সবার নজর নবান্নে যখন বিজেপি গেল লালবাজারে, মঙ্গল-অভিযান থেকে পদ্ম খুঁজছে জরুরি অক্সিজেন

হিন্দিতে বলা হয়, ‘কঁহি পে নিগাহেঁ, কঁহি পে নিশানা’। অর্থাৎ, নজর অন্য কোথাও। লক্ষ্য অন্যত্র। মঙ্গলবার সারা রাজ্যের সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন এবং আপাতদৃষ্টিতে বিজেপিরও ‘নজর’ ছিল নবান্নে। কিন্তু তাদের ‘লক্ষ্য’ ছিল লালবাজার। মঙ্গল-অভিযানের শেষবেলায় আচমকা লালবাজারের দিকে ধেয়ে গিয়ে আন্দোলনের পথে ফিরল পদ্মশিবির। তারা যে লালবাজার অভিযানে যাবে, তা ভাবতে পারেনি পুলিশও। ফলে নবান্নের চারদিকে ‘লৌহকপাট’ এঁটে দিলেও কলকাতা পুলিশের সদর দফতর অনেকটাই ‘ঢিলেঢালা’ ছিল। সে ভাবে ছিল না ‘রোড ব্লকার’ বা ‘ব্যারিকেড’ও। নিছকই দুবলা ‘গার্ডরেল’ দিয়ে বিক্ষোভ সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে দৃশ্যতই অপর্যাপ্ত পুলিশবাহিনী। শেষপর্যন্ত কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে বিজেপি তাদের ইপ্সিত ফায়দা তুলে নিয়েছে। এটা অনেকটা ফুটবলে ব্রাজিলের ছকের মতো। সকলে যখন পেলেকে ম্যান মার্কিংয়ে ব্যাস্ত তখন, সমান পারদর্শীরা ডিডি, ভাভা, গ্যারিঞ্চারা প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে বোকা বানিয়ে সহজেই বল জালে জড়িয়ে দিতেন।

এই কর্মসূচির কোনও ঘোষণা আগে থেকে ছিল না। অতীতে বিজেপির নবান্ন অভিযানের সময়েও একই ভাবে চতুর্থ একটি মিছিল নিয়ে আচমকা লালবাজার অভিযানে গিয়েছিলেন দলীয় দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। হতচকিত হয়ে গিয়েছিল পুলিশবাহিনী। মঙ্গলবারেও তেমনই ঘটল। ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের রাজ্য দফতরে বুধবারের বন্‌ধ ঘোষণা সেরেই নেতারা আচমকা কলকাতা পুলিশের সদর দফতরের দিকে মিছিল করে রওনা হন। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই ব্যারিকেড দিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। কিন্তু তার পরেও কিছুটা জঙ্গি কায়দায় সেই বাধা ভাঙার চেষ্টা হয়। সুকান্ত মজুমদার-সহ নেতারা বসে পড়েন রাস্তায়। সঙ্গে প্রাক্তন সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়-সহ অনেক রাজ্য নেতা। পরে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন সুকান্ত। ঠিক যেমনটি একটি ‘রাজনৈতিক আন্দোলনে’ হওয়া উচিত।

সেই সূত্রেই অনেকে প্রশ্ন করছেন, অবশেষে কি রাজনীতির ‘ময়দান’ ফিরে পেল বিজেপি? মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযান সরাসরি দলের নামে না হলেও অভিযানের আড়ালে যে বিজেপির ‘মদত’ ছিল তা একপ্রকার প্রকাশ্যে এসে গিয়েছিল। ওই অভিযানের জন্য কঠোরতম বন্দোবস্ত করেছিল কলকাতা এবং রাজ্য পুলিশ। প্রথমত, ওই মিছিলে অর্জুন সিংহ (যদিও দলের পক্ষে অর্জুনের যোগদানকে ‘ব্যক্তিগত’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেমনটা কয়েক জন বিধায়কের ক্ষেত্রেও বলেছে দল) এবং কৌস্তভ বাগচিদের দেখা গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, নামে ‘ছাত্র সমাজ’ হলেও অভিযানে যাঁদের চোখে পড়েছে, তাঁদের অন্তত ‘ছাত্র’ বলে মনে হয়নি। যে দক্ষতার সঙ্গে তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য ইট-পাটকেল-পাথর বা বোতল ছুড়েছেন, যে ভাবে লোহার ব্যারিকড বেয়ে তরতরিয়ে উঠেছেন এবং জলকামানের সামনে পড়ে নেমে এসেছেন, যে ভাবে লাঠি মারতে উদ্যত পুলিশকে গিয়ে সটান জড়িয়ে ধরে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছেন, তা রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা না থাকলে পারা সম্ভব নয়।

‘পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র সমাজ’ হিসাবে প্রথমে যাঁরা প্রকাশিত হয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে অবশ্য বিজেপির যোগ আগেই পাওয়া গিয়েছিল। অভিযানের দিন বিভিন্ন জেলা থেকে বিজেপি নেতাদের উদ্যোগে সংগঠিত মিছিল কলকাতায় নিয়ে আসার দৃশ্য পদ্মশিবিরের যোগ স্পষ্টতর করে দিয়েছে। অভিযান চলতে চলতেই যে ভাবে বিজেপি বুধবার বাংলা বন্‌ধের ডাক দিয়েছে, তাতেও মনে হয়েছে ‘প্রস্তুতি’ ছিল।

