ভারতবাসীর অস্মিতা বিজেপিই বুঝেছিল

অযোধ্যায় রামমন্দির মামলার রায়। ঘোষণার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙঘচালক পূজনীয় মোহন ভাগবত বলেছেন, এই রায়ে কারো জয় বা পরাজয় হয়নি। একই কথা বলেছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। সঙ্ঘ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী। দুজনের বক্তব্যেই পরিষ্কার যে, তারা প্রথম থেকেই সতর্ক এবং সচেষ্ট ছিলেন এই রায়ে যেন কোনোরকম রাজনৈতিক রং না লাগে। অযোধ্যা রায়ে রাজনৈতিক রং লাগলে তাতে যে ভারতীয় জনতা পার্টির উপকার বিশেষহবেনা,বরং ক্ষতিরই সম্ভাবনা বেশি তা তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন। আর একটি শঙ্কাও অবশ্য সঙ্ঘ এবং বিজেপি নেতৃত্বের ছিল। তা হলো, রায়ের ফলাফল অনুকূল হওয়ার পরে যদি সঙ্ ও বিজেপির কিছু অতি উৎসাহী এবং অবিবেচক সমর্থক উচছুঙ্খলতা প্রকাশ করে ফেলে, তাহলে দেশের সম্প্রীতির পক্ষে তা ক্ষতিকর হবে। এবং সে দায়ভারও শেষ পর্যন্ত সঙ্ ও বিজেপির উপর এসে পড়বে। যে কারণেই সঙ্ঘ ও বিজেপি। উভয় পক্ষ থেকেই রায় বেরনোর প্রাক্কালে। বারবার আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছিল— রামমন্দিরের রায় যাই হোক না কেন তা শান্তচিত্তে মেনে নিতে। এবং একথাও অস্বীকার করলে চলবে না সর্বত্র সঙ্ এবং বিজেপি কর্মীরা তাদের নেতৃত্বের এই নির্দেশকে মান্যতা দিয়েছেন। এই রায় বেরোনর পর তাঁরা কোথাও কোনোরকম উৎসাহের আতিশয্য প্রকাশ করেননি। বরং, সব জায়গাতেই তারা সংযম প্রকাশ করেছেন। সে যাই হোক না কেন, এই রায়ের যে একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে– তা সবাই মানেন। এমনকী, সঙ্ এবং বিজেপি নেতৃত্বও তা জানেন। এই তাৎপর্যটি কী? আমরা চাই বা না চাই, রামমন্দির আন্দোলনে একটি রাজনৈতিক রং অনেক আগেই লেগে গিয়েছে। অযোধ্যায় বাবরি ধাঁচা ধ্বংসের সময় বা লালকৃষ্ণ আদবানীর রামরথযাত্রার সময় সেই রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকবেই তা স্বাভাবিক। অযোধ্যায় রামমন্দির রায় ঘোষিত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই, হিসাব নিকাশ । চলবে এই রায় রাজনৈতিকভাবে কার পক্ষে যাবে। অর্থাৎ এক কথায়, এই রায়ের ফলে কে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে।
অযোধ্যায় ওই জমিকে রাম জন্মস্থান হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে রামমন্দির গড়ে তোলার দাবিটি রাজনৈতিকভাবে একমাত্র বিজেপিই তুলেছে। শিবসেনা, হিন্দু মহাসভার মতো কিছু রাজনৈতিক দল এই দাবিকে সমর্থন জানালেও, এই দাবিকে ব্যাপক আকারে জনআন্দোলনের রূপ দিতে পেরেছে একমাত্র বিজেপিই। অন্যদিকে, কংগ্রেস, সমাজবাদী, বামপন্থী এবং অন্যান্য বিজেপি বিরোধী দল। প্রথমাবধিই অযোধ্যায় ওই জমিতে রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতা করেছে। রামমন্দির নির্মাণের দাবিতে বিজেপি এবং সঙ্ঘ একসময় তাদের আন্দোলনকে চড়া মাত্রায় নিয়েও গিয়েছে। বাবরি ধাঁচা ধ্বংস তারই প্রমাণ। তদুপরি, বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারেও বারেবারেই রামমন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সমগ্র ভারতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর মধ্যে রামচন্দ্রের নাম এক আবেগ সৃষ্টি করে। তার ভিতর দেশের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে এই আবেগ অনেকটাই বেশি। রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে একমাত্র বিজেপির আন্দোলন এবং অযোধ্যায় রামমন্দির স্থাপনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি বিজেপির প্রতিই এই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সহানুভূতিশীল করেছে। নির্বাচনী