নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল: কি, কেন, প্রচার, অপপ্রচার ও প্রকৃত তথ্য #IndiaSupportsCAA

(পর্ব ১)

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল জানিয়েছেন সংসদের চলতি অধিবেশনে পেশ হতে চলেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন যে এই বিলের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদী সরকার হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করছে এবং এ হল হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে বিজেপির ভোট লাভের চেষ্টা। বিজেপি অবশ্য এই বিলকে এক যুগান্তকারী সামাজিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। এমত দ্বৈরথের মধ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি আদতে ঠিক কি এবং সমাজে এর প্রভাব কতটা, রাজনৈতিক মতাদর্শ নিরপেক্ষভাবে সকলের তা বোঝা প্রয়োজন।

স্বাধীনতার পর থেকে পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা অঞ্চলে উদ্বাস্তু সমস্যা যে কোনো সরকারের এক চিরকালীন মাথাব্যথার কারণ হয়ে রয়েছে। অবিভক্ত ভারতবর্ষের মাটিতে সকলেই ছিলেন ভারতের নাগরিক। কিন্তু, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ফলে যখন থেকে মানুষকে দিশেহারার মত বর্ডার পেরিয়ে কখনও ওপার থেকে এপারে আবার কখনও এপার থেকে ওপারে যখন পালাতে হল, তখন থেকেই এই প্রশ্ন এইসব ভাগ্যহীন উদ্বাস্তু মানুষদের তাড়া করে ফিরেছে যে তাঁরা কোন্ দেশের নাগরিক? কোনটা তাঁদের আসল দেশ! যেহেতু দেশভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে এবং আমাদের অবিভক্ত বঙ্গদেশের পূর্বাংশ ঘোষিত ভাবেই ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য, তাই সেই পূর্ব পাকিস্তান/পুব বাংলা, অধুনা বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা যেসব অমুসলমান ছিলেন বা আছেন তাঁরা এক লহমাতেই হয়ে গিয়েছিলেন নিজভূমে পরবাসী। তার পর থেকে দফায় দফায় এই সব অমুসলমান পূর্ববঙ্গবাসী গত প্রায় ৭২ বছর ধরে ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন ভারতবর্ষের সেই অংশে বা অংশগুলিতে,যা তাঁদের বিশ্বাসে মুসলমানদের ভাগে পড়ে নি। অর্থাৎ আজকের এই পশ্চিমবঙ্গে, আসামে ও ত্রিপুরায়। এঁরা এই ভারতবর্ষেরই নাগরিক। এঁরা বা এঁদের পূর্ব পুরুষেরা একদিন মাথা উঁচু করে পরিচয় দিতেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে। তাই, দেশভাগের মত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বলি হিসেবে যখন তাঁদের আদি ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে আদি অবিভক্ত ভারতবর্ষের সেই অংশে যা তাঁদের নিজেদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট, তখন বর্তমান বিভক্ত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দায় থেকে যায় তাঁদের বৈধ নাগরিক হিসেবে সসম্মানে গ্রহন করার। সময়ে সময়ে আংশিকভাবে সেই কাজ করা হলেও আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধি স্বাধীন ভারতের কোনো সরকার তৈরি করে উঠতে পারে নি। আজ স্বাধীনতার প্রায় বাহাত্তর বছর বাদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটির মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদী সরকার সেই রকম একটি সুনির্দিষ্ট বিধি তৈরি করতে চেয়েছেন।

হিন্দু বাঙালীরা, যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম বা ত্রিপুরা ইত্যাদি রাজ্যে এসেছেন, মোদী সরকারের সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল কি তাদেরকে নাগরিকত্ব দেবে? উত্তর হল, দেবে। ২০১৪ সালের ৩১ শে ডিসেম্বরের মধ্যে যাঁরা যাঁরা ওদেশ থেকে এসেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ভারতের নাগরিকত্বের ন্যায্য দাবীদার।

এঁদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো শর্ত আছে কি? উত্তর হল, সামান্য কিছু শর্ত অবশ্যই আছে। যেহেতু তাঁরা স্বাধীন বিভক্ত ভারতবর্ষের মাটিতে জন্মান নি, তাই তাঁদের নাগরিকত্ব পেতে হবে ন্যাচারেলাইজেশনের মাধ্যমে। ন্যাচারেলাইজেশন অর্থাৎ ভারতের অরিজিনাল নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ অনুযায়ী যাঁরা জন্মগতভাবে ভারতের নাগরিক নন, তাঁরা যে যে পদ্ধতিতে আবেদনের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব পেতে পারেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো সিটিজেনশিপ বাই ন্যাচারেলাইজেশন। এই পদ্ধতিতে আবেদনের জন্যে একজন আবেদনকারীকে যে যে শর্তাবলী পূরণ করতে হয়, তা লেখা আছে ভারতের নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫’র থার্ড সিডিউলে। সেখানে উল্লিখিত আছে যে ন্যাচারেলাইজেশনের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব পেতে হলে তার নানা শর্তাবলীর মধ্যে কিছু ছোটখাটো শর্ত, যেমন আবেদনকারীকে কোনো না কোনো একটি দেশের নাগরিক হতে হবে, তাঁর চরিত্র ভাল হতে হবে ইত্যাদি ছাড়া মূল শর্তটি হল এদেশে একটানা অন্ততঃপক্ষে ১১/১২ বছর থাকতে হবে। তবেই সেই ব্যক্তি ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এইখানে একটি সংশোধন করেছে। নতুন নাগরিকত্ব বিলের দ্বিতীয় সংশোধনী অনুযায়ী বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে যে সব হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি বা ক্রীশ্চান ২০১৪ সালের ৩১ শে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে চলে এসেছেন, তাঁদেরকে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হলে তার আগে টানা ১১/১২ বছর ভারতে থাকতে হবে না। মাত্র ছ’বছর বাস করলেই তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অর্থাৎ শর্ত শিথিল হয়েছে। যাঁরা ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর এদেশে এসেছেন, তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন, ২০২০ সালের ৩০ শে ডিসেম্বরের পর। কারণ তখনই শেষ হবে তাঁদের টানা ছ’বছর থাকার মেয়াদ।

(পর্ব ২)

