ভারত তখন শাসন করছে ইংরেজ। লাহোরকে রাজধানী করে রাজত্ব করছিল শিখ সাম্রাজ্য সরকার-্ই-খালসা। শিখ সাম্রাজ্যের অধীনে থেকেও বহু শতাব্দী ধরে নিজের লড়াকু ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বাঁচিয়ে চলছিল ছোট্ট ডোগরা রাজ্য। যার রাজধানী ছিল জম্মু। রাজা ছিলেন গুলাব সিং জামওয়াল। শিখ সম্রাট রঞ্জিৎ সিং–এর স্নেহধন্য।
১৮০৯ সালের সাট্লেজ সন্ধি মেনে সাম্রাজ্য বাড়াতে ব্রিটিশরা ভারতের পশ্চিমে অগ্রসর হয়নি, শিখরা অগ্রসর হয়নি পূর্ব দিকে। কিন্তু শিখদের স্বপ্ন ছিল উত্তরে সাম্রাজ্য বিস্তারের। উত্তরে ছিল তুষারমৌলি হিমালয় পর্বতশ্রেণী। যার গায়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়েছিল লাদাখ আর তিব্বত।
উত্তরে শিখ সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গেলে লাগবে ডোগরা রাজা গুলাব সিং–এর সাহায্য। ডোগরা রাজ্যের সীমানা বাড়া মানেই শিখ সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়া। তাছাড়া গুলাব সিংয়ের হাতে ছিল সুদক্ষ ডোগরা ফৌজ। যারা পার্বত্য যুদ্ধে প্রতিপক্ষের কাছে ছিল ভয়ঙ্কর। আর ছিলেন জোরাবার সিং কাহলুরিয়া। গুলাব সিংয়ের দুর্দমনীয় সেনাধ্যক্ষ।
লাদাখ তখন ছিল গিয়ালপো (রাজা) সেপাল নামগিয়ালের অধীনে। তাঁর অধীনে লাদাখের বিভিন্ন এলাকায় আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠী ছিলেন। এঁদেরই একজন ১৯৩৪ সালে জোরাবার সিং কে জানিয়েছিলেন, তিনি গিয়ালপোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চান, জোরাবার সিং যেন তাঁকে সাহায্য করেন। ফলে ডোগরা রাজ্যের কাছে উত্তরে সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ সুগম হয়ে গিয়েছিল।
লাদাখে সরকার-ই-খালসার পতাকা উড়িয়েছিলেন জোরাবার
পার্বত্য যুদ্ধে পারদর্শী, জম্মু কাশ্মীর ও হিমাচলের রাজপুতরা হিমালয়কে চেনেন হাতের তালুর মতো। তাই হিমালয়ের সংকীর্ণ গিরিখাত, উত্তুঙ্গ গিরিপথ ও বরফজমা শৈলশিরা অক্লেষে পার করে জোরাবার সিং তাঁর ডোগরা ফৌজ নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন লাদাখ।
সুরু নদীর অববাহিকা ধরে ৫০০০ সেনা ডোগরা সেনা একের পর এক স্থানীয় ফৌজকে হারাতে হারাতে এগিয়ে চলেছিল। ডোগরা ফৌজকে থামাতে লাদাখের রাজা সেপাল নামগিয়াল পাঠিয়েছিলেন তাঁর সেনাপতি বানকো কাহলোঁকে। ঘুরপথে গিয়ে ডোগরা ফৌজের রসদ সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
কিন্তু জোরাবার সিং যেন জ্যোতিষী। আগে থেকে সব জেনে যান। জোরাবার তাঁর ফৌজকে থামিয়ে দিলেন কারৎসে এলাকায়। লাদাখে এসে গিয়েছিল শীতকাল। জোরাবারের ডোগরা ফৌজ ওই লাদাখি ঠাণ্ডায় সারা শীত অপেক্ষা করেছিল । লাদাখের রাজা ও সেনাপতি ভেবেছিলেন প্রচণ্ড তুষারপাত ও অমানুষিক ঠান্ডায় কাবু হয়ে দেশে ফিরে গেছে ডোগরা ফৌজ।
