লাল_সন্ত্রাস – গুলাগ – দেশে দেশে লাল সন্ত্রাস.

তৃতীয় পর্ব

‘গুলাগ’ — কমিউনিজমের নৃশংসতার এক অধ্যায়

মার্ক্সবাদের ‘Theory of surplus’ বলে শ্রমিকের শ্রমের ফলে উৎপন্ন লভাংশ , পুঁজিবাদীর পুঁজির রূপ নেয় আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা লভ্যাংশ বৃদ্ধির জন্য শ্রমিককে নিরন্তর শোষণ করতে থাকে।’সর্বহারার একনায়কত্ব’ নাম নিয়ে যে তন্ত্র বা বলা ভালো যে ‘একনায়ক’ সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করলো তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হওয়ার জন্য কৃষক-শ্রমিককে ভরপেট খাওয়া , পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাভাবিক বাসস্থান , স্বাধীন জীবন পর্যন্ত দেয় নি ; লভ্যাংশের অধিকার সেখানে কল্পনার বাইরে। যেখানে ‘একনায়কত্ব’ থাকে সেখানে ভুল ধরিয়ে দেওয়া প্রাণদণ্ড পাওয়ার মতো অপরাধ।
মার্ক্স যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমালোচনা করে তা থেকে মুক্তির উপায় দিয়েছিল তা দিয়ে শ্রমিকের মুক্তি তো ঘটেই নি বরং পুঁজিপতির জায়গা নিয়েছিল একটা গোটা দেশের শাসনব্যবস্থা। মানুষ কে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক চাহিদা সম্পন্ন জীব হিসেবে দেখা কমিউনিজমের ধ্বজবাহকরা, সোভিয়েত রাশিয়ায় নির্মাণ করেছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবথেকে বড় শ্রম-কারাগার।

‘গুলাগ’ এই শব্দটির মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসকদের নৃশংসতা আর কমিউনিজমের ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে। প্রতিবিপ্লবী , দেশদ্রোহী , গুপ্তচর, নাশকতায় অভিযুক্ত ও রাজনৈতিক বন্দীদের গুলাগের শ্রমশিবিরে অমানবিক পরিস্থিতিতে জোরপূর্বক কাজ করানো হতো। জার্মানিতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আবির্ভাবের অনেক আগেই সোভিয়েত রাশিয়াতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের প্রয়োগ শুরু হয়। লেনিনের আমলেই গুলাগ তৈরি হয় আর স্তালিনের উচ্চাকাঙ্খী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গুলাগ ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
বিভিন্ন দেশে বামপন্থী দলগুলো স্তালিনের ছবিকে সামনে রেখে শ্রমিকদের অধিকারের জন্য মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মানবাধিকারের কথা বলে কারণ তারা জানে ‘গুলাগ’ এর ইতিহাস রাজনৈতিক আলোচনা ও ইতিহাস পাঠক্রমে জায়গা পায় নি বলে সাধারণ মানুষ এই নৃশংসতার ইতিহাস জানে না। মার্ক্সবাদ সমাজকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শোষক ও শোষিত হিসেবে ভাগ করে। আর শোষিতের অধিকার আদায়ের জন্য ‘Dictatorship of Proletariat’ অর্থাৎ ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার কথা বলে। কিন্তু একবার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে , সেই তন্ত্র যে শোষকের জায়গা দখল করবে না এর কোনো নিশ্চয়তা ও যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ মার্ক্সবাদ দেয় না। বরং সোভিয়েত রাশিয়া প্রমাণ করেছে যে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে শ্রমিকের অধিকার দূরের কথা, মানবিক অধিকার পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকে না। আবার যখন স্বৈরাচারী একনায়ক ক্ষমতা দখল করে তখন শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল করে রাখার তাগিদে ও নিজের ব্যক্তিগত মত প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিজমের সমর্থক ও তার সহযোগীদের হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। এমনকি একই লক্ষ্যপূর্তির জন্য সর্বাধিনায়কের থেকে ভিন্ন মত পোষণের জন্য প্রাণ হারানোর উদাহরণ সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রচুর আছে। মার্ক্সবাদ অনুযায়ী সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশেষ শ্রেণীকে ‘শ্রেণী শত্রু’ বলে তাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া জারের পতনের পর থেকেই চলতে থাকে।
