৪৪ বছর কেটে গেল, উত্তমকুমার নেই! এখনও ভাবলে মনে হয়, এই তো সে দিনের কথা। উত্তমবাবু হয়তো সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু আজও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। বাংলা ছবি, আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এবং সর্বোপরি বাঙালির মনে আজও তিনি উপস্থিত।
মনে আছে, উত্তমবাবুর শেষযাত্রায় অনুরাগীরা চিৎকার করে একটাই কথা বলছিলেন, ‘‘উত্তম তোমাকে ভুলব না।’’ সত্যিই আজও বাঙালি তাঁকে ভুলে যায়নি। আমার মনে হয়, একজন অভিনেতাকে শুধু তাঁর অভিনয় নয়, আরও বহু কারণে মানুষ মনে রাখেন। উত্তমবাবুও সেই পর্যায়ের একজন অভিনেতা। ছবি বিশ্বাস, নরেশ মিত্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, শিশিরকুমার ভাদুড়ি— বহু মানুষকে দেখেছি। কিন্ত প্রয়াণের পরেও তাঁদের স্মৃতি সেই ভাবে মানুষের মনে নেই। সেখানে চলে গিয়েও উত্তমকুমার আমাদের হৃদয়ে কেন জীবিত রয়েছেন, আজকে সেই দিকটাই আগে আপনাদের জানাই।
সুপারস্টার হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কথাও উত্তমকুমার ভাবতেন। খরা বা বন্যার সময় দেখেছি, শিল্পীদের নিয়ে রাস্তায় নেমে ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। সেই টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অবলীলায় দান করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর দলবিচার তিনি কখনও করেননি। ১৯৭৮ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলার ত্রাণের জন্য ইডেন গার্ডেন্সে মুম্বইয়ের শিল্পীদের সঙ্গে চ্যারিটি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। সেখানেও ছিলেন উত্তমকুমার। যে টাকা উঠেছিল, তা তিনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
একটা ছোট্ট ঘটনা আপনারা জানলে বুঝতে পারবেন, মানুষ হিসেবে উত্তমবাবু ছিলেন অতুলনীয়। স্টুডিয়োর মেকআপ রুমে উত্তমবাবু এসেছেন। সাধারণত তিনি আসার আগেই সকলে প্রস্তুত থাকতেন। সে দিন রূপটান শিল্পী একটু দেরি করে এলেন এবং ক্ষমা চাইলেন। উত্তমবাবু বললেন, ‘‘ক্ষমা তো করলাম। কিন্তু তোর মুখটা এ রকম দেখাচ্ছে কেন?’’ শিল্পী বেশ কিছু ক্ষণ চুপ। তার পর তিনি আমতা আমতা করে বললেন যে, এক মাস পর তাঁর মেয়ের বিয়ে। সব কিছু তৈরি, কিন্তু পণের টাকা জোগাড় করতে পারেনি। টাকার পরিমাণ ৫ হাজার। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ওই টাকার মূল্য অনেক। এখনও মনে আছে উত্তমবাবু কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘‘সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একদম চিন্তা করিস না। তুই মেকআপ শুরু কর।’’ ঠিক এক মাস পর মেকআপ শিল্পীর মেয়ের বিয়ের দিন গিয়ে তিনি সেই টাকা নিজের হাতে দিয়ে এসেছিলেন।
মনে আছে, এক বার প্রোডাকশনের সহকারীদের একটা ছবি করে দেবেন বলে এককথায় তিনি রাজি হয়ে যান। চার দিন ডেটও দেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার অল্প দিন আগেই তিনি প্রয়াত হলেন। প্রোডাকশনের একটি ছেলের এক বার বাড়ি নিয়ে কোনও সমস্যা হয়। মনে আছে, উত্তমবাবু তাঁকে এককথায় নিজের টাকা দিয়ে জমি কিনে দেন। শুনেছি, তাঁর পরিবার এখনও সেখানে বাড়ি করে রয়েছেন। কিন্তু সেই উত্তমকুমারকেই কি মানুষ যোগ্য সম্মান দিয়েছেন? প্রয়াণের পর তাঁর মরদেহ কিন্তু রবীন্দ্রসদনে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি!
