আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না

রাজ্যের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের কালিয়াগঞ্জ, করিমপুর এবং খড়গপুর উপনির্বাচনে বিজেপি পরাস্ত হয়েছে তার। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। বলতেই হচ্ছে, এই পরাজয় বিজেপির কাছে। শুধু অস্বস্তিদায়ক নয়, চূড়ান্ত লজ্জাকরও। অন্যদিকে, বিগত লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপির কাছে পর্যুদস্ত হওয়া তৃণমূল কংগ্রেস এই তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনে। জয়ের ফলে মানসিক এবং সাংগঠনিকভাবে এবার উজ্জীবিত হয়ে উঠবে। ২০২১-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন এবার অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, এই উপনির্বাচনের ফলাফলই প্রমাণ করবে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পায়ের তলায় হারানো জমি তৃণমূল কংগ্রেস কতটা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে, এবং বিজেপিই বা তাদের লোকসভার সাফল্য কতটা ধরে রাখতে পারল। দ্বিতীয়ত, এই উপনির্বাচনের ফল যার অনুকূলে যাবে বিধানসভার দৌড়ে আপাতত সে কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকবে। দুটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে অনেকটাই পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। সাধারণত, উ পনির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজ্যে রাজনৈতিক কৌতূহলের পারদ তেমন চড়ে না। কিন্তু এবারের এই উপনির্বাচন ঘিরে এই কৌতূহল রাজ্যের সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। যে তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন হয়েছে, সেগুলির মধ্যে আবার খঙ্গপুর বিধানসভা কেন্দ্রটি সম্পর্কে সবারই কৌতূহল ছিল বেশি। তার বড়ো কারণ এই বিধানসভা কেন্দ্রটি বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের ছেড়ে যাওয়া আসন। অর্থাৎ, বিজেপির কাছে এই আসনটি ছিল সর্বাধিক সম্মানের আসন। গত লোকসভা নির্বাচনে খগপুর এবং কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় বিজেপি তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল। ফলে অনেকেই আশা করেছিলেন, লোকসভা নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত এই উপনির্বাচনে বিজেপি সেই জয়ের ধারা অব্যাহত রাখবে। তিনটির ভিতর অন্তত দুটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপি জয়ী হবে। দেখা গেল, লোকসভায় এই বিশাল ব্যবধানে জেতা আসন দুটিও তৃণমূলের কাছে খোয়াতে হয়েছে বিজেপিকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, লোকসভা নির্বাচনের ঈর্ষণীয় সাফল্যের পর মাত্র পাঁচ মাসের মাথাতেই বিজেপির এই বিপর্যয়ের কারণ কী? কারণ একটি নয়, একাধিক। এবং কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে এটুকু বোঝা যাবে, এই উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস হারায়নি বিজেপিকে। বিজেপিকে হারিয়েছে বিজেপিই।
প্রথমেই খঙ্গপুর বিধানসভা কেন্দ্রের কথা ধরা যাক। এই বিধানসভা কেন্দ্রটি বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের ছেড়ে যাওয়া কেন্দ্র। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রবাদপ্রতীম কংগ্রেস বিধায়ক জ্ঞান সিংহ সোহনপালকে হারিয়ে জিতে এসে চমক সৃষ্টি করেছিলেন দিলীপবাবু। এবার লোকসভা নির্বাচনে মেদিনীপুর কেন্দ্র থেকে জিতে আসার পর এই বিধানসভা কেন্দ্র ছাড়তে হয়েছে দিলীপবাবুকে। দিলীপবাবুর ছেড়ে আসা এই আসনে এবার প্রার্থী হয়েছিলেন প্রেমচন্দ ঝা। প্রেমচন্দ ঝা-র প্রার্থীপদ নিয়ে প্রথম থেকেই স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের অসন্তোষ ছিল। সে অসন্তোষের কথা তারা জানিয়েছিলেন রাজ্য নেতৃত্বকে। এমনকী কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষককেও তারা জানিয়েছিলেন তাদের ক্ষোভের কারণ। প্রেমচন্দ ঝা-র বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল, তার ভাবমূর্তি যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। স্থানীয় মানুষদের ভিতরও তার তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। যার ভাবমূর্তি স্বচ্ছ নয়, স্থানীয় মানুষদের ভিতর গ্রহণযোগ্যতাও কম— এমন ব্যক্তিকে প্রার্থী করে রাজ্য বিজেপি মোটেই সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি। এক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃত্বের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের। মনে রাখতে হবে, খঙ্গপুরে বিজেপির কাছে লড়াইটি ছিল সম্মানের। সেই সম্মানের লড়াইয়ে সতর্কতার সঙ্গে প্রার্থীবাছাই খুব জরুরি ছিল। তা না করে, কারো ব্যক্তিগত পছন্দের একজনকে প্রার্থী করে দেওয়া রাজনৈতিক অজ্ঞতারই পরিচয় হয়েছে। ব্যক্তির স্বার্থ যে পার্টির স্বার্থের উপরে কখনো স্থান পেতে পারে না—এই শিক্ষাটি খঙ্গপুরের ফলাফল থেকে নেওয়া উচিত বিজেপি নেতৃত্বের। খপুরে বিজেপির পরাজয়ের মূল কারণ যদি হয় সঠিক প্রার্থী নির্বাচন না করা, তাহলে অন্য আর একটি কারণ হচ্ছে, গত তিনবছর ধরে এখানে বিজেপির বিধায়ক থাকলেও স্থানীয় মানুষের প্রত্যাশা পূরণে তার ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার কারণে স্বয়ং দিলীপবাবুকে এবার প্রচারে গিয়ে স্থানীয় মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে। খঙ্গপুরের পরাজয় রাজ্য-রাজনীতিতে বিজেপিকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলবে এবং খঙ্গপুরের বেশ চড়া মূল্যই হয়তো বিজেপিকে ভবিষ্যতে চোকাতে হবে।
করিমপুরে বিজেপি প্রার্থী হয়েছিলেন দলের রাজ্য সহসভাপতি জয় প্রকাশ মজুমদার। করিমপুরে জয়প্রকাশবাবুকে প্রার্থী করা নিয়েও দলের কারো কারো দ্বিমত ছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন স্থানীয় প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করা হলে লড়াইয়ে সুবিধা হতো। তবে, করিমপুরে উপনির্বাচনে বিজেপির জেতার কোনো সম্ভাবনা ছিল বললে ভুল বলা হবে। করিমপুরে এতত্সত্ত্বেও এই উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট বেড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। তবে যে প্রচার কৌশল নেওয়া দরকার ছিল, তা যে বিজেপি নিতে পারেনি সে ভোটের ফলাফলেই প্রমাণ। উপরন্তু, নির্বাচনের দিন করিমপুরে বেশ কিছু বুথে শাসক দলের বেপরোয়া ছাপ্পা ভোটেরও প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় বিজেপি অনায়াসেই জিতবে এমন আশা প্রায় সকলেরই ছিল। তার কারণ লোকসভা নির্বাচনে বিপুল মার্জিনে কালিয়াগঞ্জে বিজেপির এগিয়ে থাকা এবং সমগ্র উত্তরবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির অভূতপূর্ব সাফল্য। দেখা গেল, বিধানসভা উপনির্বাচনে এই বিশাল মার্জিন টপকে গিয়ে ভালো ব্যবধানে বিজেপিকে পরাস্ত করেছে তৃণমূল। করিমপুর এবং কালিয়াগঞ্জ এই দুই বিধানসভা কেন্দ্রেই বিজেপির বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মিথ্যা এবং বিভ্রান্তি রটনাকারী প্রচার। মানতেই হবে, তৃণমূলের এই মিথ্যা প্রচার মানুষের উপর প্রভাব ফেলেছে, মানুষ আতঙ্কিত হয়েছে এবং বিজেপির প্রতি বিমুখ হয়েছে। বিজেপির ব্যর্থতা এখানেই যে, তৃণমূলের এই মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে বিজেপি পাল্টা প্রচারটাই করতে পারেনি। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বকে বারবার নাগরিকপঞ্জি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে জোরদার প্রচার অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়ার পরও রাজ্য বিজেপির তরফে এই প্রচারে তেমন মনোনিবেশ করতে দেখা যায়নি। বরং, রাজ্যের কোনো কোনো বিজেপি নেতার এ প্রসঙ্গে অবান্তর বক্তব্য আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। করিমপুর এবং কালিয়াগঞ্জের ফলাফল এই শিক্ষা দিয়েছে। যে, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে নাগরিকপঞ্জি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে সঠিক প্রচার আরও জোরদারভাবে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে বিজেপিকে। মানুষের মনের ভুল ধারণাগুলি দূর করিয়ে তাদের আবার বিজেপির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন করে তুলতে হবে। এই কারণগুলি ছাড়াও, উপনির্বাচনে বিজেপির এই ব্যর্থতার পিছনে আরও দুটি কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে, অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি এবং অন্যটি আত্মম্ভরিতা। গত লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসনে জয়লাভের পর থেকে রাজ্য বিজেপির অনেক নেতাই অতিরিক্ত আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। তারা ভাবতে শুরু করেছেন ২০২১-এ রাজ্যে ক্ষমতাদখল করা শুধু সময়ের অপেক্ষা। লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতটা যে পৃথক হয় তা তারা বুঝতে চাননি। তদুপরি আত্মম্ভরিতাও প্রকাশ পাচ্ছে তাদের মধ্যে। আত্মতুষ্টি এবং আত্মম্ভরিতা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। জনতার। মন বুঝতে যেব্যর্থ হয়েছেন বিজেপি নেতারা তিনটি উপনির্বাচনের ফল তার প্রমাণ। ২০২১-এ বিজেপিকে যদি সাফল্যের মুখ দেখতেই হয় তবে সর্বাগ্রে আত্মতুষ্টি এবং আত্মম্ভরিতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এখন থেকেই সংগঠনের দিকে নজর দিতে হবে বিজেপি নেতৃত্বকে। মানুষের মন বুঝতে মানুষের। কাছে যেতে হবে। একটু ভাবলেই বুঝতে পারতেন বিজেপি নেতারা, লোকসভা নির্বাচনের পরপরই বিজেপি সম্পর্কে যে আগ্রহ এবং উৎসাহ জনগণের মধ্যে দেখা দিয়েছিল, পাঁচমাসের মাথায় সে আগ্রহ। অনেকটাই অন্তর্হিত। এটি কিন্তু যথেষ্ট অশনি সংকেত।
এই রাজ্যে এখন প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৮টি আসন। পাওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আশঙ্কা দেখা গিয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের ভিতরেও একটা আশঙ্কা ঘনিয়ে এসেছিল। এই উপনির্বাচনে তিনটির মধ্যে অন্তত দুটি আসনেও যদি তৃণমূল কংগ্রেস হারতো, তাহলে ২০২১-এ তার পরাজয়ের দেওয়াল লিখন এখনই পড়ে ফেলা যেত। এখন বলা যেতেই পারে, তৃণমূল অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ালো এবং সামনে পুরসভা নির্বাচনগুলিতে তারা পূর্ণোদ্যমে লড়বে। বিজেপির সামনেও লড়াইটা আর একটু শক্ত হয়ে দাঁড়াবে। বাকি রইল বাম-কংগ্রেস জোট। তিনটি বিধানসভাতেই তারা এবারও তৃতীয় স্থানে। বলতেই হচ্ছে, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেরার মতো জায়গায় তারা এখনো ফিরতে পারছে না।
বিজেপিকে এখন ঠিক করতে হবে তার লক্ষ্য কী? দ্বিতীয় স্থানে থাকা, না, প্রথমে উঠে আসা? প্রথমে উঠে আসতে হলে বিজেপির অবিলম্বে সংগঠন দৃঢ় করার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন। সংগঠন ব্যতীত ভোট যুদ্ধে যে জেতা যায় না— বিজেপি নেতৃত্বকে সেটা অনুধাবন করতে হবে।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.