সর্বাধিনায়কের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হলেই তাকে ‘শ্রেণী শত্রু’ তকমা দিয়ে দিলে সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার অধিকার একনায়কতন্ত্র দেয় না অর্থাৎ আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো জায়গা থাকে না।
সোভিয়েত রাশিয়ায় শিল্পায়নের গতি ও পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। গুলাগের শ্রমশিবিরের মাধ্যমে স্তালিন সেই প্রয়োজন মিটিয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল সোভিয়েত রাশিয়া কে দরিদ্র, দুর্বল কৃষি অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। স্তালিনের ধারণা ছিল কৃষি সমষ্টি করণের মাধ্যমে যে অর্থাগম হবে তা দিয়ে শিল্পের উন্নতি হবে।যে মার্ক্সবাদ, পুঁজিবাদকে শোষণের যন্ত্র বলেছে সেই মার্ক্সবাদ কে সামনে রেখে একজন ‘একনায়ক’ গোটা রাষ্ট্রকেই আপন লক্ষ্যপূর্তির জন্য বড় পুঁজি সৃষ্টির জন্য কৃষির সমষ্টিকরণ ও বিনামূল্যে বিশাল শ্রমিক বাহিনী পাওয়ার জন্য গুলাগ নামের শ্রম-কারাগার সৃষ্টি করেছিল।

১৯১৭ সালের তথাকথিত অক্টোবর বিপ্লবের পর, লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকারের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে ফেলিক্স এডমুন্ডোভিচ ডজার্জিনস্কি (Felix Edmundovich Dzerzhinsky)।
ডজার্জিনস্কির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো GPU (গোসুদারস্টভেনোয়ে পোলিতিচেস্কোয়ে উপ্রাভলেনিয়ে) বা রাজ্য রাজনৈতিক প্রশাসনের প্রতিষ্ঠা। তবে GPU এর পূর্বসূরি ছিল চেকা (All-Russian Extraordinary Commission for Combating Counter-Revolution and Sabotage), যা ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। চেকা ছিল রাশিয়ান বিপ্লবের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি গোপন পুলিশ সংস্থা, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লব বিরোধীদের দমন করা এবং সোভিয়েত সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। ডজার্জিনস্কি চেকার প্রধান হিসেবে ১৯১৭ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯২২ সালে, চেকাকে বিলুপ্ত করে GPU গঠন করা হয়। এটি মূলত চেকার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ছিল, তবে এর কাঠামো ও কার্যক্রম কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছিল। GPU ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপন পুলিশ সংস্থা যা পরবর্তীতে NKVD এবং KGB এর মতো সংস্থার পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রধান কাজ ছিল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শত্রুদের দমন করা এবং সোভিয়েত রাজনীতির বিরোধীদের নির্মূল করা। GPU কার্যক্রমের অধীনে বিপ্লব বিরোধী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো, যার মধ্যে গ্রেফতার, নির্বাসন, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও অন্তর্ভুক্ত ছিল।


GPU এর সর্বাধিনায়ক Dzerzhinsky , তার উত্তরসূরী Yagoda কে ৪ঠা মে , ১৯২৬ সালে লেখা এক চিঠি থেকে শ্রমশিবিরের পরিকল্পনার আভাস পাওয়া যায় — “Do you not think that the GPU should set up a special penal colony unit, which could be financed with a speciaļ fund from the money confiscated? We could resettle all of these parasites in our most distant and inhospitable regions, in accordance with a preestablished governmental plan.”
