একটি ইতিহাস ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি : পর্ব ২


পর্ব_২

Hindu Refugees From Bangladesh


পূর্বের পর্বে আমি বলেছিলাম যে কিভাবে ব্রিটিশ শাসন থেকে পরবর্তীকালে একটা দীর্ঘ সময় ধরে উত্তর-পূর্ব ভারত কিভাবে ইসলামিক আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। কত নোংরা রাজনৈতিক চক্রান্ত ছিল। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর গতিবিধি পর্যালোচনা করলে কথা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভয়ংকরতম গণহত্যা সংঘটিত করে ওই দেশ গুলি কেবল হিন্দুশূন্য করাই নয় , তৎসহ আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ কে নিয়ে বৃহত্তর ইসলামিক প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে তারা এখনও সক্রিয় ।অনুপ্রবেশের মধ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্য কাশ্মীরের মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করা এই সমস্ত সংগঠনগুলির কূটনীতি, রাজনীতি এবং রণনীতির অঙ্গ।  ভূমিহীন হতদরিদ্র মুসলিম জনতার ভারতে অনুপ্রবেশের পিছনে অর্থনৈতিক কারণে সাথে সাথেই এই সমস্ত ইসলামিক গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও সহায়তায় রয়েছে ।

1964 DHAKA Riot , Adi Dhakeshwari Mandir


স্বাভাবিকভাবেই ভারতে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ নীতির আড়ালে ভোটব্যাঙ্ক তৈরীর লক্ষ্যে রাজনৈতিক চিন্তা ও কাজ ইসলামিক জেহাদিদের স্বপ্নপূরণের পথে সহায়ক। স্পষ্টতই স্বাধীনোত্তর ভারতে এই ভোটব্যাঙ্ক নীতির জন্য দেশ ভাগের পরও পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ থেকে আসাম এবং  পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। অজস্র সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আসাম ও পশ্চিমবঙ্গকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পরিণত করতে পরিকল্পনা করে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। 

Partition and Blood

 আসামে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার মহম্মদ কামালউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি হোজাই জেলার যমুনামুখ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হন । অভিযোগ ওঠে ওই ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক এবং তার কাছে পাকিস্তানি পাসপোর্ট রয়েছে। কামালউদ্দিন মামলায় গুয়াহাটি হাইকোর্ট এই রায় দেন যে, এই ব্যক্তি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে ।বিভিন্ন জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত আসামে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছে।


 ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করার পরে থেকেই পাকিস্তান থেকে শুরু হয় নির্বিচারে হিন্দু নিধন , হিন্দু নারীদের উপর নারকীয় অত্যাচার , হিন্দু সম্পত্তি দখল । তথ্যসূত্র বলে থাকে বিশ্বে এত বৃহৎ নৃশংসতা নরসংহারের দৃষ্টান্ত আর নেই। মা বোনের ইজ্জত খুইয়ে, সর্বস্ব হারিয়ে ইসলামিক জল্লাদদের হাত থেকে শুধুমাত্র প্রাণে বাঁচতে কয়েক কোটি হিন্দু শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল ভারতবর্ষে ।

Partition ,Bengali Hindu Refugees and Tear


 পাকিস্তান ভাগ হয়ে বাংলাদেশ গঠনের সময় সংঘটিত হয়েছিল নির্বিচারে বাঙালি হিন্দু হত্যা।উদ্বাস্তু স্রোত আছড়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন ভারত উদ্বাস্তুদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছে কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে তাঁরা বা ফিরে যাবেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রায় পাঁচ দশক হয়ে গেছে সেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিত তো দূরের কথা বরং যে সমস্ত হিন্দুরা মাটি কামড়ে এতদিন ধরে পড়ে ছিলেন তারাও ধীরে ধীরে ভারতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে বা  বর্তমান বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ২৪ শতাংশ হিন্দু ছিল , এখন তা মাত্র ৭ শতাংশ ও ১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। 

