২৮ বছর ধরে কাজ করছি। কিছু বদলায়নি। আসলে কিছুই বদলায় না।
১৯৯৬ সাল। কলকাতার এক প্রখ্যাত নাটকের দলে সদ্য নাম লিখিয়েছি। হাজরার কাছে হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটে সপ্তাহে তিন দিন ‘স্বপ্নসন্ধানী’-র মহড়া বসত। তখন উল্টোডাঙায় বাড়ি। সেখান থেকে হাজরায় মহড়া দিতে যেতাম। কিন্তু মুশকিল হত নাটকের শো থাকলে। নাটকের পর্দা পড়ার পরেও তো অনেক কাজ থাকে। সে সব গুছিয়ে দলের বাসে উঠতে অনেকটাই রাত হয়ে যেত। সেখান থেকে প্রথমে আসতে হত হরিশ মুখার্জি স্ট্রিট। তার পর সেখান থেকে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমরা যে যার মতো বাড়ি ফিরতাম। কেউ যেত দক্ষিণে। কেউ উত্তরে। কেউ ট্রেন ধরে আরও দূরে। দলে কোনও ছেলে থাকলে সে দিন তার উপর দায়িত্ব পড়ত। ওই দলের মেয়েদের বাড়ি পৌঁছে তার পর তাকে ফিরতে হত।
এখন ২০২৪। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আজও নাটকের শো শেষে ফেরার পথে দলের কেউ না কেউ আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। বয়স হচ্ছে বলে নয়, একা একজন মহিলা মধ্যরাতে বাড়ি ফিরছে বলে। এ-ও কি কম অসম্মানের? অবশ্য এই প্রথা তো নতুন নয়। আগে দেখতাম সন্ধ্যার পর কোথাও যেতে হলে মেয়েদের বাবা, কাকা, দাদারা পৌঁছে দিয়ে আসতেন। পরবর্তী কালে সেই দায়িত্ব গিয়ে পড়ত স্বামী এবং ছেলের কাঁধে। কোথাও যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মেয়েরা আলাদা। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তোমদের ‘পাহারা’ দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেই প্রথা এখনও চলে আসছে। শো থেকে ফিরতে রাত হলে আমার সঙ্গে আমারই দলের কোনও ছেলেকে পাঠানো হচ্ছে। তারা হয়তো আমার চেয়ে বয়সে ছোট। তবুও তারা ‘বীরপুরুষ’। শুধুমাত্র লিঙ্গের তফাত গোটা সমাজের চিন্তাধারাটাকে বদলে দিয়েছে।
নাটকের শো হোক বা বন্ধুর বাড়ির আড্ডা— ফিরতে রাত হলে সকলের জন্যই চিন্তা হবে। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। স্বেচ্ছায় পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ফেরা বা বাড়ির পথে কোনও বন্ধুকে এগিয়ে দিতে চাওয়া তো অন্যায় নয়। কিন্তু সেই কাজ করতে কোনও পুরুষকে বাধ্য করা যায় না। আর মেয়েরাই বা সেই দয়া নেবেন কেন? সে দিন মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে আমারই আশপাশের অল্পবসয়ি মেয়েদের কথোপকথন কানে আসছিল। বাড়ি থেকে বার বার ফোন করছেন তাঁদের বাবা-মায়েরা। জানতে চাইছেন, ফিরতে আর কত রাত হবে বা সঙ্গে কেউ আছে কি না। কথোপকথন শুনে আন্দাজ করতে পারি, প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেওয়া নিয়ে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এত রাতে একা মেয়ের বাড়ি ফেরা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। ‘মা’ হিসেবে অনুভব করি, সেই চিন্তা তো অমূলক নয়। আমাদের সমাজই তো বাবা-মায়েদের উপর এমন চিন্তার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সাবালিকা একটি মেয়েকে বাড়ির বাইরে রাত কাটালে সঙ্গে কাউকে রাখতে হবে কেন? এমন মানসিকতা কি প্রগতিশীল সমাজের নাগরিকদের থেকে কাম্য?
তখন আমি বেশ ছোট। মানিকতলায় আবৃত্তি শিখতে যেতাম। মনে পড়ে, এক দিন কোনও কারণে সেখান থেকে বেরোতে বেশ রাত হয়েছিল। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। আঁচ করতে পারছিলাম বাড়িতে কী ঝড় বইছে! যখন বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম, দেখলাম বাবা পাড়ার মোড় ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসরাস্তায় চলে এসেছেন। মেয়ের চিন্তায় মা ঘর-বার করছেন। চোখ-মুখ রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে। অথচ অদ্ভুত ভাবে আমার দাদা বাড়ি ফিরতে দেরি করলে কাউকে এমন চিন্তা করতে দেখিনি। ওই কাঁচা বয়সে অপমান বোধ কাজ না করলেও খারাপ লাগা তো ছিলই।
পঞ্চাশের চৌকাঠ পার করেও সল্টলেকের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে এখন রাতে একা ফিরতে ভয়ই লাগে। কারণ, রাস্তার ধারে ধারে সাজানো ত্রিফলার সাদা আলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারেনি। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ, খুন এবং সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে তরজা চলছে, সে সব দেখে বার বার এ কথাই মনে হচ্ছে। ১২ দিন কেটে গেল, ঘটনার কোনও কিনারা হল না। উল্টে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে মহিলাদের নিরাপত্তা দেওয়া জন্য একগুচ্ছ নির্দেশিকা জারি করা হল! হা হতোস্মি! সেখানে মহিলাদের রাতের শিফ্ট থেকে অব্যাহতি দিতে বলা হচ্ছে। মেয়েদের সুরক্ষার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ‘অ্যাপ’ আনা হচ্ছে। মহিলাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আলাদা করে বাহিনী তৈরি করা হচ্ছে। চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, একা মেয়ে মানে আসলে ‘খুলি হুয়ি তিজোরি’। ভাবতে অবাক লাগে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও তো একজন মহিলা। মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার বা বিশ্রামকক্ষ থাকা তো তাঁদের অধিকারের বিষয়। সেই অধিকার ছিনিয়েই বা নিতে হবে কেন? তার জন্য আলাদা করে নির্দেশিকা জারি করার প্রয়োজনই বা কোথায়? আর অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মেয়েদের রাতে দলবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া প্রহসন ছাড়া আর কী!
