হাওড়ার বস্তিতে মোগলদের ‘শেষ’ বেগম! লাল কেল্লার ভাগ চেয়ে আদালতে যাওয়া সুলতানার জীবন নিয়ে ছবি

বস্তির ঘরে আলো খুব কম আসে। ফোনের নেটওয়ার্ক তো বেশির ভাগ সময়েই থাকে না। বললেন শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বংশের বেগম সুলতানা। একটানা বেশি হাঁটতেও পারেন না। হাঁটুতে বড় যন্ত্রণা। কিন্তু উপায় নেই। তা নিয়েই বস্তির ভিতরের জল-কাদা পার হয়ে রাস্তার কল থেকে জল আনতে হয় মোগল বংশের ‘বর্তমান’ বেগমকে।

গৌরবময় তাঁর বংশপরিচয়। সেই পরিচয়ে ভর করেই সুলতানা মনে করেন দিল্লির লাল কেল্লায় ‘ভাগ’ রয়েছে তাঁর। যদিও থাকেন তিনি হাওড়ার ফোরশোর রোডের কাছে গঙ্গা-ঘেঁষা এক বস্তিতে। কষ্টের দিন গুজরান হলেও সম্প্রতি অনেকটা আলোর মতো এক খবর পেয়েছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন কলকাতার এক পরিচালক। কথাবার্তা পাকা। সুলতানা বললেন, ‘‘শুটিংয়ের সময়ে দিল্লি নিয়ে গেলে এক বার লাল কেল্লা ঘুরে আসব। ওটা তো আমাদের বংশেরই।’’

দারিদ্র থাকলেও বংশগৌরবে ধনী সুলতানা।

মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর এবং তাঁর বংশধরদের খোঁজখবর ছবিতে তুলে ধরতে চান পরিচালক সৌম্য সেনগুপ্ত। প্রযোজক ইন্দ্রনীল বিশ্বাসের ভরসায় তাড়াতাড়ি ছবির শুটিং শুরু করতে চান সৌম্য। আগেও তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। ‘সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে’ বিশ্বাসকে প্রচার করে ‘পাগল’ খেতাব পাওয়া হাওড়ার কেসি পালকে নিয়ে সৌম্য বানিয়েছিলেন ‘দ্য জিওসেন্ট্রিক ম্যান’ নামে ছবি। এর পরে ভারতের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের বিচারক জয়িতা মণ্ডলকে নিয়ে বানান ‘আই অ্যাম জয়িতা’। সেই দু’টির মতো এ বারেও ওটিটি প্লাটফর্মের কথা ভেবেই বানাতে চান ‘দ্য লস্ট কুইন’। সৌম্য বলেন, ‘‘ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে তাঁকে ‘হিন্দুস্থানের স্বাধীন বাদশাহ’ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ইতিহাস অনেকের জানা থাকলেও বাদশাহের উত্তরসূরিদের খোঁজ রাখে না কেউ। সেই কারণেই সুলতানাকে নিয়ে ছবি বানানোর ভাবনা। খুব তাড়াতাড়িই শুটিং শুরু করার ইচ্ছা আছে।’’

হাওড়াবাসী সুলতানার খবর সে ভাবে কেউ না রাখলেও বছর তিনেক আগে তিনি ভারত সরকারের বিরুদ্ধেই একটি মামলা করে শিরোনামে এসেছিলেন। আদালতে দাবি করেছিলেন, লাল কেল্লায় তাঁদের অংশের ক্ষতিপূরণ চাই। দিল্লি হাইকোর্ট সেই মামলা গ্রহণই করেনি। ওই মামলা নেওয়া মানে ‘সময় নষ্ট’ জানিয়ে খারিজ করে দেওয়া হয় সুলতানার দাবি। তা বলে দমে যাননি সুলতানা। বললেন, হাঁটুর ব্যথায় এখন ওঠাবসাও কষ্টের। হাতে কিছু টাকাপয়সা এলে চিকিৎসা করিয়ে আবার মামলা করবেন। নতুন আইনজীবী নেওয়ারও ইচ্ছা রয়েছে।

প্রযোজক ইন্দ্রনীল বিশ্বাস ও পরিচালক সৌম্য সেনগুপ্তের সঙ্গে সুলতানা বেগম।

কিন্তু লাল কেল্লার ‘ভাগ’ কেন চান তিনি? সুলতানা বললেন, ‘‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সব রাজবংশেরই বড় বড় প্রাসাদ রয়েছে। অনেক টাকা পেনশন। কিন্তু আমাদের কিছুই দেওয়া হয়নি।’’ রাগত স্বরে বলে গেলেন, ‘‘যে বংশ তাজমহল বানিয়েছে, তারই লোক হয়ে আমি বস্তিতে থাকি!’’