Bengali Hindu refugees from EAST Pakistan


হিন্দু বিতাড়ন সম্পূর্ণ করে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করে জিহাদী গোষ্ঠীগুলো পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য গুলি নিয়ে আরও বৃহত্তর ইসলামিক সাম্রাজ্য গ্রেটার বাংলাদেশ তৈরীর নীল নকশা ছকে ফেলে। এই নকশা রূপায়ণের জন্য লেবেনশ্রম তত্ত্বের দোহাই দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে ।  এটা শোনা যায় যে ৬ এর দশকে রংপুরে অসমীয়া ভাষা শিখিয়ে আসামে মুসলিম অনুপ্রবেশ করা যাতে তারা নিজেদের আদি বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিতে পারে । নিজেদের অসমিয়া প্রতিপন্ন করতে বাংলাদেশি মুসলমানরা জনগণনায় নিজেদের মাতৃভাষা অসমীয়া উল্লেখ করতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজকে দুর্বল করার জন্য বাঙ্গালী হিন্দু ও অসমীয়া হিন্দুদের মধ্যে নানা উপায় ঘৃণা ছড়িয়ে দাঙ্গা বাঁধানো হত এবং এখনো হয় । এই সমস্ত উপায়ের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উপায় হলো কোনো অসমিয়া বা বঙ্গভাষীদের মধ্যে কাউকে খুন করে বা ধর্ষণ করে গুজব রটিয়ে দাঙ্গা বাঁধানো।

Biplabi Lalmohan Sen… Brutally murmured by Muslims at Noakhali Danga

একসময় অসমের মাটিতে স্লোগান  উঠত ” মিঁয়া অসমিয়া ভাই ভাই,  বাঙ্গালী র ( হিন্দু)  ঠাঁই নাই /রক্ত চাই “….. ছয় ও সাতের দশকের পরিকল্পনা করতে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে থেকে বিপন্নতা বোধ থেকে জেগে ওঠা উগ্র অসমীয়া সেন্টিমেন্টের অভিমুখকে সম্পূর্ণভাবে বাংলাভাষী হিন্দুদের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য নানারকম কুটকৌশল আশ্রয় নেওয়া হয়। এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল সন্দেহ নেই যে এই গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল। সন্দেহ নেই যে  জন্য একসময় আসামের নাম শুনলে মানুষের চোখে ভেসে উঠতে জাতিদাঙ্গা , হরতাল, বাঙ্গালী হিন্দু বিতাড়ন, সন্ত্রাসী হামলার চিত্র । 
একটু সেই সব বঙাল খেদাও দাঙ্গার বিবরণ দি। নইলে আমার নরক বাস হবে….
১৯৪৮ সালের ১ লা মে আসামের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া অসমীয়া ও বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে একটি জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।গুয়াহাটিতে বাঙ্গালী-মালিকানাধীন দোকানগুলি লুট করা হয়েছিল অসমীয়াদের দ্বারা। ১৯৫৬ সালে, পূর্ববাংলার অবিভক্ত গোলপাড়া জেলার ব্যাপক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, যখন রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন জেলার সাথে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য জেলা পরিদর্শন করে।  প্রায় ২৫০ বাংলা ভাষা মাধ্যমের মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে রাতের অন্ধকারে আসামি ভাষার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়।

Bongal Kheda

১৯৬০ সালের জুন মাসে বাঙালি হিন্দুদের উপর হামলা শুরু হয়। এটি প্রথম গুয়াহাটির কটন কলেজে শুরু করে এবং তারপর রাজ্যের সমস্ত স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।  ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাঙ্গালী হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আক্রমণ করে।  কামরূপ জেলার গোরেশ্বরের ২৫ টি গ্রামে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ঘটে। বিচারপতি গোপাল মেহেরপুরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী ৯ জন বাঙালির মৃত্যু হয় এবং একশ’র বেশি আহত হন। মহিলাদের উপর আক্রমণের অন্তত একটি ঘটনা ছিল। বাঙ্গালীদের ৪,০১৯ টি কুটির এবং ৫৮ টি ঘর ভাংচুর ও ধ্বংস করা হয়। গুয়াহাটি জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, যিনি একজন বাঙ্গালী হিন্দু ছিলেন, এর জন্য তার বাড়িতে প্রায় ১০০ জন আক্রমনকারী ভিড় করে এবং তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। পুলিশের উপপরিদর্শক, বাঙ্গালী হিন্দু হওয়ায় তাকেও লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ এবং আসাম মেডিক্যাল কলেজের াঙ্গালী হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীদের জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়।ডিব্রুগড় এলাকায় বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। বাঙ্গালী হিন্দু বাড়িগুলি লুটপাট করা হয়, পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং অধিবাসীদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।

