সেই হাওয়ার তেজ। সেই যন্ত্রণাকাতর মুখচোখ। অলিম্পিক্সে তিরন্দাজি নিয়ে স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি অব্যাহত।
পি ভি সিন্ধু এবং নিখাত জ়ারিনের বিদায়ের জোড়া ধাক্কার পরের দিন হঠাৎ করেই তিরন্দাজিতে পদকের আশা তৈরি হয়েছিল। অঙ্কিতা ভকত ও ধীরজ বোম্মাদেবরার মিক্সড ডাবলস দল পৌঁছে গিয়েছিল সেমিফাইনালে। কিন্তু ঐতিহাসিক স্যেন নদীর তীরে ইতিহাস তৈরি করা হল না তাঁদের। বরং বুদবুদের মতো ভেসে উঠে সেই আশা দ্রুত মিলিয়ে গেল। সেমিফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হারার পরে ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে তাঁরা পরাভূত হলেন আমেরিকার কাছে। সেই চারের কাঁটায় ফের রক্তাক্ত ভারতীয় অলিম্পিক্স স্বপ্ন। মিলখা সিংহ, পি টি উষা, জয়দীপ কর্মকারদের পরে অঙ্কিতাদের তিরন্দাজি দল।
অঙ্কিতা কলকাতার মেয়ে কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করেন ঝাড়খণ্ডের। ইতিহাসের কাছাকাছি পৌঁছেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে হল তাঁকে। অলিম্পিক্সে তিরন্দাজিতে আজ পর্যন্ত কেউ সেমিফাইনালে পৌঁছয়নি। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে অঙ্কিতাদের আজ তিরস্কারের চেয়ে হাততালিই বেশি প্রাপ্য। তবু এত কাছে এসে পদক হারানোর খচখচানি তো থাকবেই। মিক্সড জ়োনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় অঙ্কিতার মুখচোখে অন্ধকার। কোনও রকমে বললেন, ‘‘চেষ্টা করেও পারলাম না। একটা শিক্ষা হল। মন খারাপ তো লাগবেই। তবে চেষ্টা করব, শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসার।’’ ধীরজ বললেন, ‘‘হাওয়াকে বশ মানাতে পারলাম না।’’ কিন্তু বারবার হাওয়াকে বশ মানাতে না পারার কথা উঠছে কেন? রণনীতিতে কি কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে? জিজ্ঞেস করায় তাঁর জবাব, ‘‘হাওয়ার উপরে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। কখন এলোমেলো ভাবে বইবে, কখন জোরে বাতাস বইবে, কে বলতে পারে। কিন্তু এটা নিয়েও সন্দেহ নেই যে, আমাদের আরও বুঝতে হবে, শিখতে হবে কী ভাবে হাওয়াকে হার মানাতে হয়।’’ তিরন্দাজিতে সেরা দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে দারুণ তির ছুড়েছিলেন অঙ্কিতা। কিন্তু ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে সেই ছন্দ ধরে রাখতে পারলেন না। বড় মঞ্চে হাত কেঁপে যাওয়াও কি একটা কারণ? ময়নাতদন্তে সেটাও খুঁজে দেখা দরকার।
আমেরিকার কেসি কফোল্ড ও ব্র্যাডি এলিসন ব্রোঞ্জ জিতলেন। রুপো জিতল জার্মানি। আর সোনাজয়ী যথারীতি দক্ষিণ কোরিয়া। প্যারিসেও তাদের কেউ ছুঁতে পারছে না। টানা তিনটি অলিম্পিক্সে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে। একটা পরিসংখ্যান দেখলাম যে, ১৯৮৪ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া ব্যক্তিগত ইভেন্টে অংশ নিচ্ছে। ১৯৮৮ থেকে টিম ইভেন্টে। প্যারিসে শুক্রবার পর্যন্ত স্কোরকার্ড ধরে সব রকম তিরন্দাজি ইভেন্ট মিলিয়ে তারা শুধু সোনাই জিতেছে ৩০টি। এ ছাড়াও রয়েছে ৯টি রুপো, ৭টি ব্রোঞ্জ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা আমেরিকাও অনেক দূরে। এখনও পর্যন্ত তাদের ঝুলিতে ১৪টি সোনা। তৃতীয় স্থানে বেলজিয়াম, ১১টি সোনা। এর পরে যারা আছে, সর্বোচ্চ ৭টি সোনা জিতেছে। বোঝাই যাচ্ছে, তিরন্দাজিতে দক্ষিণ কোরিয়া মানে ক্রিকেটে আশির দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অথবা স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়া। নাকি পেলের ব্রাজিল বলা উচিত?