বিজেপি এমনিতে গোটা দেশেই আগের চেয়ে ‘ম্রিয়মান’। নরেন্দ্র মোদী সরকার এখন ‘শরিক-নির্ভর’। রাজ্য রাজনীতিতেও পদ্মশিবির সাইড লাইনে। লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়, তার পরে বিধানসভা উপনির্বাচনেও বিপুল হার বিজেপিকে অনেকটাই দফতর-বন্দি করে দেয়। খানিকটা ‘দিশাহারা’ও বটে। আন্দোলনের পরিবর্তে অন্তর্কলহেই বেশি ব্যস্ত ছিল রাজ্য বিজেপি। আরজি কর-কাণ্ডের পরে আন্দোলনে নামতে চেয়েও ধাক্কা খেয়েছিলেন নেতারা। কারণ, আরজি কর আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল জনতার হাতে। সাধারণ মানুষ স্বতস্ফূর্ত ভাবে পথে নামলেও সেখানে রাজনীতি ঢুকতে দিতে চায়নি তারা। যা থেকে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, কোনও রাজনৈতিক দলের উপরেই তাদের আস্থা নেই।

গত ১৪ অগস্ট একজন অনামী, অচেনা কন্যা সমাজমাধ্যমে যে ‘রাত দখল’-এর ডাক দিয়েছিলেন, তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিয়েছিলেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। মঙ্গলবার একটি সংগঠিত দলের (যতই আড়ালে থাকুক) আহ্বানে তার কাছাকাছি লোকও আসেননি। সেদিক দিয়ে ওই কর্মসূচি ‘সফল’ বলা যায় না।

এই অবস্থায় বিভিন্ন মোর্চার নামে ছোটখাট কর্মসূচি করলেও জনসাধারণের আন্দোলনে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবেই ছিল রাজ্য বিজেপি। শ্যামবাজারে পাঁচ দিনের ধর্না এবং স্বাস্থ্য ভবন অভিযানের পরেও বিজেপি সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সে সব ফেলে বিজেপি নতুন পথে হাঁটা শুরু করল। যার রেশ তারা টেনে নিয়ে যেতে চায় বুধবারের বন্‌ধেও। তবে সেই বন্‌ধ কতটা জনসমর্থনে হবে আর কতটা আশঙ্কায়, তা নিয়ে পদ্মশিবিরের নেতাদের অনেকেই সন্দিহান। বস্তুত, বন্‌ধ ডাকার সময়ে সুকান্ত রাজ্যবাসীকে ‘বিবেকের ডাকে’ এগিয়ে আসতে বলেন। তিনি বলেন, ‘‘এই বন্‌ধের ডাকে রাজনীতির রং না দেখে সকলের রাস্তায় নামা উচিত। ‌‌রং-মত ভুলে বন্‌ধ সফল করে শাসক দলকে জবাব দিতে হবে।’’

প্রসঙ্গত, আন্দোলনের কারণে পথে নামার সুযোগ পেয়ে বিজেপি আরজি কর-কাণ্ডের সঙ্গে শিক্ষা ও চাকরি দুর্নীতির প্রসঙ্গও জুড়ে নিতে চাইছে। এমনকি, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ টাকা ‘নয়ছয়’ করার অভিযোগকেও এই আন্দোলনের সঙ্গে জুড়তে চেয়েছেন সুকান্ত।

মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযান খুব ‘সফল’ হবে এমনটা অনেক বিজেপি নেতাও মনে করেননি। সকাল থেকে জমায়েতের আয়তন নিয়েও চিন্তা ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বুঝতে পারেন আন্দোলনকারীর সংখ্যা কম হলেও গোলমাল এবং পুলিশের সঙ্গে পরিকল্পিত সংঘাত প্রচারের ‘সাফল্য’ এনে দিয়েছে। পুলিশ অনেকটাই সংযত ছিল। কিন্তু অনেক জায়গায় মারমুখী হয়েছেন আন্দোলনকারীরা। দৃশ্যতই পুলিশ মারধর খেয়েও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া এবং ‘স্মোক বম্ব’ ছোড়ার উপরে যায়নি। কারণ, রাজ্য প্রশাসন ‘লাশ চাই’ মর্মে কিছু অডিয়ো ক্লিপ হাতে পেয়েছিল। তাই লক্ষ্মণরেখার মধ্যে থাকতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে পুলিশকে। দিনের শেষে ১৫ জন পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। বেশ কয়েকজনের মাথা ফেটেছে।

বুধবার ১২ ঘন্টার বাংলা বন্‌ধ ডাকার পাশাপাশি আরও একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিজেপি। তবে অন্য চিন্তাও রয়েছে। আরজি কর-কাণ্ডের পরে রাজ্যের সাধারণ মানুষ যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ বা মিছিলে যোগ দিচ্ছেন তাঁরা নবান্ন অভিযানের মতো আক্রমাণত্মক আন্দোলনে সমর্থন দেবেন কি? ‘ভোঁতা’ হয়ে যাওয়া বন্‌ধ রাজনীতিতেও সাধারণের সমর্থন আদায় করা যাবে কি? দলের নেতাদের অনেকের মধ্যেই এ সব ভাবনা আছে। তবে বিজেপি আপাতত কর্মীদের ঘর থেকে বার করতে চায়। সেই অর্থে আচমকা লালবাজার অভিযান বিজেপিকে খানিকটা ‘অক্সিজেন’ দিয়েছে বৈকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.