১৯২২ সালে সলেভটস্কি দ্বীপপুঞ্জের পাঁচটি দ্বীপে প্রথম বন্দীশিবির তৈরি করা হয়। রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রীষ্টিয় মনেস্টারিগুলির মধ্যে বৃহত্তমটি ছিল এই দ্বীপে। মনেস্টারি থেকে পাদ্রীদের বের করে ‘গুলাগ’ ক্যাম্পের সূচনা হয় এখানে।
রাজনৈতিক বন্দী, জারবাদী সেনাবাহিনীর প্রবীণ অফিসার, যাজকদের এই শ্রমশিবিরে বন্দীদশায় কাটাতে হতো। বন্দীদের মধ্যে যারা সুনজরে থাকতো তারা বন্দী শিবিরের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকতো। সলেভটস্কির বন্দী শিবিরের সাজাপ্রাপ্ত ভারলাম শালামভের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় বন্দীরা নিজেরাই নিজেদের দুইহাত পিছনে বেঁধে রাখার অনুরোধ করতো যাতে পালানোর অভিযোগে তাদের প্রাণ হারাতে না হয়। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দীশিবিরে বন্দীর সংখ্যা বাড়ানোর চাহিদা বাড়তে থাকলো। সলেভটস্কির এই পরীক্ষামূলক বন্দীশিবির পরবর্তীকালের ‘গুলাগ’ শ্রমশিবিরের সূচনা হিসেবে ধরা যায়।
লেনিনের ‘War communism’ এর সময় কৃষকদের থেকে জোরপূর্বক উৎপাদিত খাদ্যশস্য নেওয়ার ফলে সমস্ত সোভিয়েত রাশিয়া জুড়ে বিদ্রোহ দেখা দেয়। স্তালিন নিজের পার্টির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেওয়ার পর ‘চিরশত্রু’ কৃষকদের দিকে মুখ ফেরায়‌।১৯২৮ সালে উৎপাদনের তুলনায় কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য কম সংগ্ৰহ হয়। সংগ্ৰাহক সংস্থাগুলোর অব্যবস্থা, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র দ্বারা তুলনামূলক কম বিনিময় মূল্য ‘কুলাক’দের ( রাশিয়ার কৃষক শ্রেণী) সরকারের খাদ্যশস্য কম সংগ্ৰহের কারণ। স্তালিন একে ‘কুলাক বিদ্রোহ’ হিসেবেই দেখেছিল।সশস্ত্র কমিউনিস্টদের গ্ৰামাঞ্চলে পাঠিয়ে উদ্বৃত্ত লুকানো শস্য সংগ্ৰহের দায়িত্ব দেওয়া হয় আর শাস্তিস্বরূপ বাজার মূল্যের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ দামে শস্য সংগ্ৰহ করা হয় ; সংগ্ৰহের পরিমাণ দ্বিগুণ, তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কৃষকরা পরবর্তী বছরে বীজ রোপনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। স্তালিন কুলাকদের থেকে পরিত্রাণ পেতে দৈত্যাকার যৌথ খামার ব্যবস্থার প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেয়।GPU কাঠ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য আরো বেশি বন্দীর দাবি করে। সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের বিশাল শ্রমশক্তিকে স্তালিন মূলধন হিসেবেই দেখেছিল। দুর্গম অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য সেখানে বসতি স্থাপনের প্রয়োজন ছিল।১৯২৯ সালে পশ্চিম সাইবেরিয়ার নারিম অঞ্চলের ২ লক্ষ ২৫০০০ বর্গকিলোমিটারের পাইন বনে বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। কৃষকদের জমি বাজেয়াপ্ত করে যৌথ খামারে কৃষিজ উৎপাদন, দ্রুত শিল্পায়ন আর কুলাকদের একটা ‘শ্রেণী’ হিসেবে নিশ্চিহ্নকরণ করে সমাজ ও অর্থনীতির এক নৃশংস রূপান্তরের পরিকল্পনা করা হয়। আঞ্চলিক নেতৃত্ব যৌথ খামারের অবাস্তবিক সংখ্যায় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। কুলাকদের বিদ্রোহকে দমন করতে প্রায় ২০ লক্ষ কুলাককে দুর্গম অঞ্চলে নির্বাসিত করা হয় , ৬০ লক্ষ কুলাক ক্ষুধার জ্বালায় মারা যায়। স্তালিন কুলাকদের নিশ্চিহ্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ — কুলাকদের সপরিবারে নির্বাসিত করা হয় এমনকি শাসকদের পক্ষে‌ থাকা কুলাকদের জেলার বাইরে স্থানান্তরিত করা হয়। একটু ধনী কৃষকদের থেকে তাদের শীতের কাপড় , দামি চা, মহিলাদের পোশাক, এমনকি জুতো পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করে তাদের নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩০ সালে প্রায় ২৫ লক্ষ কৃষক প্রায় ১৪০০০ বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনায় অংশ নিয়েছিল। এই ‘কুলাক’রাই স্তালিনের শ্রমশিবিরে বন্দীদের একটা বড় অংশ ছিল।প্রায় ৪০০০০ বন্দী কেম-উখটা সড়ক (Kem- Ukhta) নির্মাণ করেছিল যার ফলে সেই অঞ্চলে কাঠ উৎপাদনে বৃদ্ধি হয়।বোগুচাচিনস্ক রেলওয়ে নির্মাণে নিযুক্ত শ্রমের উৎস ছিল বন্দী শিবিরের ১৫০০০ বন্দী। এই পরিমাণ শ্রমশক্তি আশাতীত ছিল আর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। আর বন্দী কুলাকদের ব্যবস্থিত স্থানান্তরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। বিশাল সংখ্যক বন্দী কুলাকদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাসন, তাদের প্রয়োজনীয় যৎসামান্য খাদ্যসামগ্রী পরিবহণের জন্য ঘোড়া আর ঘোড়ার খাদ্যশস্য পরিবহণ ; পরিবহণের মোট খরচ বাড়িয়ে দিল। রেলের প্রায় বায়ুনিরুদ্ধ , ভীড়ে ঠাসা কামড়াগুলিতে শ্রমশিবিরে জীবন্ত অবস্থায় পৌছানোই ভাগ্যের পরীক্ষা হয়ে গেল।নাজিনো দ্বীপের জনমানবহীন অঞ্চলে যখন বন্দী শ্রমিকদের প্রথম দল পৌঁছাল , না ছিল খাদ্য না ছিল কোনো যন্ত্র। বন্দী শিবিরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নির্মাণের দায়িত্বও ছিল বন্দীদের উপর।প্রথম দিনেই প্রায় ২৯৫ জন বন্দী প্রাণ হারায়। চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে বন্দীদের জন্য যখন সামান্য আঁটা পৌঁছাল ; কেউ নিজের টুপি, কেউ বা নিজের জ্যাকেটে জল দিয়ে আঁটা গুলতে শুরু করলো।খিদের জ্বালায় শুকনো আঁটা খেতে গিয়ে গলায় আটকে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটলো। এমনকি বন্দীদের মধ্যে নরমাংস ভক্ষণের ঘটনাও দেখা গেল।উরালের ৩ লক্ষ বন্দীদের মধ্যে প্রায় ৯২% শ্রমিককে শ্রমশিবির নির্মাণের কাজেই যোগ দিতে হলো।১৯৩২ সালের দিকে বন্দীদের দ্বারা দুর্গম অঞ্চলে বসতি নির্মাণের কাজ বন্ধ করে তাদের বিভিন্ন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টে পাঠানো হলো।১৯৩৩ সালে কুজবাস (Kuzbass) খনিতে কর্মরত শ্রমিকদের ৪৭% ছিল বন্দী শ্রমিক।

স্তালিনের উচ্চাকাঙ্খী পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম ছিল শ্বেত সাগর-বাল্টিক খাল। ১ লক্ষ ২৬০০০ জন বন্দী দিয়ে কাজ শুরু হয় আর আনুমানিক ২৫০০০ বন্দী মারা যায়। ২২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল নির্মাণের জন্য বন্দীদের কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি দেওয়া হয় নি।স্তালিনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা হলেও পরিকল্পিত ব্যবহারের পক্ষে এর গভীরতা অপর্যাপ্ত ছিল। তবুও স্তালিনকে কীর্তিমান হিসেবে দেখানোর কোনো খামতি ছিল না।

