রাজনৈতিক ক্ষমতা যখন জনকল্যাণের মাধ্যম নয়, ব্যক্তির অহংবোধ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার লোভনীয় স্বীকৃতি মাত্র, তখন ক্ষমতা করায়ত্ত করার যুদ্ধে অবতীর্ণ একজন যোদ্ধার যুদ্ধনীতি কেমন হতে পারে? এই প্রশ্নের চমৎকার উত্তর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তার গান্ধারীর আবেদন কবিতায় দুর্যোধন বলেছেন, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে! অর্থাৎ শত্রুকে ধ্বংস করাই রাজনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যপূরণ করতে গিয়ে ন্যায়নীতি লঙ্ঘিত হলো কিনা সেটা দেখা রাজনীতির কাজ নয়। এই ভাবনারই প্রতিফলন আমরা দেখলাম মহারাষ্ট্রে।
এবারের বিধানসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রের মানুষের রায়ে কোনও অস্পষ্টতা ছিল না। তারা চেয়েছেন বিজেপি এবং শিবসেনা জোট সরকার গড়ুক। অন্য দুটি দল কংগ্রেস ও এনসিপি মহারাষ্ট্রে সরকার গড়তে যত সংখ্যক আসন প্রয়োজন তার ধারেকাছেও ছিল না। কিন্তু ফলপ্রকাশের পর শিবসেনা-প্রধান উদ্ধব ঠাকরে বেঁকে বসলেন। তার দাবি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রিত্ব এবার কোনও একটি দলের হাতে থাকবে না। আড়াই বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হবেন বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবীশ আর বাকি আড়াই বছর মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করবেন শিবসেনার আদিত্য ঠাকরে।
বলা বাহুল্য, দাবিটি একই সঙ্গে অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত। কারণ ১৯৮৯ সাল থেকে বিজেপি শিবসেনার জোট মহারাষ্ট্রে এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব ঠাকরে তখন জীবিত। একথা অনস্বীকার্য, বালাসাহেবের জীবদ্দশায় মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ছিল বড়ো দল। আর বিজেপি ছোটো দল। সহযোগী জোটসঙ্গী মাত্র। তখন থেকেই মহারাষ্ট্রে একটি রীতি বর্তমান। বিজেপি-শিবসেনা জোটের মধ্যে যে। দল সর্বাধিক আসনে জয়ী হয় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন সেই দলেরই কেউ। ১৯৯৫ সালের মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে শিবসেনা পেয়েছিল ৭৩টি আসন আর বিজেপি ৬৫টি। স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। শিবসেনার মনোহর যোশী। আবার চার বছর পর মনোহর যোশীর বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠল তখন তাঁকে সরিয়ে শিবসেনারই নারায়ণ রানেকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। শিবসেনার থেকে মাত্র ৮টি আসন। কম পাওয়া বিজেপি কিন্তু মনোহর যোশী অপসারিত হবার পর তাদের কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে বলে অন্যায় গোঁ ধরেনি। কারণ সেটা করলে জোটধর্মকে অস্বীকার করা হতো। অথচ উদ্ধব এবার অনায়াসে সেই কাজটাই করলেন। ভুলে গেলেন প্রায় চল্লিশ বছরের সম্পর্কের কথা। ভুলে গেলেন রামমন্দির আন্দোলন -সহ অসংখ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার কথা। ভুলে গেলেন বালাসাহেবের বহু চর্চিত মারাঠি অস্মিতার কথা। শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে উদ্ধব সমঝোতা করলেন বিপরীতধর্মী আদর্শের সঙ্গে। এমন দুটি দলের হাত ধরলেন যারা স্পষ্টতই হিন্দুত্ববিরোধী। শুধু তাই নয়, মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুন্ন রাখতে এই দুটি দল ইসলামিক মৌলবাদকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জোগাতেও পিছপা নয়। বলা চলে, ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য মারাঠি অস্মিতা, হিন্দুত্ব—এমনকী জাতীয় নিরাপত্তার মতো বিষয় উপেক্ষা করেছেন উদ্ধব ঠাকরে।