কেউ কেউ প্রচার করছেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নাকি বাঙালী হিন্দুকে আদতে নাগরিকত্ব দেবে না, দেবে কেবলমাত্র শরণার্থী স্টেটাস। এটি অপপ্রচারই। কারণ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের অন্য দুইখানি আইনের দুটি সংশোধনীর পর থেকে ভারতবর্ষে বসবাসকারী হিন্দু বাঙালী মাত্রেই ‘শরণার্থী স্টেটাস’ পেয়েই গিয়েছেন। এই আইনদুটি হল, পাসপোর্ট অ্যাক্ট ১৯৫০ আর ফরেনারস্ অ্যাক্ট, ১৯৪৬ এর আওতায় ফরেনারস্ অর্ডার, ১৯৪৮. পাসপোর্ট অ্যাক্ট ১৯৫০ অনুযায়ী যে কোনো অভারতীয় মানুষের ভারতে ঢুকতে বা থাকতে গেলে পাসপোর্ট লাগে। ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫’য় এই আইনটির সংশোধন বলে বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪র আগে যদি কোনো হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা ক্রীশ্চান ব্যক্তি ভারতে এসে থাকেন, তবে ভারতে থাকতে গেলে তাকে পাসপোর্ট বা অন্য কোন তথ্যাদি দেখাতে হবে না। অর্থাৎ কোনো বাঙালী হিন্দু পরিবার যদি ২০১৪র ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ থেকে চলে এসে থাকেন, তবে ভারতে থাকতে গেলে তাঁদের কাগজপত্র বা পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া বাধ্যতামূলক হবে না। পাসপোর্ট অ্যাক্টের এই সংশোধনীটি পাশ হয়েছে এন ডি এ ক্ষমতায় আসার একবছরের মধ্যে, ২০১৫ সালে। ফরেনারস্ অ্যাক্ট, ১৯৪৬ এর আওতায় ফরেনারস্ অর্ডার, ১৯৪৮ অনুসারে কোনো বিদেশি ব্যক্তি বৈধ পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে ঢুকলে বা পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও ভারতে থাকলে, তাকে আইনের হেফাজতে নিয়ে আটকে রাখা যায়। এই আইনেরও সংশোধন হয়েছে ২০১৫ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। এই সংশোধনী অনুযায়ী ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪ র আগে বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা কোনো ব্যক্তি যদি হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা ক্রীশ্চান হন, তবে তিনি বিদেশি হলেও বৈধ পাসপোর্ট না থাকার কারণে ফরেনারস্ অ্যাক্ট, ১৯৪৬ এর আওতায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এবং তাঁরা ভারতবর্ষে শরণার্থী হিসেবে থাকতে পারবেন। অর্থাৎ যাঁরা বলছেন যে নাগরিকত্ব বিল হিন্দু বাঙালীদের নাগরিকত্ব দেবে না, শরণার্থী স্টেটাস দেবে, তাঁরা সম্ভবতঃ জেনেবুঝে, মানুষকে ভুল বোঝানোর জন্যই মিথ্যে বলছেন। কারণ ২০১৪ সালে এন ডি এ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ র ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে আসা বাঙালী হিন্দুদেরকে এদেশে শরণার্থী স্টেটাস দিয়েছে। ২০১৪র ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে এদেশে আগত হিন্দু বাঙালীকে কোনোভাবেই আর বিদেশী চিহ্নিত করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো আইনতঃ অসম্ভব। মোদীর নেতৃত্বাধীন এন ডি এ এই বিষয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছে। প্রথমেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনলে তা লোকসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য পাশ হলেও বিরোধী অধ্যুষিত রাজ্যসভায় তা পাশ হত না, বলাই যায়।

প্রশ্ন হল, আসাম এন আর সি’র চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালীকে তাহলে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কেন? তাঁদেরও শরণার্থী স্টেটাস থাকার কথা। উত্তর হল, আসাম এন আর সি হয়েছে আসাম অ্যাকর্ড নামক একটি পৃথক সাংবিধানিক ধারা অনুসারে এবং সুপ্রিমকোর্টের আদেশে ও তত্ত্বাবধানে। প্রাদেশিকতাদোষে দুষ্ট এই ধারা ভারতের সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। এই আসাম অ্যাকর্ডের বলে বলীয়ান হয়েই অসমীয়ারা পাসপোর্ট অ্যাক্ট ও ফরেনারস্ অ্যাক্টের ২০১৫’র সংশোধনী মেনে আসাম এন আর সি’র চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া হিন্দু বাঙালীদের শরণার্থী স্টেটাস গ্রাহ্য করতে রাজী নয়। তারা এই আইনদুটি বস্তুতঃ মানছে না। এবং সেই একই কারণে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের তীব্র বিরোধিতা করছে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত। তাদেরকে বেশি বেশি করে ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে ভারতবিরোধী বিভেদকামী শক্তি। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ সাধারণভাবে আতঙ্কিত যে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা এসে উত্তর-পূর্ব ভারতে বসতি স্থাপন করলে উত্তর-পূর্ব ভারতের আঞ্চলিক জনজাতি ও তাদের সংস্কৃতি ঐ উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালীদের সংস্কৃতির চাপে বিপন্ন হবে। তাছাড়া আসাম অ্যাকর্ডের ছয় নম্বর ধারা অনুযায়ী আসামের ওপর অধিকার কেবলমাত্র ভূমিপুত্রদেরই। উদ্বাস্তুদের স্থান দিয়ে তাঁরা তাঁদের সে অধিকার ছাড়তে চান না। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হবে অকপটভাবে, আলোচনার মাধ্যমে। তাদের আশঙ্কা যে অমূলক সে বিষয়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করা প্রয়োজন। খবরে প্রকাশ যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের তাৎপর্য কি এবং তা থেকে যে উত্তর-পূর্বের পাহাড়ী রাজ্যগুলির বিশেষ কোনো ক্ষতি হওয়া সম্ভব নয়, সে বিষয়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে বোঝাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ।

