এই প্রজন্মের মনে গুরুদেব বা তাঁর মহিমা কতটা প্রভাব ফেলে? জানি না। শুধু নতুন প্রজন্মের কথা বলব কেন? আমার মা অমলাশঙ্কর-ই অবিশ্বাসী ছিলেন! ফলে, একটা সময় পর্যন্ত তিনি গুরুদেব বা গুরু আরাধনা বিষয়টি মাথাতেও আনতেন না। অথচ আমাদের গুরুদেব সত্য সাঁইয়ের সঙ্গে কিন্তু তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। ওঁর কৃপাতেই প্রথমে মা ওঁর অনুগামী হন। তার পর একে একে আমরা। বহু বছর আমাদের আরাধ্য গুরুদেব প্রয়াত। ওঁর প্রভাব তবুও আমাদের সংসারে অসীম। অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা ওঁকে ঘিরে আমাদের জীবনে ঘটেছে। এখনও অনুভব করি, দেহত্যাগের পরেও যেন ছুটি হয়নি ওঁর। প্রতি মুহূর্তে আমাদের আগলে রেখেছেন। বরং আমার মন কোনও কারণে সত্য সাঁইয়ের উপর থেকে উঠে গেলে অবসাদে ভারী হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর কাছে ক্ষমা চাই। আসলে নিজের মনকে শাসন করি। অমনি অদ্ভুত আনন্দে মন পরিপূর্ণ, শান্ত হয়ে যায়।
মায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার কথা বলি। গুরুদেবকে মা বলেছিলেন, “আপনার পুজো কী করে করতে হয় জানি না। তাই পুজোও হয় না।” গুরুদেব সে দিনই জানিয়েছিলেন, তাঁকে স্মরণ বিশেষ কোনও বিধি নেই। নিরামিষ খেতে হবে না। বাজার থেকে প্রচুর দামি মালা ফুল, মিষ্টি— কিছুই আনতে হবে না। চোখের জলই গঙ্গাজল। পবিত্র মনই তুলসীপাতা। তাঁর পায়ে নিজেকে নিবেদন মানেই পুষ্পাঞ্জলি। প্রত্যেক গুরু পূর্ণিমায় এ ভাবেই আমরা ওঁকে স্মরণ। অবশ্যই আমার ছেলে-বৌমারা নিজেদের মতো করে তাঁকে সাজায়। সবটাই হয় আন্তরিক ভাবে। যদিও গুরুর কড়া নির্দেশ, মন থেকে সবাইকে ভাল হতে হবে। লোকের প্রশংসা শোনার জন্য নয়। যে দিন থেকে সত্য সাঁইয়ের সংস্পর্শে এসেছি, সে দিন থেকে তাঁর এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানার চেষ্টা করি।
অনেকেই গুরুদেবকে নিয়ে অলৌকিক ঘটনার কথা জানতে চান। দু’টি ঘটনার কথা বলি?
আমি এক বার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কোমরে মারাত্মক স্নায়বিক যন্ত্রণা। সারা শরীর অবশ। বাধ্য হয়ে মায়ের কাছে গিয়ে উঠেছি। কারণ, মায়ের বাড়িতে লিফট রয়েছে। তখনও মা গুরুদেবের অনুগামী নন। ওই সময় গুরুদেবকে স্মরণ করে বলে ফেলেছিলাম, বাবা! আর পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে। মিরাকল ঘটেছিল। দেশ-বিদেশ থেকে তার আগে চিকিৎসা করিয়েছি। কোনও চিকিৎসক ব্যথা কমাতে পারেননি। সত্য সাঁইকে দূর থেকে স্মরণ করতেই ব্যথা উধাও।
আর একটি বিষয় আমার খুব অদ্ভুত লাগে। আমার বাড়িতে গুরুদেবের একটি ছবি রয়েছে, সেটি বাঁধানো নয়। অনেক বার বাড়ি বদলেছি। অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি। গুরুদেবের ছবি কিন্তু প্রত্যেক বার আমার সঙ্গে থেকে গিয়েছে।
এ যুগে গুরুদেব নিয়ে অনেক রটনা, অনেক গুঞ্জন। হয়তো অনেক অবিশ্বাস। আমার বিশ্বাস টলেনি। বিশ্বাস টলেছে এখনকার মানুষের উপর। তার পরেও গুরু কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সামলাচ্ছেন। যেমন দেখুন, শাড়ি পরার ধরন নিয়ে কত বিতর্ক। অভিনয় দুনিয়া থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেই কটাক্ষ করেছেন। স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও রয়েছেন সেই তালিকায়। সম্প্রতি, বিদেশে আমরা সকলে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। হোটেলে আমার পাশের ঘরে ওর ঘর। মুখোমুখি হতেই প্রথমে অল্প হেসে চলে যাচ্ছিল। ডেকে বললাম, “কী রে! আদর করবি না?” সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে টিপ পরালো। অশান্তি মুছে আমরা আবার এক।
গুরুদেব না থাকলে এতটাও কি হত?
বহু বছর ধরে আমি নৃত্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। আমার মা-বাবা নৃত্যশিল্পী। তাঁরাই আমার গুরু। আবার প্রতি বছর অজস্র শিশু আমার কাছে আসে। বছরের পর বছর তারা নাচ শেখে, একসময় বড় হয়ে যায়। এই যাত্রাপথের সাক্ষী আমি। ওরা হয়তো ভাবে আমি গুরু। কিন্তু সত্যিই কি আমি গুরু? হয়তো জীবনের পথে খানিকটা আলো জ্বালতে পারি। আমার ছাত্রছাত্রীদের তাই সব সময় বলি, ভাল নাচতে পারা, ভাল শিল্পী হওয়াই বড় কথা নয়। ভাল মানুষ হতে হবে। আমার গুরুর নির্দেশ মতো পবিত্র মন তৈরি করার কথাই ওদের বলি।
গুরু পূর্ণিমায় কিছু অনুষ্ঠান আমার ছাত্রছাত্রীরা করে। প্রতি বছর নতুন নতুন চমক থাকে। আমি সত্যিই জানি না এই সম্মানের যোগ্য আমি কি না! তবে ওদের মুখের হাসি, ওদের জীবনের সাফল্য আমায় ভিতর থেকে পূর্ণ করে। এ টুকুও গুরুর আশীর্বাদ।