তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে

১৯৭১ সালের নির্বাচনে যখন জ্যোতি বসুর কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সসিস্ট) ১৯৬৯ সালের গত নির্বাচনের থেকে ৩৩ টা সিট বাড়াচ্ছে সেই সময় কলকাতার এক বাঙালি তৎকালীন কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত রাশিয়ায় পাড়ি দিচ্ছেন। নাম – অভয়চরণ দে। পশ্চিমবঙ্গে যখন মার্ক্সবাদের ভীত মজবুত করার কাজ চলছে, ঠিক তখনই কমিউনিস্ট দুর্গে মার্ক্সবাদের বিপরীতে ভক্তির শক্তি দেখাতে এক বাঙালি গিয়েছিলেন সোভিয়েত রাশিয়া। ১৯৭১ এর নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির দুই ভাগ মার্ক্সসিস্ট আর মার্ক্সসিস্ট-লেনিনিস্ট একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী হিংসার অভিযোগ করছে। এইসময় কমিউনিজমের যে বীজ পোঁতা হচ্ছিল তা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের জন্মভূমিকে ধর্মবোধ থেকে দূরে রাখতে প্রায় ৪ দশক নিরন্তর কাজ করে যাবে।
কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুতেই এই পশ্চিমবঙ্গের ঔষধ ব্যবসায়ী অভয়চরণ দে ‘শ্রীল প্রভুপাদ’ হয়ে গেছেন। দাস ক্যাপিটাল কে বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যখন চলছে তখন ‘শ্রীল প্রভুপাদ’ প্রতিজ্ঞা করছেন ‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’কে পৃথিবীর সব দেশে ছড়িয়ে দিতে। যখন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ কে ক্ষমতা দখল আর কমিউনিজমের এ্যাকশন প্ল্যান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে আর শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব গেলানো চলছে , তখন সমাজ পরিবর্তনের জন্য ভারতের দেখানো পথকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন এক বাঙালি সন্ন্যাসী। সংগ্ৰাম নয় , ভক্তিকে আশ্রয় করে সমাজে শান্তি – সমৃদ্ধির পথ দেখানোর কাজ শুরু করেছেন এক ৬৯ বছর বয়সের যুবক।

১৯৬৫ সালের অগাস্ট মাসে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন ‘কৃষ্ণনাম’ প্রচার করার জন্য।কৃষ্ণভক্তি ছড়িয়ে দিলেন নেশাচ্ছন্ন, হতাশাগ্ৰস্ত হিপিদের মধ্যে। ‘ Matchless gifts’ নামের এক দোকানঘরে প্রতিষ্ঠিত হল ‘কৃষ্ণভাবনামৃত সঙ্ঘ’।
আমেরিকায় ‘হরেকৃষ্ণ আন্দোলন’ -এ সহায়তা পান বিখ্যাত পপ গায়ক বিটল্সের জর্জ হ্যারিসনের। একে একে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিজের শিষ্যদের পাঠাচ্ছেন।এরপর লক্ষ্য সোভিয়েত রাশিয়া।
১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠা হওয়ার ৩ বছর আগে অভয়চরণ দে’র সাক্ষাৎ হয় তাঁর গুরু ভক্তিবেদান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সঙ্গে। গুরুদেবের পরামর্শেই ইংরেজিতে লেখার মাধ্যমে কৃষ্ণভক্তি ছড়াতে থাকেন। এ যেনো দুই বিপরীত চিন্তার সমান্তরাল যাত্রা কিন্তু এই দুই বিপরীত মত মুখোমুখি হবে প্রায় ৪৫ বছর পর সোভিয়েত রাশিয়ায়। একদিকে সম্পূর্ণ দেশের শাসনতন্ত্র ভক্তির বিরুদ্ধে । তারা অর্থকেই পৃথিবীর ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি মনে করে, অন্যদিকে জগদীশ্বর তথা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা।

শ্রীকৃষ্ণ যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে গীতোপদেশ দিয়েছিলেন, শ্রীল প্রভুপাদ পুঁজিবাদ আর কমিউনিজমের ঠান্ডা লড়াইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ধর্মের বাণী ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।আমেরিকায় সফলতা পাবার পর প্রভুপাদ তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া যাওয়া মনস্থ করলেন।১৯৭১ সালে সোভিয়েত রাশিয়াতে ঢোকার অনুমতি পেলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পাননি, এমনকি শ্রীমদ্ভগবতগীতা সঙ্গে নিয়ে যেতে দেওয়া হয় নি। প্রভুপাদ মস্কোর U S.S.R Academy of Science এর South Asian Studies বিভাগের অধ্যক্ষ প্রফেসর কটভ্স্কির সাথে কথা বলে বুঝলেন কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দ্যেশ্য বৈদিক দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত।সেইসময়ের রাশিয়াকে তিনি আসুরিক সভ্যতা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ঘটনাচক্রে সেই সময় ভারতীয় দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ছেলের রাশিয়ান বন্ধু ইভান প্রভুপাদের কথায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁর ভক্ত হয়ে যায়। শুরু হয় সোভিয়েত রাশিয়ায় ‘হরে কৃষ্ণ’ আন্দোলন। প্রভুপাদ মাত্র ৫ দিন সোভিয়েত রাশিয়ায় ছিলেন কিন্তু সেই পাঁচ দিন সোভিয়েত রাশিয়ার ইতিহাস বদলে দিয়েছিল।

সেইসময় কৃষ্ণভক্তদের সোভিয়েত রাশিয়ায় মানসিক হাসপাতাল, জেলে জায়গা হতো। আর এখন মায়াপুরে গেলে দেখতে পাওয়া যায় রাশিয়ান কৃষ্ণভক্তদের দল মৃদঙ্গ বাজিয়ে হরিনাম সঙ্কীর্তন করছেন। মার্ক্সবাদ যে দেশে ধর্মকে আফিম বলে প্রচার করেছে সে দেশে রুশ ভাষায় অনূদিত গীতা ও ভক্তিবেদান্তের বই বিক্রি হয়েছে। মার্ক্সবাদ নিজেকে ‘আন্তর্জাতিক’ বললেও বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশে কমিউনিজমের অস্তিত্ব আছে আর কমিউনিজমের সম্পূর্ণ বিপরীত ‘কৃষ্ণভাবনামৃত’ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে — এ থেকেই বোঝা যায় বস্তুবাদী চিন্তাধারা আধ্যাত্মিক ভাবধারার তুলনায় কত দুর্বল আর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বের উনষাট টি ভাষায় প্রভুপাদের ‘Bhagvad Gita As it is ‘ প্রকাশিত হয়েছে। যে বয়সে মানুষ অবসর গ্ৰহণ করে সেই বয়স থেকে শুরু করে শ্রীল প্রভুপাদ মাত্র ১২ বছরের মধ্যে ১৪ বার পৃথিবী ভ্রমণ করেন। শ্রীল প্রভুপাদের জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৭০ টি প্রধান শহরে প্রতিবছর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.