কেটে গেছিল শীত, লাদাখে এসেছিল বসন্ত। লাদাখের মালভূমিতে ফুটে উঠেছিল লাল হলদে গোলাপি ঘাস ফুল। অতর্কিতে হানা দিয়েছিল ডোগরা ফৌজ। দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে হার মেনেছিল অপ্রস্তুত লাদাখি সেনা।
ডোগরা ফৌজ দখল করেছিল রাজধানী লে। জোরাবারের প্রভু গুলাব সিংয়ের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন গিয়ালপো সেপাল নামগিয়াল। রাজি হয়েছিলেন যুদ্ধের ক্ষতিপূরণবাবদ ৫০০০০ টাকা এবং বার্ষিক ২০০০০ টাকা খাজনা দিতে।
ডোগরাদের লাদাখ জয়ে অশনি সঙ্কেত দেখেছিলেন ছিলেন কাশ্মীরের শিখ রাজ্যপাল মেহান সিং। তাঁর আশঙ্কা ছিল ডোগরারা এবার কাশ্মীরের দিকে বাঁক নিতে পারে। ১৯৩৬ সালে তিনি গিয়ালপোকে বলেছিলেন গুলাব সিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে ।
মাত্র ১০ দিনের মধ্যে জোরাবার সিং লাদাখে পৌঁছে শক্ত হাতে দমন করেছিলেন বিদ্রোহ। সরিয়ে দিয়েছিলেন গিয়ালপো নামগিয়ালকে। তাঁর জায়গায় সিংহাসনে বসিয়েছিলেন নামগিয়ালের সেনাপতি নগরাব স্টানজিনকে।
আবার যাতে লাদাখে বিদ্রোহ না হয় তার জন্য লে শহরের বাইরে জোরাবার বানিয়েছিলেন একটি দুর্গ তাঁর বিশ্বস্ত। বিশ্বস্ত ডোগরা কম্যান্ডার দালেল সিংয়ের দায়িত্বে সেখানে রেখে দিয়েছিলেন ৩০০ জন সশস্ত্র ডোগরা সেনা।
জোরাবারের ডোগরা ফৌজ এগিয়েছিল পশ্চিমে
অথচ জোরাবার সিং কল্পনাতেও ভাবেননি তাঁকে ফৌজ নিয়ে কোনওদিন পশ্চিমে যেতে হতে পারে। লাদাখের উত্তর পশ্চিমে এবং কাশ্মীরের উত্তরে আছে বালটিস্তান। সেখানকার শাসক রাজা আহমেদ শাহ মাকপনের ছেলে মুহম্মদ শাহ, বাবার বিরুদ্ধে ১৯৩৮ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেছিলেন। মুহম্মদ শাহ সোজা চলে গিয়েছিলেন লাদাখে। বাবাকে মসনদ থেকে সরাতে লাদাখের গিয়ালপো ও জোরাবার সিংয়ের সাহায্য চেয়েছিলেন।
কিন্তু লাদাখে তখন অন্য খেলা চলছে। ডোগরাদের বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিয়েছিল লাদাখ। তাই জোরাবার সিংয়ের সাহায্য চাইতে গিয়ে লাদাখে বন্দি হয়ে গিয়েছিলেন মুহম্মদ শাহ। বালটিস্তানের শাসক আহমেদ শাহকে লাদাখ জানিয়েছিল, ছেলেকে বন্দি করে বিদ্রোহ রুখে দেওয়ার বিনিময়ে আহমেদ শাহকে ডোগরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
দূত খবর এনেছিল। জোরাবার সিং সোজা গিয়েছিলেন লাদাখ। সেখানে বিদ্রোহ দমন করে ১৯৩৯ সালের শীতে ডোগরা ফৌজ নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন বালটিস্তান। এই অভিযানে জোরাবার সিংয়ের ফৌজে ছিল প্রচুর লাদাখি সেনা।