মেয়েরা রাতে বাইরে বেরোলে তার জন্য আলাদা করে প্রহরার ব্যবস্থা করতে হবে কেন? মেয়েরা তো বাড়তি কোনও সুবিধা চায়নি। সকলের জন্য নিরাপদ একটা শহর চেয়েছে। রাতে সেই শহরের অলিগলিতে যেন মেয়েদের জন্য বিপদ ওত পেতে বসে না থাকে। ১৪ তারিখে মেয়েদের রাত দখলের যে কর্মসূচি হল, সেখানেও তো নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি, ইচ্ছেকৃত ভাবে ঠেলাঠেলি করার ঘটনা ঘটেছে। দলের মেয়েরাই আমাকে জানিয়েছেন। মেয়ে হয়ে মেয়েদের জন্য লড়াই করতে গিয়ে যদি এমন জঘন্য ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়, সে-ও তো লজ্জার। প্রচণ্ড অসম্মানের।
আমার স্বামী পেশায় চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত। সেই সূত্রে বলতে পারি, এই পেশার সঙ্গে কত মহিলা যুক্ত রয়েছেন। শুধু চিকিৎসক নন, হাসপাতালের পরিচালন ব্যবস্থা থেকে সেবিকা, আয়া— বেশির ভাগই তো মহিলা। মেয়েদের যদি রাতের ডিউটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তা হলে তো হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে পুরুষ ভাইদের নিযুক্ত করতে হবে। ভেবে বলুন তো, রোগিণীদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে রক্ষকই শেষে ভক্ষক হয়ে উঠবেন না তো? কিংবা রাতবিরেতে কোনও প্রসূতির প্রসববেদনা শুরু হলে মহিলা চিকিৎসক বা সেবিকা ছাড়া কাজ চলবে তো? শুধু হাসপাতালই বা বলছি কেন! কল সেন্টার, বিমানবন্দর, বহুজাতিক সংস্থা, হোটেল, অভিনয় কিংবা সাংবাদিকতার মতো এমন অনেক পেশাই তো রয়েছে, যেখানে রাতেও মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। সেখান থেকে তাঁদের অব্যাহতি দিলে কাজ চলবে কী করে? আর এমন মধ্যযুগীয় সমাধানের কথা রাষ্ট্রের মাথায় আসবেই বা কেন? আর কী ভাবে মেয়েদের অসম্মান করা হবে?
ভাবতে বসলে কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যায়। আমার নিজের মেয়ে থাকলে কী হত? যত রাতই হোক, তার বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমি কি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যেতে পারতাম? মেয়েদের রাত দখলের সময়ে আমার মেয়েটা নিরাপদে আছে কি না, সেই চিন্তা কি আমার মাথায় ঘুরপাক খেত না? হয়তো মন থেকে চাইতাম, আর সকলের মতো আমার মেয়েও প্রয়োজন পড়লে রাত করেই বাড়ি ফিরুক। কিন্তু বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত ঠায় জেগে বসে থাকতাম। বুকে হাত রেখে সে কথা অস্বীকার করতে পারি না। আমার একটি মাত্র পুত্রসন্তান। তার বন্ধু-বান্ধবীরা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসে। গল্পগুজব করতে করতে রাত হয়ে গেলে এখন আমিই ছেলেকে বলি, ‘বান্ধবীদের এগিয়ে দিয়ে এসো’। আমিও তো একজন মা, তাই অজান্তেই আর পাঁচজন সাধারণ মায়ের দলে নাম লিখিয়ে ফেলেছি। কারণ, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে এ দেশের আইন, বিচার ব্যবস্থার উপর আমার কোনও আস্থা নেই। আমি কোথাও কোনও আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। ফলে সেই সম্মানের প্রশ্নটাই বার বার ভাবাচ্ছে। মেয়েরা কি কোনও দিনও রাতে নিশ্চিন্তে একা বাড়ি ফেরার সম্মান অর্জন করতে পারবে না? কখনওই কি চারপাশটা মেয়েদের জন্য নিরাপদ হবে না?