প্রাচীন ভারতের শিক্ষা প্রাঙ্গণে

আচ্ছা, কেমন হতো যদি এমন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যেত যেখানে খোলা আকাশের নীচে গাছের তলায় প্রকৃতির মাঝে লেখাপড়া করা যেত বা কোনো বিষয়ের নীরস তাত্ত্বিক দিকটা না তুলে ধরে প্রয়োগিক দিকটাই তুলে ধরা হতো এবং শিক্ষান্তে সার্টিফিকেট পাওয়ার সময় আমাদের আশীর্বাদ করে যদি বলা হতো এতদিনে যা যা শিখেছ তাই প্রয়োগ কর বা যথাযথভাবে কাজে লাগাও। তবে বিদ্যাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতাম আর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এক বিষয় নিয়ে পড়ে সেই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হতো না। আচ্ছা, যদি আমাদের শেখানো হতো একজন ডিগ্রিধারী মানুষ (পড়ুন রোবট) নয়, বরং মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠার বিদ্যা তাহলে খুবই ভালো হতো তাই না? অনেকেই হয়তো ভাবছেন এই বিশ্ব চরাচরে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি সত্যিই পাওয়া যেত। সবারই জানলে অবাক হতে হবে যে প্রাচীন ভারতবর্ষে শিক্ষাধারা এমনটাই ছিল। অর্থাৎ আমাদের দেশে প্রাচীনযুগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এবং শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি এতটাই উন্নত ও সমৃদ্ধ ছিল। তা এবার আমরা প্রাচীন ভারতের শিক্ষা প্রাঙ্গণে হাজির হয়ে সেই উন্নত শিক্ষা সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করব।
প্রাচীন ভারত বর্ষে প্রতিটা মানুষের সমাজজীবন চারটি আশ্রমে বিভক্ত ছিল। যথা : (১) ব্রহ্মচর্য, (২) গার্হস্থ্য, (৩) বাণপ্রস্থ ও (৪) সন্ন্যাস। এগুলো যেন মানবজীবনের চারটি স্তরবিশেষ এবং জীবনের এই চারভাগের বিধানের দ্বারাই মানুষের জীবন পরিচালিত হতো। ছাত্রজীবনকে বলা হতো ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম। আমাদের মূল আলোচনা এই আশ্রমকে কেন্দ্র করে। প্রাচীন ভারতবর্ষে ছাত্রদের গুরুগৃহে পাঠ নিতে হতো। একজন গুরুকে কেন্দ্র করে একটি আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালিত হতো যাকে বলা হতো গুরুকুল। এই গুরুকুল শব্দের অর্থ হলো গুরুর গৃহ বা আশ্রম। এখানে বলা ভালো যে সব গুরুকুলই অরণ্যে অবস্থিত ছিল না বা সব গুরুই অরণ্যবাসী ছিলেন না। গুরু যাঁরা হতেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বলা যায় গৃহী-শিক্ষক এবং বেশিরভাগ গুরুকুলই লোকালয়ে অবস্থিত ছিল। লোকালয়ে অনেক সময় বহু শিক্ষকের সমাগমে অনেক বড়ো বড়ো নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। তখন নানা মুনি-ঋষির আশ্রমেও শিক্ষাদান হতো। আসলে, প্রাচীন যুগে ‘আশ্রম’ বলতে সংসারত্যাগী মানুষদের। আবাসস্থল এবং সাধনা ও শাস্ত্রচর্চা করার কেন্দ্রকে বোঝাতো। এখনও তাই বোঝায়। মুনি-ঋষিরা এইসব আশ্রমে সপরিবারে বসবাস করতেন। এই মুনি-ঋষিরাই গুরুরূপে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতেন। প্রাচীনকালে এইসব আশ্রম বা গুরুগৃহগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেই আশ্রমগুলিতে এক বা একাধিক গুর থাকতেন যাঁরা ছাত্রদের বিজ্ঞান, গণিত রাজনীতি, সাহিত্য, ব্যাকরণ, শাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা দিতেন। তৎকালীন ভারতীয় জীবন যেমন আশ্রমভিত্তিক ঠিক তেমনি ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল আশ্রম ভিত্তিক। নির্দিষ্ট একটি বয়সে পিতা-মাতা সন্তানদের লেখাপড়া শেখার জন্য আশ্রমে বা গুরুগৃহে পাঠিয়ে দিতেন। এইব্রহ্মচর্যাশ্রমে উপনয়নকৃত বালক সকল নিয়মনিষ্ঠা পালন করে গুরুগৃহ থেকেই বেদ, বেদাঙ্গ ইত্যাদি শাস্ত্র পাঠ করত। সাধারণত