পাসপোর্ট অ্যাক্ট ও ফরেনারস্ অ্যাক্ট সংশোধনী পাশ করানোর পর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে প্রথম পেশ করা হয় ২০১৬ এ। কংগ্রেস-কমিউনিস্ট-তৃণমূল সেই বিলটিকে পাঠিয়ে দেয় জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটিতে। অবশেষে ২০১৯ সালে জেপিসির সম্মতিক্রমে যে বিলটি এন ডি এ লোকসভায় পাশ করিয়েছিল লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, তাতে যে শুধু আগের বিলের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তান থেকে চলে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন শিখ পার্সি ও খ্রীষ্টানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথাই বলা হয়েছে তা-ই নয়, উপরন্তু বলা হয়েছে যে, যে সব শরণার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া চলছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার মুহূর্ত থেকে সেই সমস্ত প্রক্রিয়া বাতিল হবে এবং তাঁরা অবিলম্বে ন্যাচারালাইজেশনের এর মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অর্থাৎ আসামের ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালী এবং আরও ২ লক্ষ হিন্দু, যাদের নাম আসাম এন আর সি’র চূড়ান্ত তালিকায় নেই এবং ফরেনারস্ ট্রাইব্যুনালে যাদের বিরুদ্ধে এই মর্মে কেস চলছে যে তারা বিদেশি এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বিরুদ্ধে সেই কেসগুলিও ড্রপড্ হয়ে যাবে এবং তারা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

(পর্ব ৩)

বাংলাদেশের বাঙালী হিন্দুকে ভারতে নাগরিকত্ব পেতে গেলে তথ্যপ্রমাণ দেখাতে হবে যে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, এই মর্মে যে প্রচারটি চলছে, তা-ও অসত্য। যদি ২০১৪র ৩১শে ডিসেম্বরের আগে এসে থাকেন তবে তাঁদের কাছে পাসপোর্ট, ভিসা ইত্যাদি না থাকলেও ২০১৫ সালের পর থেকে তাঁরা ভারতের শরণার্থী এবং আসার পর ছ’বছর কেটে যাওয়ার পর থেকে তাঁরা নাগরিকত্বেরও দাবীদার। তার জন্য ন্যূনতম দুই’টি বিষয় তাঁদের প্রমাণ করতে হবে। ১. তাঁরা অরিজিনালি বাংলাদেশের নাগরিক। এবং ২. তাঁরা বাংলাদেশের মাইনরিটি। তেমন কোনো একটা প্রমাণ যে কোনো মানুষের কাছে থাকে। সেটুকুই প্রয়োজন যেটুকু না চাইলে অবৈধ বাংলাদেশী মুসলমানকেও নাম ও পরিচয় ভাঁড়িয়ে ঢুকে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়ে যেতে পারে। যিনি পরিস্থিতির কারণে স্বভূমি ছেড়ে অন্যত্র আসতে বাধ্য হয়েছেন, তেমন শরণার্থী মানুষকে নিজের অস্তিত্বের সামান্যতম প্রমাণটুকুই দিতে হবে। অর্থাৎ ২০১৪র ৩১শে ডিসেম্বরের আগে যাঁরা একবস্ত্রে আসেন নি, সহায় সম্বল গুছিয়ে নিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছেন, তাঁরা তাঁদের অস্তিত্ব ও আইডেন্টিটি সম্বন্ধে যতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, ন্যূনতম পরিচয় দিতে পারবেন, তার ওপর ভিত্তি করেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল অনুযায়ী ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার তাঁরা যোগ্য।

