ম্যাঞ্চেস্টার সিটির কোচ পেপ গুয়ার্দিওলা তাঁর সম্পর্কে বলেন, “অবিশ্বাস্য। ওকে ছাড়া প্রথম একাদশ ভাবতেই পারি না।”
স্পেনের কোচ লুই দে লা ফুয়েন্তে তাঁকে নিয়ে বলেছেন, “ও যেন একটা কম্পিউটার। সব কিছুতে নজর। এমন কিছু নেই যেটা ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।”
আরও অনেকে অনেক কিছুই বলেছেন। কিন্তু তিনি, রদ্রিগো হার্নান্দেস কাসকান্তে ওরফে রদ্রি, কোনও কিছুতেই বিশেষ পাত্তা দেন না। রবিবার ইউরো কাপের ট্রফিটা নিয়ে যখন গোটা স্পেন দল লাফাচ্ছে, তখনও তিনি অদ্ভুত শান্ত। মাঝে এক বারই হাসিমুখে ট্রফি হাতে তুললেন। পোজ় দিলেন। ব্যস্, ওটুকুই। বাকি সতীর্থেরা যখন বান্ধবী, স্ত্রী বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আনন্দ করছেন, তখন রদ্রি এককোণে দাঁড়িয়ে। গোটা পরিবেশটা উপভোগ করছেন। তাঁর তো বান্ধবীও নেই। থাকলেও অজানা।
২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত স্পেনের যে সোনালি প্রজন্ম ছিল, সেই দলে জ়াভি, আন্দ্রে ইনিয়েস্তা, সের্জিয়ো বুস্কেৎসের মতো বাঘা বাঘা মিডফিল্ডারেরা ছিলেন। কোনও কোচ যদিও বা জ়াভি, ইনিয়েস্তাকে বসাতেন বা তুলে নিতেন, বুস্কেৎসকে কখনওই তুলতেন না। এই স্পেন বা ম্যান সিটি দলে রদ্রির অবস্থানও ঠিক সে রকমই। তিনি অপরিহার্য। তিনি না থাকলে কোচেরা চোখে অন্ধকার দেখেন। ফাইনাল বিরতির সময় যখন তাঁকে তুলে নেওয়া হল, তখন নিশ্চিত ভাবেই দে লা ফুয়েন্তে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। দলের সেরা অস্ত্রটাই বেরিয়ে গেল যে।
গোটা ইউরোয় ৬টি ম্যাচে ৫২১ মিনিট খেলেছেন। একটি গোল করেছেন। দু’টি হলুদ কার্ড দেখে একটি ম্যাচে নির্বাসিত ছিলেন। একটি ম্যাচে খেলানো হয়নি। একটিও অ্যাসিস্ট নেই। এমন খেলোয়াড় প্রতিযোগিতার সেরা হয়ে সোনার বল পান কী করে? এই প্রশ্ন যাঁদের মনে, তাঁদের কাছে হয়তো অন্য পরিসংখ্যানটা নেই। রদ্রির নিখুঁত পাসিং ৯২.৮৪ শতাংশ। ৪৩৯টি পাসের মধ্যে ৪১১টিই ঠিকানা লেখা। ২৮টি লম্বা পাসের মধ্যে ২৬টিই পড়েছে সতীর্থের পায়ে। ৩৩ বার বল ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রতিপক্ষ ফুটবলারের পা থেকে। এমন ফুটবলারকে কোচেরা মাথায় তুলে রাখবেন না তো কী করবেন!
রদ্রির কাজটা তা হলে ঠিক কী?
