দাঁত, মুখের থেকে প্রাপ্ত সূত্র কি হারাল দ্রুত দাহে? দিল্লির নির্যাতিতার মতো কী ভাবে তদন্ত! আক্ষেপ বিশেষজ্ঞের

মাস কয়েক আগে দন্ত চিকিৎসককে দিয়ে ‘অর্থোডন্টিক ওয়্যার’ বসিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর রাতেও সেই তার থেকে গিয়েছিল তাঁর দাঁতে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে কি এই তার অন্যতম সহায়ক হয়ে উঠতে পারত? পরিবারের কাছ থেকে এই তার সম্পর্কে নানা তথ্য সিবিআই সংগ্রহ করার পরে এই প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে।

অনেককেই যা মনে করাচ্ছে নির্ভয়া-কাণ্ডের কথা। তাঁরা বলছেন, ওই ঘটনায় অন্যতম সহায়ক হয়েছিল ‘ফরেন্সিক ডেনটিস্ট্রি’ বা ‘ফরেন্সিক ওডন্টোলজি’-র (অপরাধের ক্ষেত্রে দাঁত সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ পরীক্ষা ও মূল্যায়নবিদ্যা)। যা প্রমাণ করে দিয়েছিল, নির্ভয়ার শরীরে যে কামড়ের দাগ মিলেছে, তা অভিযুক্তদেরই।

তবে কি এ বার ‘ফরেন্সিক ডেনটিস্ট্রি’র বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে সিবিআই? কিন্তু কী প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে সে ক্ষেত্রে? ‘ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেশিয়াল প্যাথোলজিস্ট’ তথা কলকাতার ‘ফরেন্সিক ডেনটিস্ট্রি’ বিশেষজ্ঞ সুরজিৎ বসু শনিবার বলেন, ‘‘সাধারণত দাঁতের গড়ন ঠিক করতে ‘অর্থোডন্টিক ওয়্যার’ বসানো হয়। দাঁতের খাঁজ বরাবর এ ক্ষেত্রে একটি করে ব্র্যাকেট বসানো থাকে। বেশ কিছু দিন এই ভাবে দাঁত একসঙ্গে বেঁধে রাখলে গড়ন ভাল হয়। বাঁধুনি হিসেবে কেউ সোনার, কেউ রুপোর, কেউ অ্যালুমিনিয়ামের তার ব্যবহার করেন। এই ভাবে বাঁধুনি করা অবস্থায় জোরে মুখ চেপে ধরলে ক্ষত তুলনায় বেশি গভীর হয়। সেই চাপের ধরন দেখে বলা সম্ভব, কাজটি এক জনের না কি অনেকের।’’

সুরজিৎ এর পরে বলেন, ‘‘আর জি করের ঘটনায় গলার পাশাপাশি নাক ও মুখ একসঙ্গে চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে বলে ময়না তদন্তে ইঙ্গিত মিলেছে। এক জনের দ্বারাই একই সময়ে গলা টিপে এবং নাকমুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করা সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। ফরেন্সিক ডেনটিস্ট্রি এই ধোঁয়াশা কাটাতে পারে। কিন্তু দেখতে হবে, দাহের আগে মুখের ভিতরের অংশের সমস্তটা দেখে নমুনা-প্রমাণ সংগ্রহ করে রাখা হয়েছিল কি না!’’

নির্ভয়া মামলায় যুক্ত কর্নাটকের ‘এসডিএম কলেজ অব ডেন্টাল সায়েন্সেসের’ ফরেন্সিক ওডন্টোলজি বা ফরেন্সিক ডেনটিস্ট্রি বিভাগের প্রধান অসিত বি আচার্য বললেন, ‘‘নির্ভয়ার দেহে কামড়ের চিহ্ন পরীক্ষা করে ফরেন্সিক ডেনটিস্ট্রি বলে দিয়েছিল, এই কামড় ধৃতদের মধ্যে দু’জনের। ছ’টি কামড়ের চিহ্ন ওই ধৃতদের দাঁতের গড়নের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। কিন্তু নির্ভয়ার মৃত্যু হয়েছিল পরে। কামড়ের চিহ্ন পরীক্ষা করার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখানে তো দেহই নেই। ফলে যথাযথ ভাবে ছবি তুলে তা রাখা না থাকলে, বলা মুশকিল।’’ এ ব্যাপারে মৃতার বাবা এ দিন বলেন, ‘‘দফায় দফায় বোঝা যাচ্ছে, ওই ভাবে তাড়াহুড়ো করে মেয়ের দেহ পুড়িয়ে ফেলা ঠিক হয়নি।”