বাণপ্রস্থীরা গুরুর দায়িত্ব পালন করতেন। তখনকার দিনে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক এখনকার ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক ছিল না, বরং তা ছিল অনেকটা পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মতো। গুরুর প্রতি সকল ছাত্রের শ্রদ্ধা এতটাই ছিল যে গুরুনিন্দা তো কল্পনাতীত এমনকী তা শোনাও ছিল মহাপাপ। আর গুরুর নির্দেশই যে কতখানি বেদবাক্য ছিল তা মহাভারতের আরুণির কাহিনিপড়লেই বোঝা যায়। তখনকার দিনে শিক্ষাগ্রহণের জন্যে কোনো অর্থ লাগত না। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষাদান করানো হতো। ‘গুরুদক্ষিণা বলতে তখন ছিল গুরুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস ও ভালোবাসা। ছাত্রদের মধ্যে জাতপাত, ধনী-দরিদ্র ইত্যাদি প্রভেদ ছিল না। সমাজের দরিদ্রতম ছাত্রটিরও শিক্ষালাভ করার সুযোগ থাকত। এখানে বলে রাখা ভালো যে, এইসব আশ্রমের সমস্ত ব্যয় বা খরচ চালানো হতো রাজপ্রদত্ত ভূসম্পত্তি থেকে। আবার কোনো কোনোও আশ্রমে। গুরুই শিষ্যদের গৃহস্থদের বাড়িতে বাড়িতে পাঠাতেন ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহের জন্য যার দ্বারা তারা তাদের অন্নের ব্যবস্থা করত।
এবার আমরা জেনে নেব প্রাচীন ভারতের শিক্ষাদানের পদ্ধতি। পরিণত বয়সেই গার্হস্থ ব্যক্তি তার বাণপ্রন্থ জীবন শুরু করতেন। অতএব তার মস্তিষ্ক ভাণ্ডারে সঞ্চয় হয়ে থাকত। জীবন থেকে পাওয়া প্রচুর অভিজ্ঞতা। বাণপ্রস্থী গুরুরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি ছাত্রদের সামনে জ্ঞানের আকারে তুলে ধরতেন। তাই, বলা যায়, প্রাচীন ভারতের শিক্ষাধারা জীবনের নানা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ছিল। আর আমরা তো জানি জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিই আমাদের অনেক কিছুই শেখায়, তারা প্রত্যেকেই আমাদের শিক্ষক। আর যখন শিক্ষাকে জীবনের। সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তুলে ধরার কথা উঠছে। তখন প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা মানবজীবনের ও মনের কতটা কাছে ছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয় বৈকি! আর একটা। অসাধারণ ব্যাপার না বললেই নয় তা হলো প্রাচীন বৈদিক সমাজে ছাত্রদের শিক্ষাদান করা হতো মূলত শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে। এই তিন পদ্ধতির সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
প্রথমে গুরু যে পাঠ দিতেন ছাত্ররা তা শুনত। এই পদ্ধতিকে বলা হতো শ্রবণ।শোনার পর ছাত্ররা সবাই মিলে তা আবৃত্তি করার চেষ্টা করত। এরপর তারা ব্যক্তিগতভাবে গভীর চিন্তার দ্বারা তা মনে রাখার চেষ্টা করত। এই গভীরভাবে চিন্তা করার পদ্ধতিকে বলা হতো মনন। তারপর, তারা একাগ্রচিত্তে ধ্যানের। মাধ্যমে সত্যকে উপলব্ধি করত। এই ধ্যান করে সত্যকে উপলব্ধি করাকে বলা হতো নিদিধ্যাসন আর এই নিদিধ্যাসনের দ্বারা তারা জ্ঞানলাভ করত। আর এইরকমভাবেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে একাগ্রতা বৃদ্ধিলাভ করত। তবে, একাগ্রতা বৃদ্ধির জন্যে শিক্ষার্থীরা রোজ জপ-ধ্যান (অর্থাৎ আহ্নিক)-ও করত। আজকের শিক্ষার্থীরা এ ধরনের শিক্ষাপদ্ধতিকল্পনা করতে পারবে কি না সেই ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই শ্রবণ ও মনন পদ্ধতির ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় জেনে রাখা ভালো যে প্রাচীনকালের শিক্ষার্থীরা যে বেদ পাঠ করত তা অনেক বছর লিপিবদ্ধ করা হয়নি। যদিও ঐতিহাসিকদের মত্যে প্রাচীনকালের বৈদিক যুগে মানুষ লিপির ব্যবহার জানত না, কিন্তু বর্তমান যুগের ঐতিহাসিকদের মতানুযায়ী বৈদিক যুগেও মানুষ লিপির ব্যবহার জানত। তাহলে লিপিবদ্ধ হয়নি কেন? এর উত্তরে অনেকেই বলেন যে, হয়তো শিক্ষার্থী বা শিষ্য গুরুর কাছ থেকে সরাসরি নেওয়া শিক্ষা শ্রবণ মনন ও নিদিব্যাসনের মাধ্যমে ধ্বনি ও ছন্দ অক্ষুন্ন রাখতে পারবে এবং শিষ্যের একাগ্রতা ও মনে রাখার ক্ষমতাও বৃদ্ধিলাভ করবে বলে লিপির ব্যবহার প্রচলন থাকলেও বেদ লিপিবদ্ধ হয়নি। এর থেকে প্রাচীন ভারতীয়দের একাগ্রতা ও স্মরণ ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রতিফলিত হয়।
