এবার আম মাহাঙ্গা’চীনা ফল’ ছেয়েছে বাজার

এ বছর আমের মুকুল আসার পূর্বাপর কয়েক মাস আবহাওয়া জনিত প্রতিকূলতা ছিলই, তার উপর সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এর প্রভাব। এসব কারণে দক্ষিণ বঙ্গের বাজারে আম মাহাঙ্গা। ফলহারিণী কালীপুজো এবং জামাইষষ্ঠীর মরশুমেও বাজারে আমের আমদানি মোটেই নজর কাড়ে নি। জলদি জাত বোম্বাই, হিমসাগরের ফলন দক্ষিণবঙ্গে অত্যন্ত কম। মালদাতেও এবার আমের ফলন আশাপ্রদ নয়। কিন্তু এ বছর লিচুর ফলন বিগত কয়েকবছরের মধ্যে সেরা, বিশেষত মুজফফরপুর ও বোম্বাই জাতের লিচুর ফলন। চাষীর আয়ও তাই ভালো। লিচুচাষীর মুখে হাসি। যদিও অনেকে ‘রেমাল’-এর কারণে আগে লিচু পেড়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, পাছে অপচয় হয়!

লিচুর আদি নিবাস হচ্ছে চিন। তাই অনেকে একে ‘চায়না প্রোডাক্ট’ বলে থাকেন। কিন্তু যে গাছ আড়াইশো বছর ধরে এদেশের মাটি, জলহাওয়ার সঙ্গে বিশেষভাবে মানিয়ে নিয়েছে, মানুষের সঙ্গে পরিবেশগত সখ্যতা জন্মিয়ে দিব্যি থিতু হয়েছে, তাকে আমরা বিদেশি ফল বলতে পারি না। বছর দশেক আগে একটি রেডিও সাক্ষাৎকারে কলকাতা স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলাম। আলোচনার মধ্যে জনৈক পীযূষ দেবের লেখা একটি ছড়া পাঠ করেছিলেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। ছড়াটির মধ্যে ছিল লিচুচাষের সদর্থকতা, তার সঙ্গে চীনা প্রসঙ্গ —
“কপালেতে হাত?/চায়না প্রোডাক্ট,/দিও না ফেলে/চাষির ছেলে/রসালো স্বাদু/আছে কি জাদু!/লিচুর ফলে/কৃষি স্বচ্ছলে,/উন্নত জাত/বাড়াও হাত/থাকে যদি জমি,/লাগাও এখুনি/ফিরে দেব ধন/পাবে মন মন।” মনে আছে সেদিন পরাশর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছড়া পড়া হয়েছিল, “চিন থেকে এল লিচু/শাহি, দেশি, বেদানা,/কসবা, পূরবী, নফর,/দেরাদুন, চায়না।/মিষ্টি মধুর ফল/খাসা খেতে চায়না।/দাম যা তখন চড়া,/দাম দিয়ে পাই না।” এই ছড়ার মধ্যে ছিল লিচুর জাতবৈচিত্র্যের রকমফের, আর লিচুর উচ্চমূল্যের কথা।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে মায়ানমার হয়ে অসমের মধ্যে দিয়ে ভারতে এসে পৌঁছায় লিচু। লিচু চাষের জন্য আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া প্রয়োজন হয় যা ভারতবর্ষে আছে। লিচু কিন্তু নির্দিষ্ট আবহাওয়াই পছন্দ করে। সেখানে যদি সঠিক আবহাওয়া না পায়, লিচুর ফল ভাল হবে না, গাছ বাড়বে না, গাছ মরে যাবে। লিচু চাষ করতে হলে বরফ বা তুষারপাত মুক্ত অঞ্চল হওয়া চাই। গরম তাপপ্রবাহ বা লু-আবহাওয়া হলে সেখানে লিচুচাষ চলবে না। গরমকালে যে বাতাস বয়, তা আটকাতে লম্বাজাতের গাছ বা ‘উইণ্ডব্রেক’ পাশে লাগাতে হবে। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১২০০-১৫০০ মিলিমিটার হওয়া দরকার। তার থেকে কম বৃষ্টিপাতেও লিচুচাষ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে মাটিতে যাতে আর্দ্রতা যথাযথ সঞ্চিত থাকে তার জন্য কিছু গাছের পাতা, খড় ইত্যাদি দিয়ে মাটি ঢেকে দিতে হবে, যাতে বাষ্পীভবন না ঘটে। গড় মাসিক তাপমাত্রা হতে হবে ২০-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সেটা ভারতবর্ষের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আছে। শীতকালে আবহাওয়া শুষ্ক হওয়া দরকার। থাকতে হবে কাঁটা লাগা শীত।

