোন নিজস্ব বিশিষ্ট লিপি ছিল না; তাহারা বিজেতা হিসাবে যে দেশে গিয়াছেন, সেই দেশের লিপিই গ্রহণ করিয়াছেন।” কিন্তু কমিউনিস্টদের বহুল প্রচারিত ‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ বা ‘আর্যরা বহিরাগত’ — এর কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বরং আর্যরা যে সম্পূর্ণভাবে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অংশে নিজেদের সভ্যতার সূচনা করেছিল তারই প্রমাণ বর্তমান বিজ্ঞান বারেবারে দিচ্ছে।
ডক্টর মেঘনাদ সাহার সমসাময়িক কালে পশ্চিমবঙ্গেরই একজন শিক্ষাবিদ ফলিত জ্যোতিষ ও ও বেদ নিয়ে চর্চা করে বেদকেই ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথম পুস্তক বলে অভিহিত করেন। এবং ডক্টর মেঘনাদ সাহা যে ‘বেদ’কে দুর্বোধ্য বলছেন তার বিভিন্ন শ্লোকের ব্যাখ্যা করে শ্রীমতি গুহ দেখান যে আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক মৌলিক তত্ত্বই বেদে আছে।
স্বাভাবিকভাবে এই যিনি সংস্কৃত জানেন এবং ইংরেজিটাও নিজের চেষ্টায় শিখেছিলেন সেই স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শিক্ষাবিদের ওপরই বিশ্বাসটা বেশি রাখতে হয় যদি বিজ্ঞান ও যুক্তিবোধ কে নিজেদের আত্মীয় বলে ভাবি। বেলাবাসিনী গুহের ‘ঋগ্বেদ ও নক্ষত্র ‘ মেঘনাদ সাহার মৃত্যুর ১১ বছর পর প্রকাশিত হয়। এই ১১ বছরের সময়ের পার্থক্য না থাকলে বাঙালি ‘সবই ব্যাদে আছে’র তির্যক কটূক্তির বদলে ‘বেদে অনেক কিছু আছে’ পেতে পারতো। বিভিন্ন রূপকের আড়ালে সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রের গতি সম্পর্কে বেদে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে বলেছেন।
‘সবই ব্যাদে আছে’ বললেও ডঃ মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে ভারতবর্ষে যে ‘Calender Reform Committee ‘ তৈরি হয়েছিল, তার রিপোর্টে ঋকবেদ ও যজুর্বেদে যে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও কালগণনা সংক্রান্ত তথ্য রূপকের আড়ালে আছে তা বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভারতীয় কালগণনা পদ্ধতিতে যে বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম আসে তা বেদ ও বিভিন্ন ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থ যেমন শতপথ ব্রাহ্মণ , ঐতেরিয় ব্রাহ্মণের বিভিন্ন শ্লোক উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে।বেদাঙ্গ জ্যোতিষকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় কালগণনা পদ্ধতিকে ব্যাখ্যা করেছে ডঃ মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বাধীন কমিটি। সবথেকে বেশি শব্দ খরচ করা হয়েছে ভারতীয় কালগণনা পদ্ধতি নিয়ে আর তার ইতিহাসের জন্য সংস্কৃতে লিখিত শাস্ত্রগুলিকেই ঘাঁটা হয়েছে। কালগণনা ছাড়া বিজ্ঞানের গবেষণা বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান কল্পনা করাই যায় না। তাই ভারতীয় শাস্ত্রে বিজ্ঞানের কোনো মৌলিক তথ্য নেই — এটা বলা ভুল। তাই বেদে সব না থাকলেও একজন বিজ্ঞানীর অন্বেষণের মতো বিষয়বস্তু যে বেদে আছে তা প্রমাণিত। সেই রিপোর্টে বেদের একটি শ্লোকের মধ্যে নিহিত অর্থ বের করার জন্য বাল গঙ্গাধর তিলকের প্রশংসা করা হয়েছে।যে গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার আমরা ব্যবহার করি তাকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলেছেন ডঃ মেঘনাদ সাহা। ডঃ মেঘনাথ সাহার একটা উক্তিকে সামনে রেখে যারা নিজেদের বিজ্ঞানমনস্কতা প্রমাণ করতে চান , তারা কি অবৈজ্ঞানিক ক্যালেন্ডার কে নিজেদের জীবনের অংশ করেন নি ?