প্রসঙ্গত, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ দমনের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারত শাসনের ভার সরাসরি ইংল্যান্ডের রানির হাতে চলে যায়। মোগল শাসনের চিহ্ন মুছে দিতে ভারত থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বাহাদুর শাহকে। তিনি তখন সহায়-সম্বলহীন সম্রাট। ঢাল, তরোয়াল, সেনাবাহিনী কিছুই নেই। বিদ্রোহ শেষ হওয়ার পর নয়া দিল্লির হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধ থেকে বাহাদুর শাহকে বন্দি করা হয়। বিচারের শেষে নির্বাসনের সাজা ঘোষণা হতেই গরুর গাড়িতে চাপিয়ে বাদশাহ ও তাঁর পরিবারের কয়েক জনকে ইয়াঙ্গন বা তৎকালীন রেঙ্গুনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নয়াদিল্লি থেকে অনেক দূরে ইয়াঙ্গন শহরে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয় শেষ মোগল সম্রাটের।

স্বামী মির্জা মহম্মদ বেদার বখ্তের সঙ্গে সুলতানা বেগম।

বাহাদুর শাহের পুত্র জওঁয়া বখ্ত, পৌত্র জামশেদ বখ্ত আর প্রপৌত্র মির্জা মহম্মদ বেদার বখ্ত। পরবর্তী কালে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে বাংলায় চলে আসেন বেদার বখ্‌ত। বাহাদুর শাহের বংশধর বেদার বখ্‌তের বিধবা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের থেকে ‘সুলতানা’ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। মাসে মাসে ছ’হাজর টাকা পেনশন পান তিনি। ১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পরে পেতেন ৪০০ টাকা। এখন তার পরিমাণ বেড়েছে। তবে শেষ বার বেড়েছিল সেই ২০১০ সালে। সে-ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলের কাছে দরবার করার পরে। এখন তাঁর বড় অর্থের টানাটানি। সুলতানা বললেন, ‘‘মাথার কাপড় ঢাকতে গেলে পা বেরিয়ে যায়। আর পা ঢাকতে গেলে মাথা। ওইটুকু টাকায় হয় নাকি!’’

তাঁকে নিয়ে সিনেমা হবে শুনে চার মেয়ে, এক ছেলের মা সুলতানা প্রথমে দোনামোনায় ছিলেন। কারণ, বছর কয়েক আগে মুম্বইয়ের এক পরিচালক তাঁকে নিয়ে ছবি বানাতে শুটিং করেছিলেন। দিল্লিও নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘আখরি মহল’ নামে সেই ছবি মুক্তি পেয়েছিল কি না জানা নেই সুলতানার। তবে এখন সুলতানা নিশ্চিন্তে। শুনেছেন, এ বার ছবিটা মোবাইল ফোনে দেখতে পাওয়া যাবে।

অভাব আছে। তা নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে। তবে তার চেয়ে বেশি অহঙ্কার রয়েছে সুলতানার। শুধু সম্রাট হিসাবে নয়, কবি এবং সংস্কৃতি অনুরাগী হিসাবেও সুনাম ছিল বাহাদুর শাহের। ধর্মের বাছবিচারও ছিল না। এখন দিল্লিতে লাল কেল্লার সামনের মাঠে বিজয়া দশমীর দিনে যে রামলীলা হয়, তার সূচনাও করেছিলেন বাহাদুর শাহ। এ সব নিয়ে গর্ব তো রয়েইছে। সেই সঙ্গে সুলতানা শোনালেন অন্য অহঙ্কারের কথাও। বললেন, ‘‘তখন তিনি ইংরেজদের কথা শুনলে এখন বস্তির বদলে আমরা হয় তো প্রাসাদেই থেকে যেতাম। সেটা অনেকেই করেছিল। কিন্তু বাহাদুর শাহ অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেননি। তাই আমাদের কেউ গদ্দারের বংশ বলতে পারবে না। এখনও আমরা সম্মান পাই।’’

স্বামীর মৃত্যুর পরে কখনও চুড়ি তৈরির কারখানায়, কখনও দিনমজুর হিসাবে, কখনও চায়ের দোকানেও কাজ করেছেন। এখন পেনশনের অল্প টাকা থেকেই কিছু কিছু জমাচ্ছেন সুলতানা। আবার সুপ্রিম কোর্টে মামলা করতে চান লাল কেল্লার ক্ষতিপূরণ চেয়ে। ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিদের যেন তাঁর মতো কষ্টে না বাঁচতে হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চান তিনি।

নিজের চিকিৎসার জন্যও অর্থের দরকার। তবে রাজ্য সরকারের বিধবা ভাতা নেন না। মোগলদের শেষ বেগম সে টাকা নিতে ভয় পান। ভয়মেশানো গলাতেই প্রশ্ন করলেন, ‘‘এই এক হাজার টাকা নিলে দিল্লির টাকাটা বন্ধ হয়ে যাবে না তো?’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.