তিনি এমন একজন ফুটবলার, যিনি দরকারে দলকে গোল খাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবেন। আবার গোলমুখী আক্রমণের সময় দলকে গিয়ে সাহায্য করতে পারবেন। পোশাকি নাম ‘সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার’ বা ‘বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার’। কিন্তু রদ্রির ভূমিকা তার থেকে অনেক বেশি। মাঝমাঠে থেকে রদ্রি গোটা খেলাটা পরিচালনা করেন। দলের আক্রমণের সময় তিনিই হয়ে ওঠেন মূল স্রষ্টা। তাঁর পা থেকে প্রথম গোলের আক্রমণ তৈরি হয়। রদ্রি দলের খেলাটাকে ছড়িয়ে দেন। দরকারে ছোট পাস, দরকারে বড় পাস, পরিস্থিতি অনুযায়ী নানা ধরনের অস্ত্র বার করে আনতে পারেন।
শারীরিক গঠন ভাল। যে কারণে রক্ষণের সময় বিপক্ষের পা থেকে বল কাড়তে পারেন। আবার আক্রমণের সময় সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে বিপক্ষের রক্ষণ ভাগের সঙ্গে টক্কর দিতে পারেন। চাপের মুখে বল নিজের পায়ে রাখতে পারেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল তাঁর পাস দেওয়ার ক্ষমতা। অনেক দূরে কোনও সতীর্থ থাকলেও রদ্রির দৃষ্টি এবং শট এতটাই নিখুঁত, যে সেই পাস গিয়ে পড়বেই সতীর্থের পায়ে। পরিসংখ্যানও সে কথাই বলছে। ভাল ফুটবলারের ‘পেরিফেরাল ভিশন’, অর্থাৎ মাথা নীচের দিকে থাকলেও সতীর্থেরা কে কোথায় আছে দেখে নেওয়া, এই গুণটা ভাল থাকে। রদ্রি সে ব্যাপারে বাকিদের ছাপিয়ে গিয়েছেন।
কাতার বিশ্বকাপে স্পেনের তৎকালীন কোচ রদ্রিকে সেন্টার ব্যাক হিসাবে খেলিয়েছিলেন। সেখানে ফুয়েন্তে এসেই রদ্রিকে নিজের প্রিয় পজিশনে ফিরিয়ে এনেছেন। তাতেই ফুল ফোটাচ্ছেন রদ্রি। ফুয়েন্তে বলেছিলেন, “আমাদের দলে রদ্রি রয়েছে, যে সত্যিকারের কম্পিউটার। সব দিকে ওর নজর রয়েছে। সব কিছু একার হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটা ওর সবচেয়ে বড় গুণ।”
এ বারের ইউরো কাপে জর্জিয়া ম্যাচে স্পেন পিছিয়ে পড়েছিল। কিছুটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল গোটা দলকে। সেই সময় রদ্রিই গোটা দলকে শান্ত করেছিলেন। ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছিলেন পরিকল্পনা মেনে চলার কথা। স্পেন ম্যাচটি ৪-১ জিতেছিল। পরে রদ্রি বলেছিলেন, “হঠাৎ করে আক্রমণে উঠে যাওয়ার মাঝেমধ্যে ২০-৩০ সেকেন্ড সতীর্থদের শান্ত হতে বলা অনেক বেশি কাজে দেয়। আমার যেটা করা দরকার ছিল সেটাই করেছি।”
ক্লাব এবং দেশের হয়ে শেষ ৮০টি ম্যাচের মাত্র একটিতে হেরেছেন রদ্রি। প্রাক্তন ম্যান সিটি খেলোয়াড় কিছু দিন আগেই বলেছিলেন, প্রতি বার অনুশীলনের শেষে গুয়ার্দিওলার সঙ্গে অনেক ক্ষণ কথা বলেন রদ্রি। প্রতি মুহূর্তে উন্নতি করার একটা চেষ্টা। গুয়ার্দিওলা যে কোনও দিন কেভিন দ্য ব্রুইন, আর্লিং হালান্ড বা বের্নার্দো সিলভাকে বসাতে পারেন। কিন্তু রদ্রিকে বসানোর আগে দু’বার ভাববেন। ইউরোপের পাঁচটি সেরা লিগের সব ফুটবলারদের মধ্যে গত মরসুমে সবচেয়ে বেশি পাস দিয়েছিলেন রদ্রি। তিনি চোটের কারণে বাইরে থাকায় টানা তিনটি ম্যাচে হেরেছিল ম্যান সিটি।
অথচ বাইরের জগত সম্পর্কে তিনি অদ্ভুত ভাবে নিষ্পৃহ। সমাজমাধ্যমে কোনও অ্যাকাউন্ট। রাস্তায় দেখতে পেলে সই বা নিজস্বী শিকারির কোনও উৎপাত নেই। সিটির হয়ে খেলার সময়েও বাড়ি ফিরে পড়াশোনা করতেন। ব্যবসায় ডিগ্রি রয়েছে তাঁর। আসলে রদ্রির গোটা পরিবার ছোটবেলা থেকেই শিক্ষিত। পড়াশোনার মূল্য কতটা, এটা ছোটবেলা থেকেই তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্কুল থেকেই ফুটবলে হাতেখড়ি। যখন নিজে খেলতে শেখেননি, তখন থেকেই ফুটবল খেলার নিয়মকানুন বোঝা এবং খেলার খুঁটিনাটি জানা শুরু। বয়স আর জ্ঞান পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
অবসর সময়ে টেনিস খেলতে ভালবাসেন। এখনও নিজের জামাকাপড় নিজেই কাচেন। টিভি দেখতে ভালবাসেন। ফুটবল খেলা বা পড়াশোনা বাদে আরও একটি পছন্দ রান্না করা। রদ্রি বিবাহিত কি না, তাঁর কোনও বান্ধবী রয়েছে কি না, এ সব প্রশ্ন লিখে গুগ্লে উত্তর খোঁজার লোক কম নেই। কিন্তু সঠিক উত্তর এখনও গুগ্লের মতো সিধুজ্যাঠাও দিতে পারেনি।
রদ্রি এমনই। নিজেকে মেঘের আড়ালে রাখতে ভালবাসেন। কিন্তু মেঘের আড়াল থেকে তীর চালিয়ে শত্রু নিকেশ করতে ভোলেন না।