জোরাবারের এক কম্যান্ডার নিধান সিংয়ের নেতৃত্বে ৫০০০ ডোগরা ও লাদাখি সৈন্য বরফে পথ হারিয়ে ফেলেন। প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে মারা গিয়েছিলেন অনেক সেনা। এই অবস্থায় ডোগরা ফৌজকে ঘিরে ধরেছিল বালটিস্তানি ফৌজ। কিন্তু ঠিক সময়ে খবর পৌঁছায় জোরাবার সিংয়ের কাছে। ভোজবাজির গতিতে আরও সেনা নিয়ে রণক্ষেত্রে পৌঁছে আক্রমণ শানান জোরাবার সিং।
ঢুকে পড়েন রাজধানী স্কার্দুতে। দখল করেন রাজার দুর্গ। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন রাজা আহমেদ শাহ। ডোগরা রাজ্যের বকলমে শিখ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে গিয়েছিল বালটিস্তানও। বালটিস্তানের সিংহাসনে জোরাবার সিং বসিয়েছিলেন মহম্মদ শাহকে। বার্ষিক ৭০০০ টাকা খাজনার বিনিময়ে।
এরপরও পূর্বে না ফিরে জোরাবার সিং তাঁর বিশ্বস্ত ওয়াজির লাখপতের নেতৃত্বে ডোগরা ফৌজকে পাঠিয়েছিলেন আরও পশ্চিমে। তারা দখল করেছিল গিলগিটও। বন্দি করেছিল গিলগিটের রাজাকে। বালটিস্তানের সঙ্গে ডোগরা রাজ্যের হাতে এসেছিল গিলগিটও।
কিন্তু গিলগিটের রাজা কাশ্মীরের শিখ রাজ্যপাল মেহান সিংয়ের অনুগত থাকায়, তিনি খবর পাঠান লাহোরে। শিখ সম্রাটের দূত সে খবর জানায় গুলাব সিংহকে। গুলাব জোরাবারকে বলেন গিলগিটের রাজাকে মুক্তি দিতে। পশ্চিমের দিকে আরও এগোনোর পথ বন্ধ হয়ে যায় জোরাবারের সামনে।
আবার উত্তরে, এবার চাই তিব্বত
অর্ধেক কারাকোরাম ও অর্ধেক হিমালয় তখন প্রায় ডোগরাদের দখলে। এবার শুধু তিব্বত দখল করলেই প্রায় পুরো হিমালয় চলে আসবে ডোগরাদের দখলে। এই অবস্থায়, ১৮৪১ সালে ৬০০০ সেনা নিয়ে আবার লাদাখ হয়ে তিব্বতের পথে চললেন জোরাবার সিং।
প্যাংগন লেক (১৪৩০০ফুট) পেরিয়ে গুগে রাজত্ব, থলিং, পুরাং হয়ে কৈলাস ও মানস সরোবরের পথে পশ্চিম তিব্বতে পৌঁছয় জোরাবারের ফৌজ। যাত্রাপথে মানস সরোবরে পুজো দেন জোরাবার সিং। যুদ্ধযাত্রার আবহে মিটিয়ে নেন তীর্থযাত্রার স্বাদ।
পুরাং উপত্যকাকে মানস সরোবর থেকে আলাদা করে রেখেছে গুরলা মান্ধাতা পর্বতশ্রেণী। জোরাবারের ফৌজ গুরলা পাস পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ডোগপা-চা। এখানে তিব্বতীসেনাদের প্রথম কলামকে সম্মুখ সমরে হারিয়ে দিয়েছিল ডোগরা ফৌজ।
প্রথম যুদ্ধে জেতার পর ডোগরা ফৌজ চলেছিল দক্ষিণে তাকালাকোটের দিকে। মায়ুম পাসের (১৭০০০ ফুট) ওপরে হয়েছিল দ্বিতীয় লড়াই। সাড়ে তিন মাসের লড়াইয়ে তিব্বতের কাছ থেকে প্রায় ৮৮৫ কিলোমিটার এলাকা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জোরাবার সিং। তখনও পর্যন্ত অপরাজেয় তিব্বতীরা জোরাবার সিংকে ভেবেছিল অপদেবতা। যাকে হারানো সম্ভব নয়।