উক্ত ইসলামিক প্রতিবেশী দেশ তিনটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ হলেই কি ভারতের নাগরিকত্ব পেতে পারেন? যদি তিনি পরবর্তীতে খুন, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ বা চরবৃত্তির মত অপরাধে অপরাধী প্রমাণিত হন, তখন কি হবে? নির্বিচারে যে কোন লোককে নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক? উত্তর হল, নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫’র ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া কোনো ব্যক্তি যদি ৫ বছরের মধ্যে কোনো কারাদন্ডে দণ্ডিত হন, যে দণ্ডের মেয়াদ দু’বছরের কম নয়, তবে কেন্দ্রীয় সরকার একটি অর্ডারের মাধ্যমে তার নাগরিকত্ব বাতিল করে দিতে পারবে। অর্থাৎ কেউ যদি এই নতুন নাগরিকত্ব বিলের সুবিধা নিয়ে নাগরিকত্ব লাভও করেন ও পরে অপরাধী প্রমাণিত হন, তবে তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাই ভারতবর্ষের কোনো বর্তমান নাগরিকেরই এই নাগরিকত্ব বিলের কারণে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। মতুয়া সম্প্রদায় এদেশে রয়েছেন ২০১৪র ডিসেম্বরের বহু আগে থেকে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার সাথে সাথে তাঁরা এদেশের নাগরিক হবেন।

সঙ্গত প্রশ্ন হল, নাগরিকত্ব বিল হিন্দু বাঙালীদের নাগরিকত্ব দেবে না, শরণার্থী স্টেটাস দেবে, এমন অপপ্রচারের তাহলে ভিত্তি কি? উত্তর হল পাসপোর্ট অ্যাক্ট ও ফরেনারস্ অ্যাক্টের ২০১৫ সালের সংশোধনীগুলির জন্য আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ৩১.১২.২০১৪র আগে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং ক্রীশ্চান মানুষেরা যদি কাগজপত্র, পাসপোর্ট ইত্যাদি ছাড়াও ভারতে প্রবেশ করেন এবং বাস করেন, তাহলে যেমন পাসপোর্ট অ্যাক্ট বা ফরেনারস্ অ্যাক্ট অনুসারে এঁদেরকে আইনের হেফাজতে নিয়ে শাস্তি দেওয়া যাবে না, তেমনই আবার নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ এ অনুপ্রবেশকারীর যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তার থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না এইসব শরণার্থী মানুষদেরকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতেও পারবেন না। ফলতঃ যদিও ২০১৫ সালেই এইসব মানুষদেরকে শরণার্থী স্টেটাস দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, তবুও নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ সংশোধন না করা পর্যন্ত তাঁদেরকে পূর্ণ নাগরিকত্ব দেওয়ার পথ খোলা ছিল না। সেই জন্যই পাসপোর্ট অ্যাক্ট ও ফরেনারস্ অ্যাক্টের ২০১৫ সালের সংশোধনীগুলির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলেও এই সংশোধনীটি আনা টেকনিক্যালি প্রয়োজন ছিল। সংশ্লিষ্ট দুটি আইন আগেই সংশোধিত হওয়ায় তার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ তেও তার সঙ্গে সাযুজ্য পূর্ণ প্রাসঙ্গিক সংশোধনীটি আনা হয়েছে। সেই জন্যই নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫’র প্রথম সংশোধনী হিসেবে সেই আইনে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর যে সংজ্ঞা দেওয়া ছিল, বর্তমান বিলে সেই সংজ্ঞা থেকে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ৩১.১২.২০১৪র আগে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং ক্রীশ্চান মানুষ দের বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রথম সংশোধনী এটি। নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে থাকা ছিন্নমূল মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকে আরও উসকে দেওয়ার জন্য এই সংশোধনীটিরই অপব্যাখ্যা হচ্ছে এই বলে যে নাগরিকত্ব বিল বাঙালী হিন্দুকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তকমা থেকে মুক্ত করে তাঁদেরকে শরণার্থী স্টেটাস দিচ্ছে মাত্র, নাগরিকত্ব নয়। এই বিলের ২ ও ৩ নম্বর সংশোধনী দ্বারা এইসব মানুষের ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্তও শিথিল করা হয়েছে। সাধারণ ভাবে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে গেলে যত বছর ভারতে থাকতে হয়, এই বিলে সেই সময়সীমা এইসব মানুষদেরকে জন্য শিথিল করা হয়েছে।