রাশিয়ার পূর্বদিকে কলিমা নদীর তীরের অঞ্চল কলিমা। শীতকালের গড় তাপমাত্রা -১৯°c থেকে -৩৮°c থাকে। স্তালিনের গুলাগ ক্যাম্পের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত কলিমা। স্তালিন , কলিমার সোনার খনিকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস হিসেবে দেখছিল।বন্দীদের অনেকেই অত্যন্ত দুর্গম এই অঞ্চলে পৌঁছানোর আগেই মারা যেত। যারা জীবন্ত অবস্থায় কলিমায় পৌঁছাতো তাদের জীবন, মৃত্যুর থেকেও ভয়াবহ হতো।

১৯৩৮ সালে ইউক্রেনের গণিতজ্ঞ মিখাইল ক্র্যাভচুকের শেষ নিবন্ধ যখন প্রকাশিত হচ্ছে সেই সময় তিনি গুলাগের ক্যাম্পে বন্দীদশা কাটাচ্ছেন । নিজের জন্মস্থান থেকে ৪০০০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব সাইবেরিয়ায় কলিমার বন্দী শিবিরে কঠোর শ্রম, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খাবার আর অত্যধিক খারাপ আবহাওয়া এই গণিতজ্ঞের প্রাণ কেড়ে নেয়।
বন্দীদের দ্বারা নির্মিত কলিমা হাইওয়ে ‘Road of bones’ নামে পরিচিতি লাভ করে।১৯৩২ সালে কলিমা গুলাগ ক্যাম্প ১০ জন বন্দী নিয়ে শুরু হয়েছিল , সাত বছর পর ১৯৩৯ সালে বন্দীর সংখ্যা হয় প্রায় ১ লক্ষ ৩৮০০০। গুলাগ-ফেরৎ রাশিয়ার লেখক ভারলাম শালামভ (Varlam Shalamov) গুলাগের শ্রমশিবিরে নিজের কষ্টের দিনগুলো স্মরণ করে লেখেন — “All human emotions—love, friendship, envy, concern for one’s fellow man, compassion, longing for fame, honesty—had left us with the flesh that had melted from our bodies….”(Kolyma Tales)।
গুলাগ থেকে জীবন বাঁচিয়ে ফিরে আসা এরকম আরো অনেক লেখকের আত্মজীবনী থেকে কলিমার বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা জানা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের দ্বারা মানুষের উপর এই অত্যাচার মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। রোমানিয় লেখক মাইকেল সলোমনের আত্মজীবনী ‘Magdan’ , আজারবাইজানীয় লেখক আয়ুব বাগিরভ ‘Bitter days of Kolyma’ তে সাইবেরিয়ায় ট্রেনে যাত্রা প্রসঙ্গে লেখেন — “The terrible heat, the lack of fresh air, the unbearable overcrowded conditions all exhausted us. We were all half starved. Some of the elderly prisoners, who had become so weak and emaciated, died along the way. Their corpses were left abandoned alongside the railroad tracks.” স্তালিনের জন্য গান না লেখার অপরাধে গায়ক ভাদিম কোজিন ১৯৪৫ সালে কলিমার গুলাগে বন্দী হন। পরবর্তীকালে মাগদান শহরে নির্বাসিত হন । ‘Gold – Lost in Siberia ‘ টিভি শো তে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কোজিন স্মরণ করেন — ইয়াল্টা সম্মেলনে চার্চিল বিখ্যাত গায়ক কোজিনের গান শুনতে চাইলে তাকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক স্তরে স্তালিনের কুকীর্তি ঢাকতে।গুলাগ-ফেরৎ চিত্রশিল্পী শব্দের পরিবর্তে ছবি দিয়ে কলিমা গুলাগের ভয়াবহতা জনসমক্ষে এনেছিলেন।তার কথায় — “Some may say that the Gulag is a forgotten part of history and that we do not need to be reminded. But I have witnessed monstrous crimes. It is not too late to talk about them and reveal them. It is essential to do so. Some have expressed fear on seeing some of my paintings that I might end up in Kolyma again—this time for good. But the people must be reminded… of one of the harshest acts of political repression in the Soviet Union. My paintings may help achieve this.” ।