রাজনীতিতে তার সুফলও লাভ করেছে। বিজেপি। আবার এর একটি উল্টোদিকও আছে। বিজেপি ক্ষমতায় এলেই রামমন্দির। প্রতিষ্ঠা হবে— এমন একটি আকাঙ্ক্ষাও আকাশ ছুঁয়েছে সেই ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রথমবার ক্ষমতায় আসায়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর শাসন ক্ষমতার প্রথম পাঁচ বছরে সুপ্রিম কোর্টে রামমন্দির মামলার শুনানিতে দীর্ঘসূত্রতা ছাড়া আর কিছুই যখন হয়নি— তখন হিন্দুদেরই একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় থাকতেও কেন রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে না— আবেগতাড়িত হয়ে এ প্রশ্নও তঁারা তুলেছেন। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে এসে বলেছেন, অর্ডিনান্স জারি করে অবিলম্বে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করে দিক। যারা আবেগতাড়িত হয়ে এইসব কথাবার্তা বলেছেন, তাদের ভিতর শিক্ষিত মানুষজনও রয়েছেন। সরকার যে আবেগে চলে না, তার যে কিছু বাধ্যবাধকতারয়েছে— সে সত্যটিই তারা মানতে চাননি। নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য এখানেই তিনি সরকার চালাতে গিয়ে এরকম আবেগে ভেসে যাননি। তিনি বুঝেছিলেন, আবেগে ভেসে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতে তার মূল্য চোকাতে হবে বিজেপিকে। আবেগে না ভেসে তাই তিনি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর এই পদক্ষেপে অতি উৎসাহী কেউ কেউ অধৈর্য হয়ে পড়লেও, মোদী এবং তাঁর সহযোগীরা জানতেন, রাজনীতিতে ধৈর্যই শেষ পর্যন্ত সাফল্য এনে দেয়। ধৈর্য হারানোটা রাজনীতিতে পাপ। এবং এ কারণেই নরেন্দ্র মোদী বারবার বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় দেখার পর যা সিদ্ধান্ত তা নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার সহযোগীরা জানতেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করাটাই বিবেচকের কাজ হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায় যদি পক্ষে যায়, তাহলে তা খুবই ভালো। আর বিপক্ষে গেলে আন্দোলনের দরজাটা তখন খুলে দেওয়া যাবে। কিন্তু তা না করে যদি আগেই অর্ডিনান্স করে মন্দির করার চেষ্টা হয়, তবে তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যে কেউ আদালতে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আদালতে মুখ পোড়ার আশঙ্কা থাকে বিজেপির।
রামমন্দিরের সামজিক ও রাজনৈতিক গুরত্ব এবং তাৎপর্য যেভাবে সঙ্ঘ এবং বিজেপি বুঝেছে, কংগ্রেস সেভাবে বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের বাধ্যবাধকতার কারণটি ছিল সংখ্যালঘু ভোট। বিজেপির সেই বাধ্যবাধকতাটি ছিল না। এ বাধ্যবাধকতা থাকলেও অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে কংগ্রেস যে উগ্র বিরোধিতা করেছিল তার কোনো দরকার ছিল না। সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করতে গিয়ে কংগ্রেস নেতা এবং আইনজীবী কপিল সিব্বাল যে আচরণ করেছিলেন— তা সব অর্থেই দৃষ্টিকটু ছিল। আসলে কংগ্রেস ভেবেছিল এই উগ্র বিরোধিতা সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটের পুরোটাই তাদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু কংগ্রেস বুঝতে পারেনি ওই মুসলমান সংখ্যালঘু ভোটে অনেক আগেই থাবা বসিয়েছেন লালু, মুলায়ম, মায়াবতীরা। রামমন্দির রায় যদি রাজনৈতিকভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে যেত তাহলে অবশ্যই কংগ্রেসের লাভ হতো। কিন্তু রায় বিপক্ষে না যাওয়ায় কংগ্রেস পড়েছে। বিপাকে। শাঁখের করাতের মাঝে পড়ে যাওয়া অবস্থা তার। রায়ের খোলাখুলি বিরোধিতাও তারা করতে পারছে না সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন হারানোর