(পর্ব ৪)

প্রশ্ন উঠেছে ঐসব দেশ থেকে যেসব মুসলমানরা এদেশে এসেছেন তাদের কি হবে? ২০১৪র ডিসেম্বরের আগে বহু বাংলাদেশী মুসলমানও বাংলাদেশে তাঁদের ভিটেমাটি রেখেই আরও ভালো জীবন ও জীবিকার সন্ধানে এদেশে এসেছেন। নাগরিকত্ব বিল তাঁদেরকে ভারতের নাগরিকত্ব দেবে না, এ পর্যন্ত বোঝা গেল‌। কিন্তু তাঁদেরকে তাড়িয়ে দেবে কি? যদি তাড়িয়ে না দেয়, তাহলে কোনো তফাৎ হবে না। তারা আগেও যেমন ছিল, তেমনই রয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের উপর থেকে অবৈধ বাংলাদেশী মুসলমানের ভার তাহলে লাঘব হবে কিভাবে? উত্তর হল, কাউকে তাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। নাগরিকত্ব না পেলে, নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র না পেলে এদেশে তাদের জীবন ও জীবিকা সঙ্গে সঙ্গে না হলেও, দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠবে, এ-ই স্বাভাবিক। নাগরিকত্ব বিল পাশ হওয়ার পরে নাগরিক-পরিচয়পত্রের প্রশ্ন ইত্যাদি উঠবেই। সমাজ ও কর্মজীবনে সেই পরিচয়পত্রও তখন অপরিহার্য হয়ে উঠবে আর তার অভাবে এই অবৈধ বাংলাদেশী মুসলমানেরা হয়ত ধীরে ধীরে কর্মহীনতা ও আশ্রয়হীনতার কবলে পড়বে। তাছাড়া নাগরিকত্ব বিল পাশ হওয়ার পর যে কোনো ব্যক্তিকে অনাগরিক সন্দেহ করায় এবং পুলিশের কাছে সে সন্দেহ ব্যক্ত করায় কোনো বাধা থাকবে না। অর্থাৎ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ছিন্নমূল মানুষকে দেবে ভারতীয় নাগরিত্বের নিরাপত্তা।

যাঁরা এই বিলের বিরোধিতা করছেন তাঁরা আদতে ছিন্নমূল মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্বের সুরক্ষা দিতে চান না। কিন্তু ইস্যুটা রাজনীতি করার জন্য জিইয়ে রাখতে চান, ঠিক যেমনটা ২০১৪ সালে এন ডি এ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত সাতষট্টি বছর যাবৎ জিইয়ে রেখেছিল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বার বার প্রশ্ন তুলছেন যে আসাম এন আর সি’র চূড়ান্ত তালিকা থেকে ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালীসহ যে ১৪ লক্ষ হিন্দু বাদ পড়েছে, তাদের কি হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই জানেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের তৃতীয় সংশোধনী অনুযায়ী এই নাগরিকত্ব বিল পাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই সমস্ত হিন্দুদের বিরুদ্ধে ফরেনারস্ ট্রাইব্যুনালে সমস্ত মামলা বাতিল হবে এবং তাঁরা প্রত্যেকে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই তথ্য জানার পরেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন বিরোধিতা করছেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের? তবে কি আসাম এন আর সি’র চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালীর প্রতি ওঁর উদ্বেগ আদতে মেকি?