প্রাচীন ভারতে বিদ্যা দু’ভাগে বিভক্ত ছিল যথা- (১) পরা বিদ্যা ও (২) অপরা বিদ্যা। এখন বিদ্যার এই দুই বিভাগ সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিই।
(১) পরা বিদ্যা : সাধারণত ব্রহ্মবিদ্যাকে পরা বিদ্যা বলা হতো। এই পরা বিদ্যার অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঈশ্বরলাভ বা নিজের প্রকৃত স্বরূপ বা ‘আমি’কে উপলব্ধি করত। আর এই ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলনের ফলে শিক্ষার্থীরা পরম শান্তি ও অমৃতত্ব লাভ করত। এর থেকে বলতে পারি যে প্রাচীন ভারতে শিক্ষার্থীরা এখনকার মতো স্ট্রেস, টেনশন বা দুশ্চিন্তা নিয়ে চলত না, বরং তারা এক পরম শান্তিতে এবং আত্মপোলব্ধি লাভের মাধ্যমে শিক্ষালাভ করত। অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীরা পরাবিদ্যা লাভ করার জন্য ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা শিক্ষার্থীজীবন থেকে সরাসরি সন্ন্যাসী হতো। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রাচীন ভারতে বেশিরভাগ মানুষই গাহস্থ আশ্রম শেষ হলে ঈশ্বরলাভের সাধনায় ব্রতী হতেন। আসলে প্রাচীন ভারতে মানুষের জীবনের লক্ষ্যই ছিল। “ঈশ্বরলাভ করা আর সম্বল ছিল ত্যাগ। ভোগের জীবন তারা বর্জন করে সৃষ্টিকর্তাকে জানাই যে জীবনের পরম ব্রত তা তারা ভালোভাবেই জানতেন।
(২) অপর বিদ্যা :প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগে শিক্ষার্থীদের বেদ, বেদাঙ্গ, ষড়দর্শন এবং নানা সূত্র সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হতো। তবে বৈদিক যুগের শেষে শিক্ষার্থীদের চতুর্বেদ ছাড়াও বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, নক্ষত্রবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যা, শিল্প, ব্রহ্মবিদ্যা, ইতিহাস, পুরাণ ইত্যাদি বিষয় পড়তে হতো। এই যে বিজ্ঞান, কলা, শিল্প প্রভৃতি ব্যবহারিক বা লৌকিক বিদ্যার অনুশীলন করাকে ‘অপরা বিদ্যা’ বলা হতো। এই অপরা বিদ্যা পাঠের মাধ্যমে সংসারে অর্থলাভ করার উপায় জানা যেত। অপরা বিদ্যালাভ করার পর বেশিরভাগ শিক্ষার্থী গার্হস্থ আশ্রম বা সংসারজীবনে প্রবেশ করত। প্রাচীন ভারতে প্রয়োগিক বা ব্যবহারিক বিদ্যাদান করা হতো শিক্ষার্থীকে যাতে সে তার বিদ্যাকে প্রয়োগ করে নিজে স্বাবলম্বী হতে পারে। তাই সে সময় শিক্ষার্থীরা যাতে সমাজের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে সেই ভাবেই তাদের গড়ে তোলা হতো। এবার আমরা জানব শিক্ষার্থীরা বিদ্যার্জনের পরে কী করত সেই ব্যাপারে।
বিদ্যার্জন সমাপ্ত হলে শিষ্যরা স্নান করে এসে গুরুকে প্রণাম করতেন। গুরু তখন তার শিষ্যদের আশীর্বাদ করতেন এবং উপদেশ দিতেন যে তারা যা যা বিদ্যার্জন করেছে তা যেন যথাযথভাবে কাজে লাগায়। ছাত্ররা ওই বিশেষ দিনটিতে বিশেষ উদ্দেশ্যে স্নান করার পর ‘স্নাতক’ (আজকের দিনে ইংরেজিতে যাকে বলে গ্র্যাজুয়েশন’আর স্নান করার পরে গুরুর দ্বারা ছাত্রদের ওই বিশেষ আশীর্বাদ প্রাপ্তির অনুষ্ঠানকে বলা হতো ‘সমাবর্তন’ (আজকের দিনে ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘কনভোকেশন)। তবে, বর্তমান ভারতের স্নাতক ও সমাবর্তন অনুষ্ঠান প্রাচীন আমলের স্নাতক ও অনুষ্ঠানের একেবারেই অমিল।