উত্তমবাবুর সঙ্গে ছ’টা ছবিতে অভিনয় করেছি। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের স্মৃতি এখনও টাটকা। ‘থানা থেকে আসছি’র শুটিং শুরু হয়েছে। ছবিতে তাঁর সঙ্গে আমার কোনও দৃশ্য ছিল না। এক দিন একই সঙ্গে আগে-পরে দু’জনের শুটিং। পরিচালক পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে উত্তমবাবু বললেন, ‘‘ম্যাডাম বসুন।’’ বসার পর তাঁকে বললাম, “দেখুন, প্রত্যেক মানুষেরই একটা নাম থাকে। আমার নাম মাধবী। দয়া করে আমাকে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করবেন না। ওটা তো দেশীয় নয়।’’ শুনে হেসে ফেললেন। বললেন, ‘‘ঠিক, আমি আপনাকে মাধবী বলেই ডাকব।’’ সেই যে সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটল, তার পর মাধবী থেকে কবে যে তাঁর কাছে ‘মাধু’ হয়ে গেলাম, তা বলা কঠিন।
শুটিংয়ের সময় উত্তমবাবু একটা নিয়ম চালু করেছিলেন। খবরের কাগজে মুড়ি ঢেলে নানা রকমের তেলেভাজা দিয়ে খাওয়া। অভিনেতা, পরিচালক থেকে শুরু করে টেকনিশিয়ান— সবাই পালা করে মুড়ি-তেলেভাজা খাওয়াবেন। এক দিন উত্তমবাবুর পালা, এক দিন আমার। কোনও বিভেদ থাকবে না, ফ্লোরে ছোট থেকে বড়— প্রত্যেকে একসঙ্গে বসে ওই খাওয়া এবং আড্ডার মধ্যে দিয়ে একটা পারিবারিক অনুভূতি তৈরি হত। এটা কিন্তু উত্তমবাবু নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। কখনও আউটডোরে গেলে সুপ্রিয়াদেবী রান্না করতেন। আর আমরা তিন জন একসঙ্গে বসে খেতাম। সেই সব দিনের স্মৃতি আজও আমার মনে উজ্জ্বল।
উত্তমবাবু ছিলেন প্রকৃত মহানায়ক। যেখানে যেতেন, তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য মানুষের ভিড়। কত অভিজ্ঞতার সাক্ষী থেকেছি! এই প্রসঙ্গে উত্তমবাবুর সঙ্গে আউটডোরের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। জগৎবল্লভপুরে ঢুলুদার (পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়) ‘অগ্নিশ্বর’ ছবির শুটিং চলছে। উত্তমবাবুর নাম শুনে এলাকার সকলেই বলছেন যে, তাঁদের বাড়িতে শুটিং করতে হবে। শেষ পর্যন্ত একটা বাড়ি স্থির করা হল। শুটিং শেষ হতে না হতেই দেখলাম, যাঁর বাড়ি, তিনি প্রায় কাঁদতে কাঁদতে হাজির। আমরা তো অবাক! অভিযোগ করলেন, মালিদের দিয়ে নতুন বাগান করিয়েছিলেন। কিন্তু উত্তমবাবুকে দেখার জন্য এলাকার মানুষের ভিড়ে সাধের বাগান নাকি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
আমার বিয়েতে উত্তমবাবু শুরু থেকে ছিলেন। আমাকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি বরকর্তা হয়ে আসবেন। তবে দাবি ছিল, এসে লুচি খাবেন। আর সেই লুচি যেন সর্ষের তেলে ভাজা হয়। কথা রেখেছিলেন উত্তমবাবু। বিয়ের দিন সকালে এসে বললেন, ‘‘কী কন্যে, ভয় করছে নাকি?’’ আমি বললাম, “না।” সুপ্রিয়াদেবীকে সঙ্গে নিয়ে আমার বিয়ে এবং বৌভাতে এসেছিলেন উত্তমবাবু।
উত্তমবাবু কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির জন্যেও বহু কিছু করেছেন। একসময়ে ‘অভিনেতৃ সংঘ’-এর সভাপতি ছিলেন উত্তমবাবু। তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছিল ‘শিল্পী সংসদ’। আবার সংস্থা প্রযোজিত ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিটি পরিচালনার পাশাপাশি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। সেও এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রির সেরা শিল্পীদের তিনি নির্বাচন করলেন। আমিও সুযোগ পেলাম। শুটিংয়ের পর দেখা গেল ছবির দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ৪ ঘণ্টা। সবাই বললেন ২ ঘণ্টা বাদ দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু, তিনি রাজি হলেন না। তাঁর দাবি ছিল, সকলে তাঁর প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছেন, তাঁকেও তা ফিরিয়ে দিতে হবে। দৃশ্য কাটা যাবে না। শেষ পর্যন্ত মনে হয়, প্রায় ৩ ঘণ্টার ছবি তৈরি হল। ছবি সুপারহিট হল। প্রচুর ব্যবসা করে সেই ছবি।