প্রশ্ন আর একটাও আছে যে প্রশ্ন কংগ্রেস-কমিউনিস্ট-তৃণমূলীরা তুলছেন। প্রশ্নটি হল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের হিন্দু বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি, ক্রীশ্চানদের যদি ভারতবর্ষ নাগরিকত্ব দিতে পারে, তবে ওসব দেশের মুসলমানদেরই বা নয় কেন? সেক্যুলার দেশে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব কেন? উত্তর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ দিয়েছেন। নাগরিকত্ব বিলের মূল স্পিরিট ও প্রস্তাব হল এই যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মত ইসলামিক দেশগুলিতে বসবাসকারী সেই সব দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ যদি প্রানের দায়ে অথবা মান, সম্ভ্রম ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে ভারতবর্ষে চলে আসেন, তবে ভারত সরকার তাঁদেরকে আশ্রয় দেবে এবং যথা সময়ে তাঁদের নাগরিকত্বও দেবে। আতঙ্কিত, অত্যাচারিত অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের আশ্রয় দেওয়ার নীতি আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃত নীতি। ভারতবর্ষ এ ব্যাপারে নতুন কিছু বা বৈষম্যমূলক কিছু করতে চাইছে না। ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রেফিউজিস (UNHCR) এর সংজ্ঞা অনুযায়ী যাঁরা উদ্বাস্তু, আশ্রয় ও নাগরিকত্ব তাঁদের জন্যই। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতন ঘোষিতভাবে ইসলামিক দেশে কোনো মুসলমান নাগরিক ইসলাম ধর্ম পালন করতে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই বিপন্ন হতে পারেন না এবং সেই বিপন্নতা কাটাতে ভারতবর্ষের মত একটি নন-ইসলামিক তথা সেক্যুলার দেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হতে পারেন না। তাই প্রতিবেশী ইসলামিক দেশ তিনটির অত্যাচারিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব দেশের মুসলমানদেরও ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

(শেষ পর্ব)