লিচুর জন্য বেলে-দোঁয়াশ বা এটেল-দোঁয়াশ মাটি দরকার। নবীন পলিমাটি বিশেষ করে ফারাক্কা, কালিয়াচক অঞ্চলে যে নবগঠিত পলিমাটি সেখানে ভাল লিচুর চাষ হয়। মাটির পিএইচ ভ্যালু বা ক্ষারাম্ল মান ৫.৫ থেকে ৬.৫ হতে হবে। মাটির গভীরতা যথেষ্ট থাকতে হবে, তার কারণ গাছের শিকড় মাটির গভীরে ছড়িয়ে যায়। তাই যেখানে মাটির স্তর অল্প সেখানে লিচুগাছ লাগানো যায় না। জলস্তরের লেবেল দেড় থেকে দুই মিটার গভীরে থাকতে হয়। যেখানে লিচুগাছ লাগানো হয় সেখানে অন্য জায়গা থেকে লিচুগাছের গোড়ার কিছুটা মাটি সংগ্রহ করে এনে বিছিয়ে দিতে হবে। তার কারণ সেখানে থাকে লিচুর বাড়বাড়ন্তের জন্য উপযোগী মাইক্রোরাইজা জীবাণু।

আমরা অনেক ফসল দেখেছি যা আদি বাসভূমি থেকে বাইরে ছড়িয়েছে। নতুন পরিবেশে তার ফলনও গেছে বেড়েছে। পর্তুগীজেরা লাতিন আমেরিকা থেকে যে সমস্ত ফসল ভারতবর্ষে এনেছিলেন তার মধ্যে লঙ্কা, কুমড়ো ইত্যাদি ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে সেখানে যা উৎপাদন হতো তার থেকে বেশি উৎপাদন অন্যান্য জায়গায় হচ্ছে। লিচু ভারতবর্ষের আদি ফসল না হলেও তাকে বহিরাগত ফসল বলা চলে না। আর আদি/অন্ত এটার ব্যাপারে শেষ কথা বলবেই বা কে!

লিচুচাষের সবচেয়ে অগ্রগণ্য রাজ্য হল বিহার। বিহার ছাড়া উত্তরপ্রদেশ লিচুচাষের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। এছাড়া অসম, ওড়িশা, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ লিচু উৎপাদক রাজ্য হিসাবে নজর কেড়েছে।

ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে লিচুর উৎপাদনশীলতা প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০ মেট্রিক টন। লিচুর চাষ লাভজনক বলেই নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহের বহু চাষী লিচু চাষ করছেন৷ দক্ষিণ ২৪ পরগনার মধ্যে বারুইপুর মহকুমা যেখানে মাটিতে নোনাভাব কম, সেখানেও ভালো লিচু উৎপাদন হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য উন্নতমানের লিচু উৎপাদন করা প্রয়োজন।

বিশ্ববাজারে সমাদৃত হয় ‘লিচি-নাট’ বা শুকনো গোটা লিচু। পাশাপাশি সতেজ লিচু, লিচু পানীয়ের বিষয়েও ধ্যান দিতে হবে৷ লিচি-নাট হল এক ধরনের প্রক্রিয়াকৃত পদার্থ। লিচুর খোলাটা আছে, ভিতরে শাঁস আছে এবং ভিতরে বীজটাও আছে। কিন্তু সেটা একটা শুকনো ফলের মতো। চিন দেশে এটা খুব জনপ্রিয়। লিচুটিকে গোটা শুকিয়ে নেওয়া হয়। তারপর নাটটাকে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত রাখতে হয় মাটির হাঁড়িতে বা অন্যত্র। এটাই হল লিচু-নাট। লিচুকে অল্প ঘনত্বের হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে সামান্য ধুয়ে নেওয়া হয়। তারপর সেটাকে ভাল করে জলে ধুয়ে কিছুটা গরম জলে আংশিক সেদ্ধ করে নিয়ে কোনোও একটি জায়গাতে সালফার ডাই অক্সাইডের ধোঁয়ায় জীবাণু মুক্ত করা হয়। তারপর সেটাকে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। এইভাবে তার মধ্যে জলীয় পদার্থকে শুকিয়ে দীর্ঘদিন রাখা যায়। একেই বলে লিচু-নাট। সারা বিশ্বে বিশেষ করে চীন, জাপান, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ইত্যাদি জায়গায় জনপ্রিয়।