২৪ জুলাই, ১৯৮০। উত্তমবাবুর মৃত্যদিন। সে দিনের কথা না বললেই নয়। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে নিমেষে যেন এক গভীর ঘন কালো মেঘ ঢেকে দিল। আমি তখন কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘না’ নাটকটি করি। মনে আছে, রাত সাড়ে ন’টার দিকে বাড়ি ফিরতেই লালবাজার থেকে ফোন। ফোনের ও পারে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনার বাড়িতে কি কোনও গুন্ডা এসে উৎপাত করেছে?’’ আমি তাঁকে জানালাম যে, গুজব। ফোন রাখার আগেই তিনি জানালেন, উত্তমকুমার নাকি প্রয়াত হয়েছেন! আমি বিশ্বাস করিনি! দুটো খবরই গুজব ভেবে ফোন রেখে দিলাম। তার কিছু ক্ষণ পর পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় ফোন করলেন। বললেন, ‘‘মাধু, উতু আর নেই!’’ তার পর আর বিশ্বাস না করার কোনও অবকাশ ছিল না। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। মনটাও ভারি খারাপ হয়ে গেল।
পরদিন সকালে আমি উত্তমবাবুর গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে পৌঁছলাম। থিক থিক করছে ভিড়। মরদেহ রাখা। ওই প্রথম তাঁকে ওই ভাবে দেখে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। উত্তমবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম, শীতল দুটো পা। এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছি। মৃণাল সেন এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘মাধবী শোনো, একটা কথা বলি।’’ আমি বললাম, “বলুন।” তিনি বললেন, ‘‘দেখো, আমরা তো সবাই এখানে। এক বার দেখো না, বেণু কী করছে।’’ উনি আমাকে সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে যেতে বলছেন কি না, জানতে চাইলাম। তখন মৃণালদা বললেন, ‘‘হ্যাঁ। কারণ, আমরা সবাই এখানেই রয়েছি। ওর কাছে মনে হয় কেউ নেই।’’ আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সোজা ময়রা স্ট্রিটে সুপ্রিয়া দেবীর বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
সত্যিই সে-ও এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। মন শক্ত করে বাড়িতে ঢুকলাম। দেখলাম তিনি এক জায়গায় চুপ করে বসে রয়েছেন। চোখের দৃষ্টি স্থির। কোলে একটি বাচ্চা। নাতি কিংবা নাতনি হবে। এখন ঠিক মনে পড়ছে না আমার। অনেক ক্ষণ একজন মানুষ কান্নাকাটি করার পর যে অবস্থা হয়, সুপ্রিয়া দেবীকেও তখন আমার সে রকমই মনে হল। আমাকে শুধু বললেন, ‘‘বোস।’’ দু’জনেই চুপ করে বসে থাকলাম। একটা কথাও বলতে পারলাম না। কত ক্ষণ যে ওই ভাবে কেটে গেল, আমি নিজেও জানি না। তার পর একসময়ে অনুমতি নিয়ে চলে এলাম।
উত্তমবাবু ছিলেন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। একজন উদার মনের মানুষ। সব সময় বলতেন, ‘‘আগে আমাকে মানুষকে ভালবাসতে হবে। আমি ভালবাসলে,তার পর তো তাঁরা আমাকে ভালবাসবেন!’’ সারা জীবন তিনি এই আদর্শ মেনে চলেছেন। আমিও সেটা তাঁর থেকেই শিখেছি। দু’হাত ভরে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। ইন্ডাস্ট্রির জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। বাংলা ছবি এবং ইন্ডাস্ট্রি যত দিন থাকবে,সেখানে উত্তমকুমার উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বিরাজ করবেন।