ভয়ে। আবার খোলাখুলি সমর্থনও করতে পারছে না সংখ্যালঘু। মুসলমানদের সমর্থন হারানোর ভয়ে। ফলে, চঁদ সদাগরের বাঁ-হাতে মনসা পুজো দেওয়ার মতো করে বলতে হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়কে আমরা মান্যতা দিচ্ছি। শুধু কংগ্রেস নয়। অন্যান্য বিরোধী দলগুলিও সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধাচারণ করেনি। এটাও রাজনৈতিকভাবে বিজেপির আর একটি বড়ো জয়। যারা কিছুদিন আগেও দলবদ্ধভাবে বিজেপির রামমন্দির আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, তারা যখন আজ সুপ্রিম কোর্টের রায়কে মান্যতা দেওয়ার কথা বলছে, তখন বিজেপি বুঝতেই পারছে, এই মুহূর্ত তাদের বিরোধিতা করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তিই আর ময়দানে নেই।
অযোধ্যার এই রায়ের পর অতি উৎসাহে এখনই কাশী-মথুরার দিকে হাত বাড়ানো যে খুব একটা কাজের কাজ হবে না, সঙ্ এবং বিজেপি তাও বুঝছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ বলেই দিয়েছে, কাশী এবং মথুরাকে কেন্দ্র করে তাদের কোনো কর্মসূচি নেই। একই কথা বিজেপিও বলছে। অযোধ্যার পরপরই যদি অতি উৎসাহীরা কাশী এবং মথুরা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে, তাহলে তার ব্যাখ্যা যে অন্যরকম হতে বাধ্য— তা বিজেপি ও সঙ্ঘ নেতৃত্ব জানেন। সে জন্যই রায়ের পর অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণেই মনোনিবেশের ওপর গুরুত্ব দিতে বলছে সঙ্ঘ ও বিজেপি।
রামমন্দির আন্দোলনকে বিজেপি একটি উচ্চতায় পৌঁছে নিয়ে গিয়েছিল— একথা অস্বীকার করা যাবে না। বিজেপি বুঝেছিল, রামমন্দির আসলে ভারতবাসীর অস্মিতার প্রতীক। বিজেপির সাফল্য এখানেই যে, তারা ভারতবাসীর নাড়ির স্পন্দনটি বুঝতে পেরেছিল, যেটা অন্য কেউ পারেনি। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর রাজনৈতিকভাবে বিজেপির সমর্থন আরও মজবুত হবে এ। নিশ্চিত। এবং তার থেকে বিজেপি ফসল তুলবে— তাও নিশ্চিত। আরও একটি কথা না বললেই নয়। শুধু অযোধ্যায় রামমন্দির। সংক্রান্ত রায়ই নয়, আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়ও রাজনৈতিকভাবে বিজেপির পক্ষেই গিয়েছে। রাফাল মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার জানিয়েছে, এতে কোনো দুর্নীতি বা বেনিয়মের চিহ্নমাত্র নেই। উপরন্তু কংগ্রেস এবং বিরোধীরা যেভাবে রাফাল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছেন তাকে ভৎর্সনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। চাচা নেহরুর জন্মদিনে এই রায় প্রকাশ করে জাতীয় কংগ্রেসের বালখিল্য নেতা রাহুল গান্ধীকে একটি মোক্ষম চড় কষিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই দিনই শরবীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ সংক্রান্ত মামলাটি পুনর্বিবেচনার জন্য সাত সদস্যের বিশেষ বেঞ্চের কাছে পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আয়াপ্পান গোষ্ঠীর আবেগে আঘাত দিয়ে আগে যে রায় দেওয়া হয়েছিল। তাকে এভাবেই সুপ্রিম কোর্ট মান্যতা দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টও মনে করেছে ওই রায় যথাযথ হয়নি। তার পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। কেরলে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করে আয়াপ্পান গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছিল বিজেপি। তাতে কেরলে বিজেপির জনভিত্তিও ক্রমশ বাড়ছে।
শবরীমালা সংক্রান্ত রায় কেরলে বিজেপিকে আরও শক্তিশালী করবে। আর একথা বলতেই হচ্ছে, সাম্প্রতিক কালের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রমাণ করেছে, বিজেপি ভুল পথে চলেনি।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.