ওদিকে দ্রুত নেমে আসছিল তিব্বতী শীত। জোরাবার সিদ্ধান্ত নেন তীর্থপুরীতে থেকে যাবেন এবং পরবর্তী গ্রীষ্মের জন্য অপেক্ষা করবেন। যাতে তিব্বতী সেনারা ফিরে না আসে তাই সিল করে দিয়েছিলেন মায়ুম পাস।
কিন্তু এখানেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কৌশলগত ভুলটি করে বসেন। তিব্বতীরা মায়ুম গিরিপথের দক্ষিণে থাকা মাতসাং গিরিপথ দিয়ে যে তাঁর ফৌজকে আক্রমণ করতে পারে, এটা তাঁর কল্পনাতে আসেনি। এমন কি শীতকালেও মাতসাং গিরিপথ চলাচলের উপযুক্ত থাকে।
এসে গিয়েছিল ১৯৪১ সালের শীত। এ শীত তিব্বতের শীত। লাদাখের থেকেও ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী। প্রবল তুষারপাতে সামনে ও পিছনের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ডোগরা ফৌজকে ছোবল মেরেছিল তুষার ঝড়। প্রচুর ডোগরা সেনা তুষারক্ষতের কারণে হারিয়েছিলেন আঙুল ও পায়ের পাতা। শরীর গরম রাখতে নিজেদের বন্দুকের কাঠের বাট জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন অনেক ডোগরা সেনা।
চেনা আবহাওয়ার সুযোগে তিব্বতী ফৌজ তাদের সঙ্গী চিনা ফৌজকে নিয়ে মাতসাং গিরিপথ দিয়ে ফিরে এসে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়েছিল জোরাবার সিংয়ের অসহায় ডোগরা ফৌজের ওপর।
১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর শুরু হয়েছিল টো-ইয়োর ঐতিহাসিক যুদ্ধ
এক সপ্তাহ ধরে প্রায় অনাহারে থাকা ডোগরা ফৌজ মা দুর্গার শপথ নিয়ে লড়াই শুরু করেছিল। যুদ্ধের প্রথম দিকেই গুলিতে আহত হয়েছিলেন জোরাবার সিং। গুলি লেগেছিল তাঁর ডান কাঁধে। এই অবস্থায় বাম হাতে তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিব্বতী সেনার ওপর।
কিন্তু নক্ষত্রের গতিতে ছুটে এসেছিল তিব্বতী ঘোড়সওয়ারদের বল্লম। বিঁধেছিল জোরাবার সিংয়ের বুকে। তিব্বতের ঊষর বুকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন জোরাবার। শোনা যায়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন তিব্বতী সেনা জোরাবার সিংয়ের হৃদপিণ্ড কেটে বের করে নিয়েছিল পাছে অলৌকিক ক্ষমতাযুক্ত জোরাবার সিং আবার বেঁচে ওঠেন। জোরাবার সিংয়ের মুন্ডু নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লাসায়। জনগণকে দেখানোর জন্য।
তিব্বতীরা তাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা শত্রুকে সম্মান জানিয়েছিল একটি স্মৃতিসৌধ বা চোর্তেন বানিয়ে। তাকলাকোটে আজও তা সিং-বা চোর্তেন নামে খ্যাত। কিন্তু অপরাজেয় হয়েও ভারতবাসীর কাছে প্রায় অপরিচিত এই রাজপুত বীর জোরাবার সিং কাহলুরিয়া। বিশ্বের ইতিহাসবিদরা যাঁকে আখ্যা দিয়েছেন ভারতের নেপোলিয়ন।