১৯৩০ সালে ছোটখাটো দোকানদার, হাতের কাজ করে স্বাধীন আয়ের মাধ্যমে বেঁচে থাকা মানুষদের ‘সামাজিকভাবে অবাঞ্ছিত’ , ‘সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন’ হিসেবে অভিযুক্ত করে অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দেওয়া হয় , তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে যৌথ খামার ব্যবস্থা ও শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করাই উদ্দেশ্য ছিল।ফলে লক্ষ লক্ষ কৃষকের গ্ৰাম ছেড়ে শহরে পলায়ন শুরু হল অর্থাৎ ‘পরিযায়ী কৃষক’ এর জন্ম দিল স্তালিনের ‘সোভিয়েত রাশিয়া’। শুধু মস্কো আর লেনিনগ্ৰাদকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩৫ লক্ষ কৃষকের ভীড়ে শহরের জনজীবন স্তব্ধ হওয়ার
উপক্রম। বিভিন্ন ধরনের সরকারি প্রকল্পে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হলো। কলকারখানাগুলো উদ্বাস্তু শিবিরে পরিণত হতে লাগলো। উপায় হিসেবে ২৭ শে ডিসেম্বর, ১৯৩২ সালে দেশের ভেতরেই পাসপোর্টের ব্যবস্থা চালু করা হয়।সমস্ত শহরকে ‘Closed’ আর ‘Open’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাসপোর্ট ব্যবস্থার ফলে দুইমাসের মধ্যেই মস্কোর জনসংখ্যা ৬০০০০ কমিয়ে ফেলা হয় , লেনিনগ্ৰাদে ৫৪০০০ মানুষকে গ্ৰামমুখী করা হয়।১৯৩৩ এর জুন-জুলাই মাসে ৫৪৭০ জন জিপ্সিকে মস্কোতে বন্দী করে সাইবেরিয়ার শ্রমশিবিরে পাঠানো হয়। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে স্বামী-স্ত্রী সিনেমা দেখতে বেরিয়েছেন আর সাথে সঠিক কাগজপত্র না থাকার জন্য স্বামীটিকে পুলিশ গ্ৰেফতার করেছে, এক বোন তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ভুল স্টেশনে নেমে যাওয়ার জন্য তাকে গ্ৰেফতার ও নির্বাসিত হতে হয় — আত্মপক্ষ সমর্থনের নামমাত্র সুযোগ নেই , এতো সময় নষ্ট করার মতো সময় কোথাই কমিউনিস্ট রাশিয়ার ?
এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্কদের পর্যন্ত ছাড় ছিল না সাম্যবাদী রাশিয়ায় ‌। ১৯৩৫ থেকে ৩৯ পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ৫৫০০০ কিশোর-কিশোরীকে গুপ্ত পুলিশ বাহিনী NKVD এর শ্রমশিবিরে পাঠানো হয়। প্রসঙ্গত ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর নাম GPU থেকে পরিবর্তন করে NKVD রাখা হয়।
‘গুলাগ’ ক্যাম্পে ১৯৩৫ সালে যেখানে ৯ লক্ষ ৬৫০০০ বন্দী শ্রমিক ছিল, ১৯৪১ তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ লক্ষ ৩০০০ এ। ইয়েজহভের পর বেরিয়া NKVD এর প্রধান হলে দৈনিক ১১ ঘন্টার কাজ বাধ্যতামূলক করে। আজ যখন বিভিন্ন দেশে শ্রমিক স্বার্থরক্ষার জন্য বামপন্থীরা কুমিরের কান্না কাঁদেন তখন তাদের সোভিয়েত রাশিয়ার ‘গুলাগ’ ক্যাম্পে শ্রমিকদের ইতিহাস মনে করিয়ে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে হয়।