এর সঙ্গেই এ দিন পরিবার এবং আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে মৃতার চশমা নিয়ে। ওই চশমা ভাঙা অবস্থায় সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয়েছিল। পুলিশ দাবি করেছিল, ওই তরুণী ঘুমিয়েছিলেন। সেই সময়ে ধৃত অভিযুক্ত তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

প্রশ্ন উঠছে, যদি তিনি ঘুমিয়েই থাকবেন, তা হলে তাঁর চশমা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যাবে কেন? মৃতার মায়ের প্রশ্ন, “মেয়ে কি চশমা পরে ঘুমোচ্ছিল? কেউ কি চশমা পরে ঘুমোয়?” তাঁদের বক্তব্য, নাকের কাছে যেখানে চশমার প্যাড ছাপ ফেলে, সেখানে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। নাকমুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করার ফলে চোখ থেকে রক্ত বার হতে পারে বলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছিলেন। চশমার ভাঙা কাচ লাগার ফলে রক্ত বেরিয়েছে, এমন কি হতে পারে?

চক্ষুরোগের চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “ভাবার মতো বিষয়। সাব কনজাংটিভাল হেমারেজ নাকমুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করার জন্য যেমন হতে পারে, তেমনই চশমার অংশ ভেঙে চেপে বসে কনজাংটিভাল ব্লাড ভেসেলে চাপ পড়ার জন্যও হতে পারে। দেখা দরকার যে, চশমায় কাচ ছিল, না কি ফাইবার গ্লাস? চশমার পাওয়ার কত ছিল? এই সমস্ত তথ্য পেলে এ-ও বলা সম্ভব যে, এক জনই চোখ-নাক-মুখ চেপে ধরেছিল, না কি অনেকে জড়িত।”

প্রশ্ন উঠছে, ‘এন্ডো সার্ভাইক্যাল ক্যানেলে সাদা ঘন চটচটে তরল’ পাওয়ার কথা ময়না তদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করা নিয়েও। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের একাংশের জিজ্ঞাসা, ‘ভল্ট অব দ্য ভ্যাজ়াইনা’ অর্থাৎ যৌননালিতে কী পাওয়া গিয়েছে, তার উল্লেখ না করে শরীরের অনেকটা ভিতরের অংশ ‘এন্ডো সার্ভাইক্যাল ক্যানেলে সাদা ঘন চটচটে তরল’ পাওয়ার কথা লেখা হল কেন? ধর্ষণের ক্ষেত্রে কি ওই পর্যন্ত সেমিনাল ফ্লুইড বা বীর্য যেতে পারে?

এই প্রসঙ্গে স্ত্রীরোগের চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “যে কোনও যৌন সংসর্গে এন্ডো সার্ভাইক্যাল ক্যানেল পর্যন্ত এত সহজে সেমিনাল ফ্লুইড যায় না। ভ্যাজ়াইনাল ভল্টেই তা পাওয়ার কথা।”

এ ক্ষেত্রে কি তা পাওয়া গিয়েছে?

ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ অজয় গুপ্ত বললেন, “এ ক্ষেত্রে ময়না তদন্তের রিপোর্টে স্পষ্ট করে সবটা লেখা না থাকায় গন্ডগোল হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনাল অ্যান্ড এক্সটার্নাল জেনিটেলিয়া (যৌনাঙ্গ) ছাড়া সমস্ত অঙ্গের ওজন প্রথমে লেখা হয়েছে। কিন্তু এর ওজন পরে লেখা হয়েছে ১৫৪ গ্রাম। প্রশ্ন হল, জেনিটেলিয়ার ওজন আলাদা করে প্রথমেই লিখে না রাখলে কী করে পরে বোঝা যাবে যে, ভিতরে কতটা বীর্য পাওয়া গিয়েছে? তাড়াহুড়ো করা বা যে কারণেই হোক না কেন, এখানে গোলমাল আছে বলে মনে হচ্ছে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.