৯ অক্টোবর ২০১৯। ভারতবর্ষের হিন্দুত্বের ইতিহাসে সূচিত হলো এক নতুন অধ্যায়। একজন মুসলমান বিচারপতি সহ ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি টানা ৪০ দিনের শুনানির পর দীর্ঘ বিচারবিবেচনা করে ঘোষণা করেছেন—অযোধ্যার বিতর্কিত জমি রামলালার। অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্রের। অন্য কারও নয়। কোনো ব্যক্তির নয়, কোনো সংগঠনের নয়, বহিরাগত কোনো ধর্মের নয়। ৫০০ বছর ধরে পূজিত হয়ে আসা ওই জমি শ্রীশ্রীরামলালার এই ঘোষণা এক অর্থে হিন্দুত্বের দীর্ঘদিনের দাবিরই স্বীকৃতি। আর সেই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটল রামমন্দির বনাম বাবরি মসজিদবিতর্ক তথা হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টিহওয়া সংঘাতের। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি রামলালার। কারণ যে রামমন্দিরকে একদিন মুসলমান মোল্লা মৌলভিরা বাবরি মসজিদ আখ্যা দিয়ে দখল করে রাখতে চেয়েছিলেন, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার বিশেষজ্ঞরা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করে রিপোর্ট দাখিল করেছেন যে, বিতর্কিত সৌধের গভীরে যে ভিত বা কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গেছে তা কখনোই কোনো ইসলামিক সৌধের কাঠামোর সঙ্গে মেলে না। বরং ওই কাঠামোর অনেক বেশি মিল রয়েছে হিন্দু মন্দিরের ধাঁচের সঙ্গে। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট রায় “Muslims can’t assert right of adverse possession’ 1973 সঙ্গে বাতিল হয়ে গেছে শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের দাবি যে সৌধটি ছিল বাবরের তৈরি মসজিদ। বাতিল হয়ে গেছে হিন্দু সংগঠন নির্মোহী আখড়ার দাবিও যে তাদের আখড়াই ছিল রামলালার সেবাইত।
অযোধ্যা জনপদটি মূলত হিন্দু মনোভাবাপন্ন অঞ্চল তা এলাকায় পা ফেল্লেই স্পষ্ট হয়ে যায়। গোটা জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র দেবালয়। অনেকগুলিই প্রাচীনত্বের ভারে হয় ন্যুজ অথবা ভেঙে পড়েছে। তাও বেশ কিছু প্রাচীন মন্দির আজও অক্ষত এবং পুজোপাটে প্রাণবন্ত। বাবরি ধাঁচা নিয়ে মুসলমানদের দাবি যতই জোরদার হোক না কেন, আসল ইতিহাস তাই অন্য কথাই বলে। অযোধ্যার লৌকিক ইতিহাস বলে ? মোগল আমলের বহুপূর্বে রাজা বিক্রমাদিত্য নাকি এখানে সাত। শিখরের সুদৃশ্য মন্দির তৈরি করেছিলেন ৮৪টি কষ্টিপাথরের স্তম্ভ সহযোগে। আজও মন্দিরে তার চারটি বর্তমান যাতে হনুমানের মূর্তি খোদাই রয়েছে। তারপর বারবার দেশি বিদেশি আক্রমণ সংঘঠিত হয়েছে এই মন্দিরের ওপর। এমনকী মোগল আমলেও। সে সময়কার। লোক-ইতিহাস বলছে, মোগল আমলে মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন শ্যামানন্দ যোগী। তার সঙ্গেই বাস করতেন দুই মুসলমান দরবেশ খাজা আব্বাস ও জালাল শাহ। বাবর মানসিংহের কাছে পরাজিত হয়ে শ্যামানন্দ যোগীর শিষ্য হন এবং সেই সময়ে খাজা আব্বাস ও জালাল শাহের আদেশেই বাবর তার সেনাপতি মির বাকি তাসখান্দিকে দিয়ে রামমন্দিরকে মসজিদের রূপ দেন। শ্যামানন্দ তখন। রাজি হয়েছিলেন কয়েকটিশর্তে। তার মধ্যে অন্যতম, মন্দিরের গঠন মসজিদের মতো হলেও এরমধ্যে প্রত্যহ পুজোপাঠ হবে রামলালার। শুধুমাত্র শুক্রবার এখানে মুসলমানরা নামাজ পড়তে পারবেন। সেই। ব্যবস্থাই বহাল ছিল বহুদিন।
কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের কায়েমি রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের বিভেদকামী মনোভাব জিগির তোলে রামমন্দির বনাম বাবরি মসজিদ বিতর্কের। সেই বিতর্কের ফলেই একসময় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আদালতের নির্দেশে তালা পড়ে মন্দিরে। ফৈজাবাদের আইনজীবী উমেশ পাণ্ডে সম্পূর্ণভাবে আইনি লড়াই লড়ে মন্দিরের তালা খোলান। ১৯৮৪ সালের পর থেকেই শুরু হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের। নেতৃত্বে বহুচর্চিত মন্দির ও সংলগ্ন জমির দাবিদার হিসেবে মন্দির নির্মাণের দাবি। শুরু হয় রামজন্মভূমি মুক্তি আন্দোলনের। যদিও তার অনেক আগেই ১৯৪৯ সালেই শ্রীরামজন্মভূমি সেবা সমিতির তত্ত্বাবধায়ক সন্ত রামদয়াল শরণের পরিচালনায় শুরু হয়েছিল অখণ্ড শ্রীরাম সংকীর্তন। পরে দিগম্বর আখড়ার প্রধান রামচন্দ্র দাসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে শ্রীরামজন্মভূমির মুক্তির দাবিতে অত্যন্ত জোরদার আন্দোলন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, শ্রীরামজন্মভূমির মুক্তি না হলে, তিনি আন্দোলন করতেও পিছপা হবেন না। ১৯৮৪ সালে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ লক্ষ্ণৌ শহরে বিশাল সমাবেশে ঘোষণা করে—শুধু রামজন্মভূমিই নয়, গোটা দেশের বহিরাগত আক্রমণকারীদের অধিকৃত ১৪০টি হিন্দু মন্দিরকেই তুলে দিতে হবে হিন্দুদের হাতে। কারণ ভারতবর্ষ মানে হিন্দুত্বের ভূমি। হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম নয়। হিন্দুত্ব। একটা জীবনচর্যা। পুজোপাঠ সেই চর্যারই অঙ্গ। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সেই তীব্র দাবিরই ফলশ্রুতি হিসাবে আরও একটা ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর। সেদিন ক্ষোভে ফেটে পড়া রামভক্তদের হাতে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল বাবরি ধাঁচা। শুধু একটি প্রতীকী আন্দোলনের নজির রাখতে যে, কলঙ্কের চিহ্ন চিরকাল বহন করা যায় না। কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারের অসাবধনাতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেদিন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ফলে বহু হিন্দু এবং কিছু মুসলমান মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ওইদিন একটা বিষয় দিনের আলোর মতোই স্পষ্টহয়ে গিয়েছিল যে শ্রীরামলালার সম্মান রক্ষায়, তাঁর লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার দিন শেষ করতে হিন্দুরা বদ্ধপরিকর। গোটা দেশে তো বটেই, বিদেশের মাটিতেও এই নিয়ে কম রাজনৈতিক জলঘোলা হয়নি। সংখ্যালঘু তোষণকারী কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলি স্লোগানে স্লোগানে ভারতের আকাশ ফাটিয়েছিল। এই বলে যে—ভারতবর্ষে গণতন্ত্র শেষ। নেকড়ের মতো এগিয়ে আসছে হিন্দুধর্মের করালগ্রাস।
আজ দীর্ঘ ৫০০ বছরের ইতিহাসের এবং ১৩৪ বছরে আইনি লড়াইয়ের যে পরিণতি হলো—তা প্রমাণ করে, হিন্দুদের দাবিকখনও মিথ্যা ছিল না। প্রমাণিত হলো একথাও যে অযোধ্যার বাবরিধাঁচা ধ্বংসের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার যে ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি দেশকে রক্তাক্ত করে তুলেছিল তার পিছনেও ছিল পরিকল্পিত রাজনীতি।
আজ প্রমাণ হয়ে গেছে, সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড ও আবুদমান মুহাফিজ ও মকবির ১৯৪১ সাল থেকে বাবরি মসজিদের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তাও ছিল অমূলক ও বিভ্রান্তিকর। ইতিহাস এবং সত্যকে অস্বীকার করে আজীবন একটা গোটা দেশের সাধারণ জীবনচর্যার গতিপথকে বিপথে পরিচালিত করা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের রায় তাই শুধু রামলালার পক্ষে নয়, এ রায় মূলত হিন্দুত্বের পক্ষে, যে আদর্শকে আঁকড়ে ধরেই ভারতবর্ষ এগিয়ে চলেছে। স্বাভিমানী দেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। সুপ্রিম কোর্টের রায় অযোধ্যার রামলালার জয়— সেই প্রচেষ্ঠাকেই এগিয়ে দিল আরও কয়েকটা ধাপ।
রামভক্তরা মাঝেমাঝেই স্লোগান তুলতেন ‘রামমন্দির ওহি বনায়েঙ্গে। রামলালা নিজেই তার জমি উদ্ধার করে নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে মন্দির তৈরি করতে হবে ট্রাস্টের সদস্যদের এবং মন্দিরের নির্মাণকাজ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে ২.৭৭ একর জমির মধ্যেই। এখন সরকারের দায়িত্ব তীব্র হিন্দু ভাবাবেগকে প্রাধান্য দিয়ে মন্দির নির্মাণ করে রামলালার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই মুসলমান ধর্মীয় চেতনাকে সম্মান জানিয়ে মসজিদ গড়ে তোলার জন্য পাঁচ একর জমি বরাদ্দ করা। যত দ্রুত। এই কাজগুলি করা যাবে সরকারি লাল ফিতের গেরো খুলে, ততই মঙ্গল। হিন্দুরা কখনই হিংস্রতায় বিশ্বাসী নয়। সনাতনী হিন্দুত্ব সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাসী যদিও কখনই তা হিন্দুত্বকে খাটো করে বা বাতিল করে নয়। হিন্দুত্ব জীবনচর্যার সেটাই আদর্শ বলেই সুপ্রিম কোর্ট রায়দানের প্রাক্কালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্নির্দেশ জারি করেছিল— আগেভাগেই কেউ যেন কোনও মন্তব্য প্রকাশ করে সামাজিক বন্ধনের আদর্শকে ধূলিসাৎনা করে। ফলত হয়েছেও সেটাই। সম্পূর্ণশান্তিপূর্ণ পরিবেশে আপামর ভারতবাসী স্বাগত জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে। ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে এসেছে বাস্তব ইতিহাস ফিনিক্স পাখির মতোই। তার নাম রামলালা। তার নাম রামজন্মভূমি।
সুজিত রায়
2019-11-21