২৪ অগাস্ট, ১৯৩৯ সালে নাৎসী জার্মানি আর কমিউনিস্ট রাশিয়ার মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি হলে ‘গুলাগ’ ক্যাম্পে বন্দীর সংখ্যা বাড়ার এক অন্য পথ খুলে যায়। সোভিয়েত সেনা পোল্যান্ডে ঢুকে পোলিশ সেনাকে বিধ্বস্ত করে ২ লক্ষ ৩০০০০ যুদ্ধবন্দী পায় যার মধ্যে ১৯৪১ আসতে আসতে ৮২০০০ বেঁচে থাকে। মোট ৩ লক্ষ ৮১০০০ পোলিশ নাগরিককে ‘বিশেষভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ’ হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের ‘গুলাগ’ ক্যাম্পে স্থানান্তরিত করে। ১৯৪৩ সালে সোভিয়েত সেনা সরে গেলে, জার্মান সেনা Katyn এর জঙ্গলে প্রায় ১৪০০০ পোলিশ অফিসরের শবদেহ খুঁজে পায়। সোভিয়েত রাশিয়া সেইসময় অস্বীকার করলেও ১৯৪০ সালের এই গণহত্যা, ১৯৯২ সালে এসে রাশিয়ান সরকার সম্পূর্ণভাবে এই গণহত্যার দায় স্বীকার করে।
পোল্যান্ডের দখল নেওয়ার পর বাল্টিক দেশগুলোতে নিজের ঘাঁটি স্থাপন করে রাশিয়া।এস্টোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মস্কোতে ডেকে ‘mutual assistant treaties’ এ সই করিয়ে রাশিয়াকে তাদের দেশে সৈন্য ঘাঁটি স্থাপনের জন্য বলতে বাধ্য করা হয়। তারপরেই সোভিয়েত রাশিয়ার পুলিশ সেই দেশগুলোর সন্দিগ্ধ সোভিয়েত বিরোধী সরকারি কর্মচারী, বুদ্ধিজীবীদের গ্ৰেফতার করতে শুরু করে। সেই দেশগুলোতে ১৯৪০ সালের জুলাই মাসের নির্বাচনে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার পায়। সোভিয়েত রাশিয়ার পত্রিকা ‘Pravda’ লিখলো — “the sun of the great Stalinist constitution will henceforth be shining its gratifying rays on new territories and new peoples,”।
১৯৪১ এর ১৬ই মে NKVD এর প্রধান বেরিয়া , স্তালিনকে এক চিঠিতে লেখে —“clean up regions recently integrated into the U.S.S.R. and remove all criminal, socially alien, and anti-Soviet elements.” Iসোভিয়েত সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাল্টিক দেশগুলোর স্বাধীনতার অস্ত হয় আর অত্যাচারের এক নতুন যুগের সূচনা হয়।সেই বছর ১৩-১৪ জুন রাত্রেই হাজার হাজার জমির মালিক, পুরাতন সরকারি আধিকারিকের পরিবারকে নির্বাসিত ও হত্যা করা হয়।নির্বাসনের প্রক্রিয়ার সময় তাদের খাদ্যের ব্যবস্থার কোনো দায়িত্ব NKVD নেয় নি — নির্বাসিত পরিবারগুলো কয়েক মাসের জন্য মাত্র ১০০ কেজি খাদ্য নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিল !
১৯৪১ এর জুলাই মাসে যখন পশ্চিমদিক থেকে জার্মান সেনা ধেয়ে আসছে , ১৩৫ টি জেলখানা ও ২৭ টা শ্রমশিবিরের ৭ লক্ষ ৫০০০০ বন্দীকে রাশিয়ার পূর্বপ্রান্তে স্থানান্তরিত করা হয়।এইসময় গুলাগের বন্দীদের ৬০০ মাইলের পথ খালি পায়ে পাড়ি দিতে হয়েছিল।সময়ের অভাবে যেখানে গুলাগ ক্যাম্পকে খালি করা সম্ভব হতো না, সেখানে খুব সহজ উপায় অবলম্বন করা হতো — বন্দীদের গুলি করে হত্যা।NKVD পশ্চিম ইউক্রেনে ১০০০০ বন্দীকে হত্যা করে — জার্মান সৈন্যরা সেই এলাকার দখল নেওয়ার সময় কয়েক ডজন গণকবর খুঁজে পায়।গুলাগ ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যেক বছর দেড় থেকে আড়াই লক্ষ বন্দীর মৃত্যু হয়।১৯৪১ থেকে ৪৩ এর মধ্যে অসুস্থতার জন্য বা হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রায় ৬ লক্ষ গুলাগ ক্যাম্পের বন্দীদের মৃত্যু হয়।১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিকে বিশ্বশান্তির জন্য মিত্রশক্তির সদস্য সোভিয়েত রাশিয়ার ক্রিয়াকলাপ দেখা যাচ্ছে তখন সেই দেশেরই অসংখ্য মানুষ ‘শান্তি’ থেকে দূরে ‘গুলাগ’ ক্যাম্পে জীবন কাটাচ্ছে।