আর একটি প্রশ্নও হয়ত উঠতে পারে। পৃথিবীতে অনেক ইসলামিক ও খ্রীষ্টান দেশ আছে। সেখানকার সংখ্যালঘুদেরও নিরাপত্তাহীনতা থাকতে পারে। তাহলে শুধু আফগানিস্তান, পাকিস্তান আর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদেরই বা আশ্রয় দিতে হবে কেন? কারণ এই তিনটি ভৌগোলিক অঞ্চল বর্তমানে স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও আদতে অবিভক্ত ভারতের অংশ। ফলে এইসব দেশগুলির অধিবাসীবৃন্দ আদতে ও উৎপত্তিগতভাবে ভারতেরই অধিবাসী। বর্তমানে ওই দেশগুলি ইসলামিক দেশ হওয়ায় তাদের সংখ্যাগুরু মুসলমান জনসাধারণের সুরক্ষার যথার্থ ব্যবস্থা তারা রেখেছে। এইসব দেশগুলির সংখ্যালঘু নাগরিকবৃন্দও যদি দেশগুলিতে সম্মানের সঙ্গে বাস করতে পারতেন, তবে সে-ই হত আদর্শ পরিস্থিতি। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সেই আদর্শ পরিস্থিতির মিল প্রায়শঃই পাওয়া যায় না। এইসব ইসলামিক দেশগুলিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রায়শঃই নানাভাবে অত্যাচারিত হন বা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। ইসলামিক আইন তাঁদের উপরেও প্রযোজ্য হওয়ার কারণে তাঁদের নিজস্ব রীতি নীতি অনুযায়ী তাঁদের জীবনের বহু মৌলিক অধিকার প্রায়শঃই খর্ব হয়। এমতাবস্থায় ভারতবর্ষ এইসব মানুষদের প্রতি তার নৈতিক দায় অস্বীকার করতে পারে না, কারণ আজ তাঁরা রাজনৈতিক ভাগ্যচক্রে ইসলামিক দেশের মাইনরিটি পরিচয়ে বাঁচতে বাধ্য হলেও একদিন এঁরা বা এঁদের পূর্ব পুরুষেরা অবিভক্ত ভারতবর্ষের নাগরিক ছিলেন এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের মতই তাঁদেরও পূর্ণ অধিকার ছিল সম্পূর্ণ অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রতিটি ইঞ্চির ওপর। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে আজকের ভারতবর্ষও কিন্তু সেই অবিভক্ত ভারতবর্ষের একটি খণ্ডিতাংশ মাত্র। ফলে তাঁরা যদি প্রাণ বা মান বাঁচাতে ভারতে চলে আসতে চান, নিজের সংস্কৃতি রক্ষা করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চান, তবে তাঁদেরকে আশ্রয় দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব ভারতবর্ষের আছে। ওসব জায়গার মুসলমানদের প্রতি বর্তমান ভারতের সে দায় নেই, কারণ যদিও তাঁরাও আমাদের মতনই অবিভক্ত ভারতবর্ষের নাগরিকদেরই উত্তরপুরুষ, তথাপি একথাও সত্য যে একদিন তাঁদের পূর্বপুরুষেরা ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে নিজেদের জন্য আলাদা ভাগ কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিয়েছিলেন এবং তদবধি নিজেদের অংশকে ঘোষিতভাবে ইসলামিক রাষ্ট্র করেই রেখেছেন। তাই বাকি যে অংশ এখন ভারতবর্ষ বলে পরিচিত, সেই অংশের উপর ওসব দেশের মুসলমানদের আর কোনো ন্যায়সঙ্গত বা যুক্তিসঙ্গত দাবী নেই। ধর্মীয় বিভাজন আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বর্তমান ভারতসরকার করছে না। সেই বিভাজন বরং সদর্প ঘোষণার মাধ্যমে আজও জিইয়ে রেখেছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মত ভারত-থেকেই-জন্ম-নেওয়া ইসলামিক রাষ্ট্রগুলি। একদিন তাঁরা নিজেদের অংশ নিয়ে সেই অংশে ইসলামিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। তাঁদের অংশকে তাঁরা ভারতবর্ষের মত সেক্যুলার করে রাখেন নি বা আজও নিজেদেরকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন না। ফলে তাঁদের যে আবার ভারতবর্ষে প্রবেশ করে এদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার অর্থাৎ মাটিতে ভাগ বসানোর ন্যায়সঙ্গত বা যুক্তিসঙ্গত অধিকার নেই, সেকথাটা কঠোর ও তিক্ত হলেও সত্য। ১৯৪৬ এ নোয়াখালী দাঙ্গা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর দফায় দফায় যে পাশবিক ইসলামিক নির্যাতন হয়েছে এবং তার ফলে নানা সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হিন্দুরা যেভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তার হৃদয়বিদারক বর্ণনা জানলে এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রয়োজনীয়তা যুক্তির পাশাপাশি এমনকি হৃদয় দিয়েও উপলব্ধি করা যাবে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল তবে বিরোধীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কেন? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কারণটি বোধ করি একান্তই সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ-প্রণোদিত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনবরত এ দেশে ঢুকে পড়ে অবৈধ বাংলাদেশী মুসলমানরা। আরও ভালো থাকা ও ভালো রোজগারের উদ্দেশ্যে। এরা ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে লোভনীয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকার এবং বর্তমান তৃণমূল সরকারের জন্য এরা ভোটে জেতার অন্যতম চাবিকাঠি। তাই অনুপ্রবেশকারী আর শরণার্থীর শ্রেণীবিভাগ খুব স্পষ্টতঃ হোক্ বা শরণার্থীরা যথাসময়ে নাগরিকত্ব পেয়ে যান, এটা বোধ হয় ওঁরা চান না। কারণ তা ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির পক্ষে অসুবিধাজনক এবং ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির একটি ইস্যু সেক্ষেত্রে চিরকালের জন্য তাদের হাতছাড়া হয়। তবে স্বাধীনতার দীর্ঘ বাহাত্তর বছর পর নেতিবাচক রাজনীতির ঘেরাটোপ ত্যাগ করে বেরোনো উচিত বিরোধীদেরও। দেশভাগের ফল হিসেবে যে অভিশাপ ভারতের এবং এই দেশগুলোর অসংখ্য মানুষকে আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, এন ডি এ ও তাদের বিরোধীদের সম্মিলিত শুভবোধে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই অভিশাপের অবসানের সূচনা হোক।

দেবযানী ভট্টাচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.