লিচুর উন্নত জাতের মধ্যে বোম্বাই, বেদানা, নফরপাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গে যে জাত চাষ হয় তার মধ্যে বোম্বাই জাত বাণিজ্যিক দিক দিয়ে সবচেয়ে অগ্রগণ্য। বোম্বাই জাতটা জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকে। তারপরে আসে চায়না। তবে গুণমানে যে জাতটা সবার নজর কেড়েছে সেটা হল বেদানা। নাম থেকেই স্পষ্ট যে এতে দানা নেই। কিন্তু দানা আছে, সেই বীজটা খুব ছোটো, শাঁসের পরিমাণই বেশি৷ দেশি জাতটি জ্যৈষ্ঠের শেষার্ধে পাকে, আবার অনেক সময় আষাঢ়ের প্রথমে একে পাওয়া যায়। এছাড়া মুজফফরপুর বিহারের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যিক জাত। এটা আবার দুই রকম — আর্লি এবং লেট। পশ্চিমবঙ্গে কিছু আঞ্চলিক জাত পাওয়া যায়। যেমন বারুইপুর, কলকাতা (কলকুটিয়া), পূরবী। তবে বোম্বাই জাতের চাষ সবচেয়ে বেশি। তারপরই চায়না। এছাড়া এলাচি, গুলাবি জাতও পাওয়া যায়। এলাচিতে এলাচের গন্ধ আট গুলাবিতে গোলাপের গন্ধ।

লিচুকে গুটি কলম বা জোড় কলমের দ্বারা বংশবিস্তার করান যায়। চারা রোপণের আদর্শ সময় হচ্ছে জুন-জুলাই এবং সেপ্টেম্বর মাস। ৮মি x ৮মি থেকে ১০ মি x ১০মি দূরত্বে চারা রোপণ করতে হবে। রোপণের দূরত্ব নির্ভর করে জাত, মাটি আর আবহাওয়ার উপর। চারা রোপণের সময় ৯০ সেমি x ৯০ সেমি x ৯০ সেমি মাপের গর্ত করতে হবে, গর্তে দিতে হবে ২০ কেজি গোবর বা কম্পোষ্ট সার, ২ কেজি কাঠের ছাই, ৫০০ গ্রাম হাড়ের গুড়ো এবং এক ঝুড়ি পুরনো লিচু গাছের গোড়ার মাটি। গাছ প্রতি বছর প্রতি নাইট্রোজেন ফসফেট এবং পটাশ যথাক্রমে ১০০, ৫০ এবং ১০০ গ্রাম করে দু’বারে সার দিতে হবে। সেচের ব্যবস্থা থাকলে ফল পাড়ার পর এবং গুটি ধরার পর সার দিতে হয়। সেচের ব্যবস্থা না থাকলে ফল পাড়ার পর পুরো নাইট্রোজেন ও অর্ধেক পরিমান ফসফেট ও পটাশ এবং বাকী অর্ধেক ফসফেট ও পটাশ সেপ্টেম্বর মাসে প্রয়োগ করতে হবে।

