দিলীপ কুমার মিশ্র এবং কল্যাণ চক্রবর্তী।
বিদূষী কিংবদন্তী নারী খনা বলেছেন, “আগে পুঁতে কলা/বাগ বাগিচা ফলা/শোনরে বলি চাষার পো/ক্রমে নারিকেল/পরে গো।” বাগান মানেই এক সময় কলার কথাই প্রথমে ভাবা হত। কলা ভারতের প্রাচীনতম ব্যবহার্য ফল। এর নাম ছিল রম্ভা। সহজেই জন্মাতো ভারতবর্ষ জুড়ে। দেবভোগ্য থেকে শিশুভোগ্য সকল খাদ্যেই কলার জুড়ি মেলা ছিল ভার। কলা সহজপাচ্য, সর্বগুণ-সমন্বিত, বছরব্যাপী সহজলভ্য ফল। ফলচাষে কৃষকের দ্রুত আয় নির্ণায়ক ফসল হল কলা (১২ থেকে ১৫/১৮ মাস)। ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে কলার চাষ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলায় একসময় কয়েকটি জাতের কলার নাম শোনা যেত। যেমন চাঁপা, কাঁঠালি, সবরি, ঠোঁটে, আটিয়া (বিচি) এবং কাঁচকলা। পুরো চাষটাই হত ছোটো লপ্তে এবং আবাস সন্নিহিত স্থানে। বেচাকেনাও হত স্থানীয় স্তরে। বাংলার প্রান্তিক কৃষক তাকে জীবন-জীবিকার তাগিদে ফসল-লক্ষ্মী হিসাবে গ্রহণ করল। বর্তমানে এক বিঘে জমিতে কলা চাষ করে বছরে গড়ে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ করা যেতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় সাথী ফসল চাষ করে লাভের অঙ্ক খানিকটা বাড়ানো যায়।
কলার উন্নত জাতের মধ্যে ক্যাভেনডিস/সিঙ্গাপুরী (বেঁটে জাত)-এর চাষ ও ফলন সবচাইতে বেশি। এর মধ্যে রয়েছে জায়েন্ট গভর্নর, রোবাস্টা, কাবুলি, গ্র্যান্ড নাইনি ইত্যাদি জাত। তবে গ্র্যান্ড নাইনি (জি-নাইন) ফলন ক্ষমতা সর্বাধিক। কেবল ভারতবর্ষ নয়, সারা বিশ্ব জুড়েই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই কলার চাষ হচ্ছে।
বাজারে হলুদ কলা (সিল্ক গ্রুপ) র একটা আলাদা কদর আছে। এর মধ্যে মর্তমান, মালভোগ, সবরি কলার নাম করা যায়। এগুলি সুস্বাদু, ঠাসা বুনোটের কলা, খানিকটা সুগন্ধিযুক্ত, তুলনামূলকভাবে খোসাটি পাতলা। তবে এই জাতগুলি রোগ-পোকায় সহজেই কাবু হয়।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, “সর্ব ঘটে কাঁঠালিকলা”; পুজো-উৎসব-মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান-শিশু ও বৃদ্ধদের খাদ্যে এর নাম একডাকে সবাই চেনে। এই জাতে রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বেশি। দীর্ঘ দিন ঘরে টাটকা থাকে (৬-১০ দিন)। ওষুধিগুণ থাকায় বাজারে এর চাহিদা যথেষ্ট। ঝড়-বাদলে এই জাতের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। এর উপকান্ড তুলনামূলক ভাবে শক্ত, তাই ঝড়ে সহজে ভেঙে পড়ে না। পাট পচানো, ভেলা বানানো, খোলার ব্যবহারে এর জুড়ি নেই। তাই অর্থকরী চাষ ছাড়াও লোকায়াতিক ব্যবহারের নিরিখে কাঁঠালিকলার সার্বজনীনতা অনস্বীকার্য। কাঁঠালির নির্বাচিত জাত যেমন বিসিবি-১, বিসিবি -৩ বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুপারিশ করা হয়েছে।
গরীব-মজদুরের ফল হিসাবে চাঁপা কলার সুনাম রয়েছে। লোকবিশ্বাস কলকারখানায় যারা কাজ করেন, তারা নিয়মিত এই কলা খেলে ফুসফুস জনিত রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকবেন। এই জাতটি দিয়েই বাংলায় কলার প্রাচীনতম বাণিজ্যিক চাষ হয়েছিল। এর স্বাদ টকমিষ্টি এবং হালকা সুগন্ধযুক্ত, শাঁস হালকা গোলাপী, খোসা পাতলা, অনেকদিন টাটকা থাকে। চাঁপা, চিনিচাম্পা, পুভান ইত্যাদি নামে বাজারে এই কলা পরিচিত। এই জাতটি রোগপোকা সহনশীল। একবার লাগিয়ে আট-দশ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায় বলে, গ্রামে এটি অন্যতম পছন্দের জাত।
কাঁচকলার জাতগুলোর মধ্যে বেহুলা, বাইশ ছড়া (বিসিবি-২), বড় বিগলু, গ্রীন বোম্বাই উল্লেখযোগ্য। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নত ফিয়া এবং সাবা নামের বিদেশি জাত পশ্চিমবঙ্গে অর্থকরী চাষের জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে। এই দুটি জাত দীর্ঘ দিন কচি/নরম থাকে, ফলে চয়ন ও বিপণনের জন্য অনেকটা সময় হাতে পাওয়া যায়। ‘ফিয়া’ জাতের কলা রান্না করলে তরকারিতে কালো ভাব অনেক কম হয়, তাই রন্ধনকে নান্দনিক করে তুলতে এই কলার কদর বাড়ছে।
লেখকদ্বয় বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।