সেই জায়গায় ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে? আজ পর্যন্ত পদকের ধারেকাছে যায়নি কখনও। সেই লিম্বারামের সময় থেকে হাওয়ার কাহিনি চলছে। তবু অঙ্কিতা-ধীরজদের প্রশংসা করতে হবে যে, তাঁরা দারুণ লড়াই করলেন। গ্যালারিতে যদিও তেমন ভারতীয় সমর্থন চোখে পড়ল না। এক-এক সময় মনে হচ্ছে, যদি আর একটু জনবল থাকত! কে জানে, অসম্ভবকে সম্ভব করেও ফেলতে পারতেন তাঁরা।
টিম ইভেন্টে বিপর্যয়ের পরে যে ভাবে সমাজমাধ্যমে এক-এক জন ট্রোল্ড হচ্ছিলেন, তার পরে পদক জিততে পারলে যোগ্য জবাবও দেওয়া হত। বিশেষ করে দীপিকা কুমারী এবং অঙ্কিতাকে যেন খলনায়িকা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দু’জনেই টিম ইভেন্টের ব্যর্থতা মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। এ দিন মিক্সড জ়োনে আসতেই অপেক্ষমান ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ধীরজ ও অঙ্কিতাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল। দীপিকা ব্যক্তিগত ইভেন্টে শেষ ষোলোয় পৌঁছেছেন। তাঁর পরীক্ষা শনিবার।
তিরন্দাজিতে দক্ষিণ কোরিয়ার আধিপত্য নিয়ে নানা কাহিনি বাজারে রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, চপস্টিক ব্যবহার করে খাবার খাওয়ার জন্য তাঁদের হাতের আঙুল নাকি তিরন্দাজির জন্য তৈরি হয়ে যায়। কেউ বলেন, স্কুলে নাকি রুটিনের মধ্যে ‘আর্চারি’ থাকে। তাঁদের দেশের এক সাংবাদিকের শোনা গেল, দু’টোর কোনওটাই ঠিক নয়। চপস্টিক যদি কারণ হত, তা হলে চিন বা জাপানও তো ভাল করত। স্কুলেও মোটেও ছোট বয়স থেকে তিরন্দাজি শেখানো হয় না। বরং দু’তিনটে জিনিস জানা গেল, যা অন্যান্য দেশের বিশেষ করে ভারতের চোখ খুলে দিতে পারে। যেমন, অতীত আঁকড়ে তারা পড়ে থাকে না। এই প্যারিস অলিম্পিক্সে যাঁরা সোনা জিতছেন, তাঁরা পরবর্তী অলিম্পিক্সে বিনা পরীক্ষায় ঢুকে পড়তে পারবেন না। যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এবং সেই যোগ্যতা অর্জনের পরীক্ষা অলিম্পিক্সের চেয়েও কঠিন। কারণ, এখানে অন্য দেশের তিরন্দাজ যাঁরা আসছেন, তাঁদের চেয়ে ঢের ভাল তিরন্দাজ তাঁদের দেশে পড়ে আছেন। দশ বছর আগে তিরন্দাজিতে বিশেষ ট্রেনিং প্রকল্প চালু করেছে তারা। সেখানে প্রথম ছয় মাস শুধু শারীরিক সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ চলে। থিয়োরি ক্লাস চলে। এই ছয় মাস কেউ তির-ধনুক হাতেও তুলতে পারবেন না।
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তির-ধনুক হাতে অর্জুনের পাখির চোখকে নিশানা করার কাহিনি কত বছর ধরে ভারতীয়দের জানা। অথচ, আজ পর্যন্ত লক্ষ্যভেদ করে অলিম্পিক্সে ‘মহা-ভারত’ হয়ে ওঠা গেল না। এশিয়ারই আর একটা দেশ দক্ষিণ কোরিয়া কত আগে বেরিয়ে গেল!