১৯৪৫ সালে ‘গুলাগ’ ক্যাম্পে বন্দী সংখ্যা একলাফে অনেকটাই বেড়ে যায় কারণ যে সব সোভিয়েত সৈন্যরা শত্রুসৈন্যের হাতে কিছুকাল বন্দী থাকার পর মুক্ত হয়েছিল , তাদেরও ঠাঁই হয় গুলাগের শ্রমশিবিরে ! সন্দেহ করা হয়েছিল যে তাদের মধ্যে অনেকে শত্রুদের গুপ্তচর থাকতে পারে বা তাদের মধ্যে সোভিয়েত-বিরোধী মানসিকতার জন্ম হয়েছে।তার জন্য শত্রুর হাত থেকে সোভিয়েত সৈন্যরা নিষ্কৃতি পেলেও , তার নিজের দেশের কমিউনিস্ট শাসকের সন্দেহ থেকে তাদের রেহাই নেই।যে অঞ্চলগুলো জার্মান সেনা কিছুকাল দখল নিয়েছিল সেই সমস্ত অঞ্চলের সাধারণ নাগরিককেও সন্দেহের চোখে দেখে সেখানে কয়েকশো ‘Control & filtration camp’ খোলা হয় যার প্রত্যেকটিতে ১০০০০ মানুষকে বন্দী রাখার ব্যবস্থা ছিল।যে সময় স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ের উদযাপন করছে , তখন রাশিয়ার ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ গৃহহীন।১৯৪৬ এর নভেম্বর – ডিসেম্বর মাসে যৌথ খামারের প্রায় ৫৩০০০ কৃষককে গুলাগে পাঠানো হয় রুটি বা শস্য চুরির অপরাধে — এর মধ্যে মহিলারাও ছিল। মহান অক্টোবর বিপ্লবের প্রায় তিন দশক পরেও এই ছিল সাম্যবাদী সমাজের আদর্শ সোভিয়েত রাশিয়ার পরিস্থিতি !১৯৪৮ এর শেষের দিকে গুলাগ ক্যাম্পে প্রায় ৫ লক্ষ বন্দী ছিল যার মধ্যে প্রায় ৩০০০০ শিশু। সোভিয়েতের অধিকারভুক্ত বাল্টিক দেশগুলোর তথাকথিত ‘সোভিয়েত বিরোধী’ হাজার হাজার মানুষের গন্তব্য হতে থাকে গুলাগের শ্রমশিবির ! গুলাগের ভেতরেও বন্দীদের মধ্যে অপরাধ ও হত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকে — অমানবিক পরিস্থিতিতে মানবিকতার বিপর্যয়ের সমস্ত দিক ছুঁয়ে দেখার নাম যেন ‘গুলাগ’।
‘গুলাগ’ এ বিপুল সংখ্যক বন্দীদের চাপ , মহামারি, অপরাধের বৃদ্ধি সামলাতে যখন কমিউনিস্ট শাসক হিমশিম খাচ্ছে তখন বাধ্য হয়ে কিছু বন্দীকে সময়ের আগেই মুক্তি দেওয়া হয় কিন্তু এই বিশাল সংখ্যক শ্রমশক্তি থেকে উদ্ভূত লাভকে অব্যাহত রাখতে শ্রমিকদের মধ্যে পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়। মানুষকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা মার্ক্সবাদের ফল — ‘গুলাগ’।
সমাজকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করার ফল ‘গুলাগ’। মালিকপক্ষের লাভের অনিয়ন্ত্রিত লোভের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে পথের সন্ধান দেয় মার্ক্সবাদ তা আসলে এক মরিচীকা । এই পথে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যে নরকের দরজা খোলে তার নাম ‘গুলাগ’।
স্তালিনের মৃত্যুর পর স্তালিনীয় নীতি থেকে ধীরে ধীরে সরতে শুরু করে ক্রুশ্চেভ। গুলাগের বন্দীদের ধীরে ধীরে মুক্তি দেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৬০ সালের ২৫শে জানুয়ারি অফিসিয়ালি গুলাগের অবলুপ্তি হয়। পিছনে থেকে যায় মার্ক্সবাদের নামে এক কমিউনিস্ট শাসকের নৃশংসতার ইতিহাস , যার নাম ‘গুলাগ’।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.