ইসরোর প্রাক্তন বিজ্ঞানী ডঃ অনিল নারায়ণন তাঁর ‘The Siamese Manuscript ‘ বইতে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান কিভাবে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাছে ঋণী। এই বইটি সহজলভ্য না হওয়ায় ‘সব বেদে নেই’ তত্ত্বের সমর্থকরা এটি পড়ার সুযোগ পান না তবে ডক্টর নারায়ণনের অনেক প্রবন্ধ সহজেই পাওয়া যায়।
ডঃ মেঘনাথ সাহার শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘হিন্দু রসায়নীবিদ্যা’ বইতে দেখিয়েছেন যে হিন্দুর রসায়ন শাস্ত্রের মধ্যে কি ছিল যা এখনো আমাদের অবাক করে আর কি ছিল না সে কথাও নির্দ্বিধায় বলেছেন। কোন কিছুতে ‘কি নেই’ তা দিয়ে তার বিচার হয় না, বিচার হয় ‘কি আছে’ তা দিয়ে বা কোন কিছুতে ‘সব নেই’ বলেও তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবি করা যায় না।
ডঃ মেঘনাথ সাহা সমকালীন সময়ে উপলব্ধ তথ্য দিয়ে বেদে ও ভারতীয় শাস্ত্রে কি নেই তা অতি সহজেই বলেছেন কিন্তু তাঁর মত মহান বিজ্ঞানী যদি সংস্কৃত জেনে বেদে কি আছে বলতেন তাহলে এই সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরা উপকৃত হতো। যে উপকার পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভারতীয় ও বিদেশীয় ও বিজ্ঞানীরা করেছেন।
একটা কথা মনে রাখতে হবে ইংরেজ আমলে যখন ইংরেজি শিক্ষা ভারতবর্ষে প্রচলনের জন্য ভারতীয়রাই চেষ্টা করছেন তখন কিন্তু প্রচুর ভারতীয় শাস্ত্র যেখানে গণিতের , জ্যোতিষের মূল তত্ত্ব আছে তা বিভিন্ন বিদেশি ‘ভারত তত্ত্ববিদ’ একের পর এক অনুবাদ করছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দী শুধু ভারতের স্বাধীনতা আন্দনের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং উনবিংশ শতাব্দীর আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই সময় প্রচুর ভারতীয় সংস্কৃতে লেখা বইয়ের অনুবাদ হচ্ছে। ভারতবর্ষ থেকে জ্ঞানের এই প্রবাহ কোনকালেই বন্ধ হয়নি। কোন সময় বণিকদের দ্বারা কোন সময় পণ্ডিতদের দ্বারা ভারতীয় জ্ঞান সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বয়ং ডক্টর মেঘনাদ সাহা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের অবৈজ্ঞানিকতা নিয়ে মত প্রকাশ করেছিলেন এবং ভারতবর্ষের হিন্দু কাল গণনা পদ্ধতি নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন। ডঃ রাধেশ্যাম ব্রহ্মচারী ‘হিন্দু কাল গণনা পদ্ধতি’ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের এত বড় আবিষ্কার যার জন্য সারা পৃথিবী এখনো ঋণী তার উৎস খুঁজে পেতে গেলে বেদের শ্লোকেই ফিরে যেতে হয়। শ্রীমতি গুহ ‘ঋকবেদ ও নক্ষত্র সমূহ’ বইতে শ্লোক ধরে ধরে এই কথার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ডক্টর মেঘনাদ সাহা বেদের শ্লোকের অর্থ করে , সেই লোকে কিছু নেই প্রমাণ করেননি বরং দুর্বোধ্য বলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন।ডঃ সাহা নিজের মতামতের জন্য অনুবাদের উপরেই ভরসা রেখেছেন কিন্তু সেকেন্ডারি সোর্সের নিশ্চয়তা নিয়ে ‘বিজ্ঞান’ প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে।
যে কোনো অনুবাদকে প্রশ্নাতীত ধরে নেওয়াকে যুক্তিসম্মত বলা যায় কি ?