চারা গাছে গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে দুদিন এবং শীতকালে ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। ফল ধরলে ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন এবং ফল পাড়ার দিন ১০ আগে তা বন্ধ করতে হবে। গুটির বাড়-বৃদ্ধি করতে ও গুটি-ঝরা বন্ধ করতে ফলের আকার মটর দানা ও মার্বেল অবস্থা লাভ করলে এন এ এ ২০-৩০ মিলিগ্রাম অথবা জিব্বারেলিক অ্যাসিড ২৫-৫০ মিলিগ্রাম অথবা ২,৪-ডি ১০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
ফল ফাটা ও মরচে ধরার সমস্যা দেখা দিলে ফল ধরার পর ৭-১০ দিন অন্তর নিয়মিত ভাবে সেচ দিতে হবে। আর দিতে হবে অনুখাদ্য-জিঙ্ক সালফেট ১.০ শতাংশ, বোরন ০.৩ শতাংশ । এই অনুখাদ্য ফল ধরার ১৫ দিন পর থেকে ১৫ দিন অন্তর ২ বার প্রয়োগ করলে ফল ফাটা ও মরচে ধরা সমস্যা কম দেখা যায়।

লিচু চাষ করে কি চাষিরা লাভবান হতে পারবেন? এককথায় উত্তর হল অবশ্যই পারবেন। কারণ লিচু চাষ আজ এক শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে, একটি ভৌমশিল্প যেন! এ রাজ্যে লিচুর উৎপাদনশীলতা হেক্টরে প্রায় ১০ মেট্রিকটন। ফলে এক বিঘাতে উৎপাদন প্রায় তেরশো কেজি। যদি বাগান থেকে চাষি কুড়ি টাকা কেজি দরেও ফল বিক্রি করতে পারেন (যদিও বাজারে দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা কিলো), তাহলে এক বিঘা জমি থেকে ফল বেচে চাষী পাবেন প্রায় আঠাশ/তিরিশ হাজার টাকা। চাষের খরচ বিঘাতে প্রায় আট হাজার টাকা বাদ দিলে চাষির নীট লাভ থাকবে বিঘায় কুড়ি/বাইশ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যদি সাথী-ফসল হিসাবে বাগান তৈরির প্রথম দফায় কিছু সবজি ও পরে কিছু মশলা যেমন আদা-হলুদ লাগানো যায়, তবে বিঘাতে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা লাভ হবে। তবে মনে রাখতে গাছের বাড়-বাড়ন্ত বেশি হলে ইচ্ছেমত সবজি চাষ করা সম্ভব হয় না। তাহলেও দেখা যাচ্ছে একবিঘা জমি থেকে সাথী-ফসল সমেত মোট আয় পঁচিশ হাজার টাকা। এটা প্রথাগত চাষ করে চাষি পেলেন। এবার তার সঙ্গে যদি নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যোগ করা যায়, তাহলে চাষের উৎপাদন কমপক্ষে পঁচিশ শতাংশ বাড়তে পারে, অবশ্য চাষের খরচও সামান্য বাড়বে। যদি এই পঁচিশ-ত্রিশ শতাংশ ফলন অধিক হয় তখন লাভের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় একত্রিশ হাজার টাকা।
এই লাভের অঙ্কটা আসবে সাধারণভাবে ১০x১০ মিটার দূরত্বে লিচু গাছ লাগিয়ে হয়। এবার তার সঙ্গে যদি ঘন চাষ করা হয় (High density Orchard), তবে লাভের পরিমাণ আরও বাড়ে। দ্বি-বেড়া সারি (Double Hedge Row System) করে লিচু লাগালে; প্রথাগত পদ্ধতিতে যেখানে বিঘাতে ১৩ টি গাছ লাগানো সম্ভব হয়, দ্বি-বেড়া সারিতে বিঘাতে ২৯ টি গাছ লাগানো যাবে, অর্থাৎ ২২২ শতাংশ বৃদ্ধি। দ্বি-বেড়া সারিতে দুটি বেড়ার মধ্যের দূরত্ব থাকবে ৫ মিটার এবং বেড়া-সারিগুলির মধ্যে গাছের দূরত্বও ৫ মিটার হবে। দুটো বেড়া সারির মাঝে স্বাভাবিক দূরত্ব হবে ১০ মিটার। তারপর আবারও দুটি বেড়া সারি দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে লিচু লাগালে এক বিঘাতে ৫০-৬০ হাজার টাকা চাষি লাভ করতে সক্ষম হবে।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.