বিপাকে ‘দামাল’ জামাল! সোনারপুর থানায় দায়ের নয়া অভিযোগ, কচ্ছপ দেখে পদক্ষেপ করছে বন দফতরও

পুলিশের কাছে তিনি এখন ‘পলাতক’। খোঁজ চলছে। তার মধ্যে বুধবার সোনারপুর থানায় জামালউদ্দিন সর্দারের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ দায়ের হল। জামালের গ্রামেরই এক পরিবার তাঁর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়েছে। প্রতাপনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা ওই পরিবারের দাবি, জামালের ‘আতঙ্কে’ এত দিন তারা কোনও অভিযোগ জানাতে পারেনি। পাশাপাশি, জামালের বাড়ির সুইমিং পুলে কচ্ছপ মেলায় তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করছে বন দফতরও।

গত ৭ জুলাই জামালের বিরুদ্ধে সোনারপুর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের হয়। সেখানে সালিশি সভার নামে পায়ে শিকল বেঁধে এক মহিলাকে মারধর করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। ইতিমধ্যে ওই ঘটনায় জামালের দুই সঙ্গী মুজিদ খাঁ এবং অরবিন্দ সর্দারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার ওই দু’জনকে পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

জামালের খোঁজে যখন তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ, তখনই দায়ের হয়েছে নতুন অভিযোগ। অভিযোগকারিণীর নাম রুবিজান বিবি। জামালের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, মারধর, হেনস্থা এবং তোলাবাজির চেষ্টার। তিনি অভিযোগ করেছেন, সালিশি সভায় ডেকে তাঁর স্বামীকে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে মারধর করা হয়েছিল। স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করায় তাঁকেও মারধর করেন জামালের লোকজন। চাওয়া হয় টাকা। রুবিজানের অভিযোগ, টাকা দেওয়ার পরেও শিকল দিয়ে বেঁধে তাঁকে মারধর করা হয়েছিল। জামাল চেয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। শেষমেশ পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিষ্কৃতি মেলেনি। মাস দেড়েকের মধ্যে বাকি ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন জামাল। রুবিজানের স্বামী জানান, তাঁদের পারিবারিক একটি গন্ডগোল হয়েছিল। সেই কারণে এক দিন রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান জামালের লোকজন। কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াননি বলে এত দিন মুখ বুজে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘জামাল একা নয়, মুজি, উসমান, অরবিন্দ নামে চার জন আমায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রিলে বেঁধে মারধর করেছিল। উল্টো করে ঝুলিয়ে মেরেছে।’’ ওই দম্পতি এ-ও জানিয়েছেন, সোনারপুর দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক লাভলি মৈত্র তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দেওয়ায় সাহস করে তাঁরা থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। পাশাপাশি বুধবার রুবিজানের বাড়িতে যান সিপিএম নেতা সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় আইনজীবী সায়ন ওই পরিবারকে আইনি সহায়তার আশ্বাস দেন।

অন্য দিকে, জামালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি, তোলাবাজি এবং খুনের চেষ্টার মামলা রুজু করে পুলিশকে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। সোনারপুর থানার একটি সূত্রে খবর, জামালের মোবাইলের লোকেশন ট্র্যাক করা হয়েছিল। সেখানে ভাঙড় পর্যন্ত জামালের গতিবিধির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ফোনটি সুইচড্ অফ পাওয়া যায়। মঙ্গলবার রাতেই অভিযুক্তের বাড়ি থেকে সিসিটিভির হার্ডডিস্ক সংগ্রহ করে পুলিশ। উদ্ধার হয় শিকলও। কী ভাবে মারধর করা হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর।

স্থানীয়েরা জামালকে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করেছে। যদিও তৃণমূল জানিয়েছে জামালের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। এক সময় মুহুরির কাজ করতেন ওই প্রৌঢ়। পরে ওই কাজের সূত্র ধরে বিভিন্ন থানার পুলিশের সঙ্গে তার চেনাজানা হয়। প্রায়ই তাঁকে দেখা যেত সোনারপুর থানাতেও। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে ভাল সম্পর্কের কথা বলে সবাইকে ‘চমকাতেন’ জামাল। বাড়িতে সালিশি সভা বসিয়ে বিচারের নামে ইচ্ছামতো নির্যাতন করতেন।

এখানেই শেষ নয়। জামালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত কোনও বিতর্ক দেখা দিলে তাতে নিজে থেকে তিনি ঢুকে পড়তেন। তাঁকে এড়িয়ে এলাকার কোনও জমি কেনাবেচা হত না। এ ভাবেই ক্রমশ ‘ধনকুবের’ হয়ে ওঠেন জামাল। প্রায় এক বিঘার বেশি জমির উপর ২০১৬ সালে তৈরি করেন বিশাল বাড়ি। সেই বাড়ির নিরাপত্তার জন্য ৫০টির বেশি সিসি ক্যামেরা বসান। যদিও ওই বাড়ি বৈধ কি না (জমি দখলের অভিযোগ আছে কি না), তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন প্রতাপনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দেবনাথ দত্ত।

জামালের বাড়ির পাশে গ্যারাজে দামি গাড়ি, বাইক রয়েছে। সম্প্রতি একটি ঘোড়াও কেনেন তিনি। বেঁধে মারধরের বিতর্ক সামনে আসার পর বাড়িতে পড়ে থাকা শিকল নিয়ে জামালের দাবি ছিল, ঘোড়া এবং গরু বাঁধতে কাজে লাগে সেটা। এখন জামালের বাড়ির সুইমিং পুলে মিলেছে কচ্ছপও। বাড়িতে এই ভাবে কচ্ছপ রাখা বেআইনি। এ নিয়ে বন দফতরের তরফে পদক্ষেপ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় বনাধিকারী (ডিএফও) মিলন মণ্ডল। জামালের বিরুদ্ধে ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন’ আইনে মামলা রুজু করা হবে। তিনি জানান, জামালের বাড়িতে যে কচ্ছপ দেখা গিয়েছে, তার বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘ইন্ডিয়ান সফ্‌ট শিল্ড টার্টল।’ ওই কচ্ছপ বাড়িতে রাখার জন্য সর্বোচ্চ তিন থেকে সাত বছরের জেল এবং ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.