প্রশ্ন হলো, কেন এমন একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলেন উদ্ধব? তাঁর দাবি, নির্বাচনের আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শিবসেনার আড়াই বছর করে মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। বিজেপি শিবসেনার এই দাবি মেনে নেওয়ার পরই আসন সমঝোতার কথাবার্তা শুরু হয়। যদিও অমিত শাহ নির্বাচনের কিছুদিন আগে শিবসেনা প্রধানের দাবি অস্বীকার করেছেন। নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর শিবসেনা যখন মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিতে অনড় তখনও এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, আড়াই বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে শিবসেনার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি।
বস্তুত, অমিত শাহ মিথ্যা বলছেন না। কারণ এরকম কোনও আলোচনা হলে তা গোপন থাকত না। এটা গোপন রাখার মতো বিষয় নয়। বরং মূলত মহারাষ্ট্রের দল হওয়ার সুবাদে শিবসেনা যদি আড়াই বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কথাটি ঘোষণা করত তাহলে দলের কর্মীরা আরও উজ্জীবিত হতেন। মহারাষ্ট্রের যেসব জায়গায় শিবসেনা দুর্বল সেখানে দলের ফল আরও ভালো হতে পারত। কিন্তু তারা তা করলেন না। পুরো বিষয়টা গোপন রাখলেন। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হলো। দেখা গেল, বিজেপি পেয়েছে। ১০৫টি আসন আর শিবসেনা ৫৬টি। অন্যদিকে কংগ্রেস পেয়েছে ৪৪টি আসন আর এনসিপি ৫৪টি। ফলাফলে স্পষ্ট মহারাষ্ট্রের মানুষ চেয়েছেন বিজেপি-শিবসেনা জোটেই সরকার গড়ুক। কিন্তু উদ্ধব জনতার রায়কে কার্যত নস্যাৎ করে আদিত্য ঠাকরেকে আড়াই বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে বলে বেঁকে বসলেন। বিজেপির পক্ষ থেকে বহুবার আলোচনার কথা বলা হলেও উদ্ধব তাতে। কর্ণপাত করেননি। তিনি সম্ভবত ধরেই নিয়েছিলেন বিজেপি তঁার দাবি মানবে না। এখানে একটা প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক, চল্লিশ। বছরের জোটসঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা পর্যন্ত না করার পিছনে কী যুক্তি থাকতে পারে ? শিবসেনার আচরণে কি এটাই স্পষ্ট নয় যে তারা ফলপ্রকাশের পরেই বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিজেপি ১০৫টি আসনে জয়লাভ এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করার পক্ষে সহায়ক হয়েছে। উদ্ধব যখনই বুঝলেন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। করতে পারেনি এবং ম্যাজিক ফিগারের থেকে ৪২টি আসন কম পাওয়ার দরুন শিবসেনার। সমর্থন ব্যতিরেকে তাদের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না, তখনই তিনি মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিটি করলেন। উদ্ধব জানতেন আদর্শগত কারণেই বিজেপির পক্ষে কংগ্রেস বা এনসিপিকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নয়। শিবসেনা ভিন্ন তাদের আর কোনও গতি নেই। সুতরাং বিজেপির ওপর চাপ সৃষ্টি করে মুখ্যমন্ত্রীর গদিটি আড়াই বছরের জন্য আদায় করে নেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়।