এবার আসি প্রাচীন ভারতের নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলে নিই, যে যাই বলুন না কেন প্রাচীন ভারতে নারী ও পুরুষের সম-অধিকার ছিল এবং লিঙ্গ-বৈষম্য বা নারী-পুরুষ ভেদাভেদ বলে কিছু ছিল না, বরঞ্চ প্রাচীন ভারতে নারীদের অতি উচ্চস্থান ছিল। সংগীত, নৃত্যে ও বাদ্যে প্রাচীন ভারতীয় নারীরা অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। নারীরা বয়ন, সূচিশিল্প ও চারুশিল্প নিয়ে অধ্যয়ন করতেন। ছাত্রীরা গুরুগৃহ থেকে বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ ইত্যাদি পাঠ করত। ভবভূতি তার উত্তররামচরিত’-এ লিখেছেন যে আত্রেয়ী বাল্মীকির আশ্রমে লব কুশের সঙ্গে বেদান্ত পড়েছিলেন। তৎকালীন নারীরা অধ্যাপনা এবং পুস্তক রচনাও করতেন এমনকী যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করতেন। আসলে, বৈদিক সমাজে বাল্যবিবাহ বলে কিছু ছিল না। আর অথর্ববেদ থেকে তথ্য পাই যে ছাত্রজীবন শেষ না হলে কুমারীদের বিবাহ করার অধিকার ছিল না। জানা যায় যে, প্রাচীন ভারতে নারীরা ব্রহ্মবিদ্যা সম্পর্কিত গৃঢ় আলোচনা ও বিতর্কসভায় অংশ নিতেন এমনকী কেউ কেউ মন্ত্রদ্রষ্টাও ছিলেন অর্থাৎ তারা মন্ত্রের পরম তত্ত্ব প্রত্যক্ষলাভ করেছিলেন। এতটাই উন্নত ছিল প্রাচীন ভারতের নারী সমাজ ও নারী শিক্ষা। আর প্রাচীন ভারতে গার্গী, মৈত্রী, আত্রেয়ীর মতো বিদুষীদের আমরা দেখতে পাই।
নীরস নোটস লিখিয়ে শিক্ষার্থীদের ‘তোতাপাখি’তৈরি করা প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ধারার উদ্দেশ্য ছিল না। বরং প্রকৃত শিক্ষার্জনের সঙ্গে সঙ্গে যাতে শিক্ষার্থীরা সঠিক চরিত্র গঠন লাভ করে, আত্মসংযম ও আত্মবিশ্বাস যাতে বৃদ্ধিলাভ করে, সামাজিক কর্তব্যবোধ যাতে তারা পালন করতে পারে এবং শিল্প-সংস্কৃতির ধারাকে যাতে অব্যাহত রাখতে পারে বা শিল্প-সংস্কৃতি যাতে তাদের হাতে অক্ষুন্ন থাকে ইত্যাদি সব বিষয় নজর দেওয়াও শিক্ষারই নিরবচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে ধরা হতো। প্রাচীন ভারতের শিক্ষা পদ্ধতির ফলে শিক্ষার্থীরা যে মনুষ্যত্বলাভ এবং সুচরিত্র লাভ করেছিল তা ভারতের নানা পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক কাহিনিতে তো পাওয়াই যায় এমনকী বিদেশি পর্যটকদের রচনাতেও তা প্রতিফলিত হয়। উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই যে, খ্রিস্টপূর্বাব্দে যেসব স্বনামধন্য বিদেশি পর্যটকরা এসেছিলেন। যেমন মেগাস্থিনিস, পিলনি, স্টাবো তাদের কথায় ভারতীয়রা সাধারণত মিথ্যা কথা বলতো না, ওই সময় চোর-ডাকাতের উপদ্রব ছিল না বললেই হয়, একে অপরের প্রতি ছিল অটুট বিশ্বাস আর এসবের জন্যই হয়তো কোনোরূপ মামলা-মোকদ্দমার বিষয় ছিল না। পরবর্তীকালে সপ্তম শতাব্দীতে বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ এবং তারও পরের ই-ভসি দুজনেই ভারতীয়দের নৈতিকতার বা নৈতিক জীবন-যাপনের প্রশংসা করে গেছেন। শতাব্দীর আগে পর্যন্ত সমস্ত বিদেশি পর্যটকরা ভারতীয়দের নীতিবোধ, আচার-আচরণ ও চরিত্র সম্পর্কে প্রশংসা করেছিলেন। এমনকী ঊনবিংশ শতাব্দীতে লর্ড মেকলে ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 1661126614, “I have travelled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such caliber, that I do not think we would ever conquer this country, unless we break the very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage and therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their selfesteem, their native culture and they will become what we want them, a truly dominated nation”