ডক্টর সাহা বলেছেন , “মহেঞ্জোদারোর সময় (খৃঃপূঃ ২৫০০ অব্দ) এবং অশোকের সময়ের (খৃঃপূঃ ৩০০ অব্দ) মধ্যবর্তী যুগের ইতিহাস লিখিবার উপাদান এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই, কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই ভারতীয় ধর্ম ও সভ্যতার সমস্ত মূলসূত্র আবিষ্কৃত ও গঠিত হয়।” — লোথাল , কালিবঙ্গান , ঢোলাভিরার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাস কে সন্দেহাতীতভাবে অন্ততপক্ষে ৯ হাজার বছরের প্রাচীন বলে প্রমাণ করেছে। স্বাভাবিকভাবে এই সম্পর্কে ডক্টর মেঘনাদ সাহার জানার কথা নয়।

ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবি সাংবাদিক শিক্ষাবিদ এমনকি বিজ্ঞানীরা চিন্তা অনেকটা সমকালীন প্রচারিত ইতিহাসের উপর নির্ভর করে ।আবার ইতিহাসের জ্ঞান তৎকালীন বিজ্ঞানের আবিষ্কারের উপর নির্ভর করে। যেখানে বিজ্ঞান উত্তর দিতে পারে না সেখানে প্রচারিত সমকালীন ইতিহাসকেই বিজ্ঞানীরা প্রাধান্য দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন বিজ্ঞান ইতিহাসের প্রশ্নগুলোর মীমাংসা করতে শুরু করে তখন বিজ্ঞানীদেরও নিজেদের মতামত পরিবর্তন করতেই হয়। এই ভাবেই বিজ্ঞানী এগিয়ে যায় আর ইতিহাস নিজের ভীতকে মজবুত করে। সনাতন শাস্ত্রের বৈজ্ঞানিকতার ভিড় আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি মজবুত হচ্ছে এবং অতীতের ভ্রান্তি গুলোও দূর হচ্ছে।
ডক্টর মেঘনাদ সাহা কে একজন বেদ বিরোধী বিজ্ঞানী হিসেবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা রোধ করা প্রয়োজন কারণ ডক্টর মেঘনাদ সাহা কে বেদ, জ্যোতিষ , আয়ুর্বেদ সহ বিভিন্ন ভারতীয় শাস্ত্রের অবৈজ্ঞানিকতার সমর্থনকারী একজন বিজ্ঞানী হিসেবে প্রমাণ করতে চাইলে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার গুলোকেই তুচ্ছ করা হয় এবং বিজ্ঞান বিরোধী কাজই করা হয়।
আইনস্টাইন যেমন হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতিকে বেশি আমল দিতে চাননি। এইরকমই বিজ্ঞানী মহলে তাদের মতামতের বিরোধী বিজ্ঞানীদের পাওয়া যায়।
সেই সময়ের ইতিহাস কে সামনে রেখে ডক্টর সাহা নিজের মতামত রেখেছেন। বেদ তথা ভারতীয় শাস্ত্রের অবৈজ্ঞানিকতা নিয়ে তিনি যে মতামত রেখেছেন তাকে দোষী করা যায় না। কিন্তু সেই মতামতকে এখনো ডক্টর সাহাকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা অবশ্যই দোষের কারণ বিগত ৫০ বছরে বিজ্ঞান ভারতীয় শাস্ত্র সম্পর্কে যা যা বলেছে তাকে অবজ্ঞা করা হয়।
বেদে সব নেই কিন্তু বেদে যা আছে তা সেই সময়ে কোথাও ছিল না আর যা ছিল তা তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞান বলার অনেক আগেই ছিল। বেদে যা বলা হয়েছে তা নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই আর শুধু বেদ নয় বিভিন্ন ভারতীয় জ্যোতিষ ও আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই আজ প্রমাণিত আর একইসাথে বিস্ময়ের।
একজন বিজ্ঞানীর বিরূপ সমালোচনাকে হাতিয়ার করার আগে শ্রীমতি গুহের বইটি পড়ে, শ্রীমতি গুহের সমালোচনা করতে পারলে ‘বেদে কিস্যু নেই’ তত্ত্বের সমর্থকেরা অনেকটা বল পেতে পারেন!
পরাধীন ভারতবর্ষে ডঃ মেঘনাথ সাহার মতো বিজ্ঞানী ভারতীয় প্রতিভার যে স্বাক্ষর রেখেছেন তা ইতিহাসে অমলিন হয়েই থাকবে আর তার সাথে তিনি স্বজাতির দুঃখে যেভাবে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাকেও বৃহত্তর শিক্ষার লক্ষণ হিসেবেই বাঙালি চিরকাল দেখবে। কিন্তু তার একটি প্রবন্ধকে হাঁতিয়ার করে সনাতন শাস্ত্রের বৈজ্ঞানিকতা নিয়ে যে কটুক্তি করা হয় তার যথেষ্ট প্রমাণ এখন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরাই দিচ্ছেন।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.