আরও একটি কারণে সময়টি উপযুক্ত। যেহেতু নির্বাচনের আগে আড়াই বছরের মেয়াদি মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি, তাই শিবসেনার নির্বাচনী প্রচারেও বিষয়টি উঠে আসেনি — সুতরাং, প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অভিযোগ তুলে বিজেপির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার অবকাশ শিবসেনার ছিল না। ব্ল্যাকমেলিংই ছিল একমাত্র রাস্তা। জোটধর্মের দায়বদ্ধতায় এবার বিজেপি ১৬০টি (মোট আসন ২৮৮টি) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। জিতেছে ১০৫ টি-তে। ম্যাজিক ফিগারের থেকে ৪২টি আসন কম পাওয়ায় বিজেপির পক্ষে নিজের জোরে সরকার গঠন করা সম্ভব ছিল না। তারই সুযোগ নিয়েছে শিবসেনা। বিজেপির ভোটে জিতে শেষে বিজেপিরই পিঠে ছুরি মেরে জোটধর্ম— এমনকী রাজধর্মকেও পদদলিত করেছে তারা।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত শিবসেনার এই আচরণে অনেকেই হতাশ। তারা নিশ্চয়ই মহারাষ্ট্রের এই পরিস্থিতির রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করবেন। একটা প্রশ্ন অবশ্যই তাদের বিশ্লেষণে উঠে আসবে, উদ্ধব কি স্বেচ্ছায় এ কাজ করেছেন? নাকি পিছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন অন্য কেউ? না, এখানে এনসিপি-প্রধান শরদ পাওয়ার বা কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ধর্তব্যের মধ্যেই নন। বিষয়টি পরিবারের ক্ষমতালিপ্সার সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যেই যা মহারাষ্ট্রের বহু মানুষের চর্চার বিষয়।
এই চর্চার কেন্দ্রে রয়েছেন উদ্ধব ঠাকরের স্ত্রী রশ্মি ঠাকরে। মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন-পরবর্তী শিবসেনার যাত্রাপথ তৈরি হয়েছে তারই নির্দেশে। উদ্ধব নন, তিনিই হাল ধরেছেন শিবসেনার ঝিমিয়ে পড়া নেতৃত্বের। ঝিমিয়ে পড়া কেন? কারণ শিবসেনা আর মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিজেপির বড়ো ভাই’ নয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর গৌরবময় উত্থানের পর শিবসেনা এখন নেহাতই মহারাষ্ট্রের আঞ্চলিক দল। এমন একটি আঞ্চলিক দল, মহারাষ্ট্রের সর্বত্র যার প্রভাব নেই। কোথাও কোথাও অস্তিত্বই নেই। শিবসেনার প্রভাব এখন মূলত মুম্বই এবং তার আশেপাশেই সীমাবদ্ধ।
অন্যদিকে বিজেপি মহারাষ্ট্রের প্রধান শক্তিতে পরিণত। মোদী সরকারের সুশাসন এবং নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তায় ভর করে বিজেপি যে ভবিষ্যতে মহারাষ্ট্রে আরও শক্তিশালী হবে তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে উপায় ? রশ্মি ঠাকারে নিদান দিয়েছেন, মহারাষ্ট্রে পার্টিকে বাঁচাতে চাইলে শিবসেনাকে সরকারে তো থাকতেই হবে, মুখ্যমন্ত্রীও করতে হবে শিবসেনার আদিত্য ঠাকরেকে। নয়তো বিজেপির ক্রমশ বড়ো হতে থাকা ছায়াতে হারিয়ে যাবে শিবসেনা। এবং মুছে যাবে। ঠাকরে পরিবারও। রশ্মি ঠাকরের বেশি দুশ্চিন্তা সম্ভবত পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই।
নরেন্দ্র মোদী যতই পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলুন, ভারতীয় রাজনীতি থেকে পরিবারতন্ত্রকে নির্মূল করা বোধহয় সহজ নয়। শিবসেনা রাজনৈতিক স্বার্থে এনডিএ ছেড়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো ভিন্ন কোনও রাজনীতির অঙ্কে ফিরেও আসবে। কিন্তু রাজনীতিতে যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করল তার দাগ সহজে মুছবে না।
সন্দীপ চক্রবর্তী
2019-12-05