আরজি কর হাসপাতাল থেকে বাঁশদ্রোণী, হাওড়ার ফোরসোর রোড থেকে জয়নগর— গত দু’মাসে জায়গায় জায়গায় জনরোষের মুখে পড়েছে পুলিশ। কোথাও কোথাও সেই ক্ষোভ ‘গণ’ আকার নিচ্ছে। ধারাবাহিক এই ঘটনাপ্রবাহে প্রশাসনের একাংশের মধ্যে জল্পনা তৈরি হয়েছে, পুলিশবাহিনী ‘নরম’ মনোভাব দেখাচ্ছে বলেই কি তাদের ‘সফ্ট টার্গেট’ করে নেওয়া হচ্ছে?
এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন এবং বর্তমান পুলিশকর্তাদের বিভিন্ন যুক্তি এবং ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে সার্বিক ভাবে প্রায় সকলেই মানছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে ‘ক্ষোভ’ ধূমায়িত হয়েছে। নানা আঙ্গিকে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে আরজি কর হাসপাতালে পুলিশকে লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল শৌচাগারে। বাঁশদ্রোণীতে পে লোডারের ধাক্কায় কিশোরের মৃত্যুর পরে ওসিকে কাদাজলের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শনিবার জয়নগরে দেখা গেল পুলিশ ফাঁড়ির সামনে মহিলাদের ঝাঁটাপেটা থেকে নিজেকে ‘বাঁচাতে’ গৃহস্থবাড়িতে ‘আশ্রয়’ নিচ্ছেন পুলিশকর্মী। আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে গত ২৭ অগস্ট ‘ছাত্র সমাজ’ নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিল। অনেকের অভিযোগ, ওই অভিযানের পিছনে রাজ্য বিজেপির ‘প্রত্যক্ষ মদত’ ছিল। সেই অভিযানে আন্দোলনকারীদের ইটের ঘায়ে দেবাশিস চক্রবর্তী নামে এক সার্জেন্ট তাঁর একটি চোখের দৃষ্টি হারাতে বসেছিলেন। শনিবার ধর্মতলার মোড়ে এক পুলিশকর্তাকে ঘিরে ধরে যে ভাবে জুনিয়র ডাক্তারেরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, সেখানেও পুলিশকে ‘অসহায়’ লেগেছে।
অনেকের মতে, পুলিশকে ‘নরম’ থাকতে বলা হয়েছে বলেই পুলিশবাহিনীর বড় অংশ নিজেদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতে পারছে না। প্রশাসনিক মহলের একাংশের মতে, পুলিশ হল প্রশাসনের ‘মুখ’। ফলে পুলিশের উপর যে ক্ষোভ এবং ক্রোধ তৈরি হয়েছে, তা আসলে সরকার এবং শাসকদলের উপর সামগ্রিক ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘এটা মাথায় রাখতে হবে যে, পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র দফতর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। ফলে পুলিশের উপর যে জনরোষ বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাচ্ছে, তা প্রকারান্তরে সরকারের উপরেই ক্ষোভের শামিল।’’
রাজ্য এবং কলকাতা পুলিশের একাধিক অফিসার জানাচ্ছেন, এর কারণ পুলিশবাহিনী ‘কোর পুলিসিং’-এর কাজ করছে না। পুলিশের পরিভাষায় ‘কোর পুলিসিং’ হল বাহিনীর মূল কাজ— অপরাধ ঘটতে না দেওয়া, অপরাধ ঘটলে অভিযুক্তকে দ্রুত হেফাজতে নেওয়া, তদন্ত করা এবং অভিযুক্তকে অপরাধী বলে আইনের চোখে প্রমাণ করা। পাশাপাশিই, আইনশৃঙ্খলা কঠোর হাতে বলবৎ করা। কিন্তু অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারদের একাংশ মনে করছেন, পুলিশ সেই ‘মূল কাজ’ করছে না। তাই সামগ্রিক ভাবে পুলিশকে আর জনতা সমীহের চোখে দেখছে না। কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘পুলিশর কাজ অপরাধ প্রতিরোধ করা। সেটা করতে পারলেই জনগণের আস্থা ফিরবে। কিন্তু আমাদের বাহিনীর অধিকাংশই সেটা করছে না।’’
আরজি কর-কাণ্ডে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। চিকিৎসক তরুণীকে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের চাপে একপ্রকার বাধ্য হয়েই কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে বিনীত গোয়েল এবং ডিসি (নর্থ) অভিষেক গুপ্তকে সরিয়ে দিতে হয়েছে নবান্নকে। তার পরেও দেখা যাচ্ছে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিরাম নেই। বরং পুলিশবাহিনীকে তাড়া করছে জনতা!
কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী মনে করেন, ‘‘নানা কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই এই ঘটনাগুলি ঘটছে বলে মনে হচ্ছে।’’ পুলিশবাহিনী কি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ‘নরম’ হওয়ার ফলেই এমন হচ্ছে? গৌতমমোহনের জবাব, ‘‘আরজি কর-কাণ্ডে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। ওসি গ্রেফতার হয়েছেন। ফলে পুলিশকে নমনীয় থাকতেই হচ্ছে।’’ পাশাপাশি, কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার মনে করছেন, পুজোর আগে পুলিশ কোনও সময়েই ‘কড়া’ মনোভাব দেখাতে চায় না। যাতে বড় কোনও ঘটনা না ঘটে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা যখন চাকরি করতাম, তখনও এটাই ছিল। মনে হত, পুজোটা সকলের শান্তিতে কাটুক। বড় কোনও ঘটনা যাতে না ঘটে।’’
গৌতমমোহনের মতোই হুগলি এবং উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ-প্রশাসনে বড় দায়িত্ব সামলানো এক প্রাক্তন পুলিশকর্তা বলছেন, ‘‘আরজি কর-কাণ্ডের পরে পুলিশের মনোবল তলানিতে চলে গিয়েছে। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে। সেগুলি অসঙ্গতও নয়। আবার উপরের তলার পুলিশকর্তাদের নানা সমীকরণ মেনে কাজ করতে হয়। সেটাও রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব নয়। সে দিক থেকে সামগ্রিক ভাবে পুলিশি ব্যবস্থাই খানিকটা বিপন্ন। বিভিন্ন ঘটনায় সেটা আরও বেশি করে প্রতিফলিত হচ্ছে।’’ অতীতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পরে পুলিশ কিন্তু গুটিয়ে গিয়েছিল। তখন জনমানসে পুলিশ সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল, তাতে পুলিশের আগ্রাসী হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। এখনও তেমনই পুলিশ সম্পর্কে সামগ্রিক ভাবে নেতিবাচক মনোভাবের প্রতিফলন ঘটছে।’’
রাজ্য পুলিশের অন্য এক প্রাক্তন আধিকারিকেরও বক্তব্য, ‘‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় থেকেই পুলিশ দুর্বল হয়ে গিয়েছে। বাম আমলে একটা সময়ে বলা হল, পুলিশ ফুটবল খেলবে। গাছ লাগাবে। কিন্তু এগুলো তো পুলিশের কাজ নয়। পুলিশকে অপরাধীরা সমীহ করবে। যাঁরা আইন মানতে চান, সেই নাগরিকেরা ভরসা করবেন। পুলিশ ফুটবল খেললে বা গাছ লাগালে ফুটবলার আর মালিরা কী করবেন!’’ ওই আধিকারিকের বিশ্লেষণ, ‘‘রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পরে মগরাহাটে একটি ঘটনায় পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছিল। তাতে সম্ভবত দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার পরেই সরকারের তরফে ঘোষণা করা হল, পুলিশ আর গুলি চালাবে না। ফলে জনতা বুঝে গেল, পুলিশ আর লাঠি-গুলি চালাবে না। তার পর থেকে পুলিশকে আর কেউ পাত্তা দেয় না। আগে দু’-এক জন পুলিশকর্মী গিয়ে গ্রাম থেকে অভিযুক্তকে ধরে আনতে পারতেন। কিন্তু সে সব এখন ইতিহাস! আগে থানার বড়বাবু গ্রামে গেলে লোকে জড়সড় হয়ে থাকত। এখন ওসিকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে!’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে পুলিশের কাজ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে দলমতনির্বিশেষে ধরপাকড় করা। কিন্তু বাহিনীর একটা অংশ পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা নিয়ে চললে এই অবস্থা হতে বাধ্য।’’
নন গেজেটেড পুলিশ ইউনিয়নের এক পদাধিকারীর বক্তব্য, ‘‘নিচুতলার পুলিশকর্মীরা দু’দিক থেকেই চাপে। এক দিকে তাঁরা পরিবারে ধিকৃত হচ্ছেন। কাজের জায়গায় চাপের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পরিবারে তৈরি হওয়া মানসিক চাপ। ফলে পুলিশ পুলিশোচিত ভূমিকা নিতে পারছে না।’’ তাঁর আরও অভিমত, ‘‘পুলিশ সম্পর্কে প্রায় সব জমানাতেই ক্ষোভ থাকে। কিন্তু আরজি করের ঘটনার পর সেই ক্ষোভ সংক্রামিত হচ্ছে। পুলিশও সেটা বুঝতে পারছে।’’ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন যদিও এই ঘটনাগুলিকে এক সুতোয় বাঁধতে চান না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বাঁশদ্রোণী বা জয়নগরে যা ঘটেছে, তার সঙ্গে আরজি কর-কাণ্ডকে জুড়ে দেখা ঠিক নয়। সবগুলিই পৃথক পৃথক ঘটনা।’’ তবে তিনি এ-ও বলছেন যে, ‘‘এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছে।’’
শাসক তৃণমূলের একাংশ অবশ্য এই ঘটনাপ্রবাহে ‘পরিচিত এবং সহজ’ অন্তর্ঘাতের তত্ত্ব শোনাচ্ছে। প্রথম সারির এক নেতার কথায়, ‘‘আমার তো পুলিশের কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে, উঁচু তলার কর্তাদের একটা অংশ সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত করছে। পুলিশকে দুর্বল প্রতিপন্ন করে আসলে সরকার সম্পর্কে দুর্বল ধারণা গড়ে তোলা হচ্ছে।’’
যদিও বাহিনীরই একটি অংশের বক্তব্য, ‘কোর পুলিসিং’ না-হওয়ায় ‘অযোগ্য’দের দাম বাড়ছে। অফিসারদের থানায় নিয়োগ হচ্ছে স্থানীয় স্তরে ‘সমঝোতা’র ভিত্তিতে। ফলে তাদের শাসনের ক্ষমতা থাকছে না। রাজ্য পুলিশের এক পদস্থ আধিকারিক খানিকটা হালকা চালেই বলছেন, ‘‘পুলিশে এখন ‘ভাল মানুষ’ আসছে। ‘পুলিশ’ কমে যাচ্ছে! পুলিশের একটা অংশ জেনে গিয়েছে, কিছু না করলেই তারা ‘ভাল মানুষ’ থাকবে। ফলে তারা ‘ভাল মানুষ’ হয়েই থাকছে।’’ পাশাপাশিই তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘এখন নিচুতলার অফিসারেরা নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিলে উপরতলা থেকে তাঁদের সমর্থন করার ঘটনাও আগের চেয়ে কমে এসেছে। বরং নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিলে তিরস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা। ফলে চটজলদি ঘটনাস্থলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতাও কমছে।’’