ইতিহাস ঘেঁটে আমরা হলফ করে বলতেই পারি যে প্রাচীন ভারতবর্ষ বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন এবং সাহিত্য-সহ বিদ্যার সমস্ত বিভাগে যে বিপুল উন্নতিলাভ করেছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রাচীন ভারতে এমন সব বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসক, যোদ্ধা, সাহিত্যিক ইত্যাদি দিকপালদের পেয়েছিলাম যা সত্যিই আমাদের তাক লাগিয়ে দেয় এবং এটা স্পষ্টভাবে বোঝাই যায় যে পৃথিবীর কোনো দেশই প্রাচীন ভারতের মতো এত উন্নত ছিল না। যতগুলি প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ভারতীয় সভ্যতা ছিল তাদের মধ্যে উন্নত। বিভিন্ন বিষয় বা শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতীয়দের কৃতিত্ব বা অবদান সম্পর্কে বলতে গেলে গোটা একটা বৃহৎ পুস্তক রচিত হলেও তা হয়তো শেষ হবে না। একাধিক বিষয়ে অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তিও বিরল নয় প্রাচীন ভারতে। এই প্রাচীন ভারতবর্ষেই আমরা দেখেছি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় , বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় , তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিশ্বের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এইসব শিক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলি, বলাবাহুল্য, বর্তমান দেশের এমনকী বিশ্বেরও তাবড় তাবড় নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়কেও হার মানাতে পারে। প্রাচীন ভারতের এই সর্বিক উন্নয়নের পেছনে নিঃসন্দেহে রয়েছে সে। সময়ের শিক্ষাপদ্ধতি যা এতই সুপরিকাঠামো যুক্ত, সুচিন্তিত ছিল যে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তা দেখা যায়নি এবং আজও হয়তো দুর্লভ। আর এই প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাই গত শতাব্দীর গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার শান্তিনিকেতনে। এখানে উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রবলভাবে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন শহরের রুক্ষ চার দেওয়ালের আবদ্ধে শিক্ষাদান নয়, এবং প্রাচীন ভারতবর্ষের মতো প্রকৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীর মনের এক মিলন ঘটানো। আজ, এত নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্জন করে কতজন পারছি নিজেদের অর্জিত শিক্ষাকে প্রয়োগ করতে? বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাই বা আমাদের কতটা চরিত্রবান করে তুলছে বা নৈতিকতায় ভরিয়ে দিচ্ছে? গুরু-শিষ্যের সেই পিতা-পুত্রের মতো সম্পর্কটা আদৌ আছে কী? সব গুরুই কি আজ সমান শ্রদ্ধাশীল বা সবাই কি শিষ্যের প্রকৃত নৈতিক বন্ধু হয়ে উঠতে পারছেন? গরিব শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় শিক্ষা ক’জন দিচ্ছেন? এইসব বিষয়গুলো নিয়ে যতই ভাবি ততই আমরা প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠি। আর এর সঙ্গে এক প্রবল বিস্ময়ও আমাদের মনকে গ্রাস করে। আর ঠিক তখনই আমরা ফিরে যেতে চাই প্রাচীন ভারতের এক শিক্ষাপ্রাঙ্গণে, প্রকৃতির মাঝে কোনো এক আশ্রমে, এক সদ্গুরুর কাছে নিজেদের অর্জিত বিদ্যা প্রয়োগ করতে। আর শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আত্মোপলব্ধি ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের মাধ্যমে এক পরম শান্তিলাভ করতেও চাই। সর্বোপরি মানুষের মতো মানুষ হতে চাই যে!
ইন্দ্রনীল মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.