হাজার হাজার বাঙ্গালী হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বিতাড়িত হয় এবং পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত হয়। এক অনুমান অনুযায়ী ৫,০০,০০০ বাঙ্গালী হিন্দু অসম থেকে বাস্তুচ্যুত হন।পশ্চিম বঙ্গে হাজারো শরণার্থী পর্যায় আসে। প্রায় ৪,০০০ শরণার্থীর প্রথম ব্যাচটি ১৯৬০ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ জুলাই এবং ১১ জুলাইয়ের মধ্যে এসে পৌঁছায়। ৪৪৭ এর পরবর্তী ব্যাচের ১২ থেকে ২০ জুলাই এর মধ্যে আগমন ঘটে। বাকি বাঙ্গালী শরণার্থীর ৩১ জুলাই পরে এসেছিল। জুলাই-সেপ্টেম্বরের সময়, প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়।

এদিকে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে নীরবে ভারত দখলের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো ।পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের তথা কথিত সেকুলার , ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি চিতার আগুনে রুটি সেঁকতে ব্যস্ত ছিল। অসহায় দরিদ্র মানুষকে সাহায্য নামক মানবতার মোড়কে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির লক্ষ্যে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের মুসলিম অনুপ্রবেশ কারীদের ধরিয়ে দিয়েছে রেশন ও ভোটার কার্ড। কেউ কিন্তু এক বারের জন্যও বাঙ্গালী হিন্দুর জন্য কথা বলে নি। পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে আমরা স্পষ্ট ধারণা পাই যে,  একদিকে ইসলামের অনুপ্রবেশ এবং অন্যদিকে ইসলামের জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ ফতোয়া দিয়ে হাম পাঁচ হামারা পচ্চিশ  নীতির অনুসরনে উৎসাহ যুগিয়েছ ইসলামিক জেহাদিরা আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে জনচরিত্রের ভারসাম্য পাল্টে দিয়েছে তা বাস্তবিক সত্য।
৭১ সালে বাংলাদেশ গঠনের সময় প্রায় ৩ লক্ষ উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছিলেন আসামে। এই উদ্বাস্তুরা সর্বস্ব হারানো বাঙ্গালী হিন্দুরা ছিলেন সিংহভাগ। মনে করা হয় বাংলাদেশ গঠনের পর এনারা দেশে ফিরে যাননি । ফিরে যাবার কথাও নয়। কারন ততদিনে নরক বলতে পাকিস্তান ও পূর্ব বঙ্গ কে বলা হয় সেটা বাঙ্গালী হিন্দু হয়ত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দুঃখের ব্যাপার হলো  এখনো বাংলাদেশ থেকে অনবরত মুসলিম অনুপ্রবেশ হয়ে যাচ্ছে।

 ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী আসামে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৭.২  শতাংশ এবং একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা ছিলনা । ২০১১ সালের জনগণনা মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৪.২২ শতাংশ এবং সেখানে ৯  টি জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত হয় । একটু নাম বলি সেগুলোর ….
 বরপেটা ( ৭৪ শতাংশ মুসলিম) 


বঙ্গাইগাঁও ( ৫০.২২ শতাংশ মুসলিম)


দরং ( ৬৪.৩৪ শতাংশ মুসলিম) 


ধুবরী ( ৭৯.৬৭ শতাংশ মুসলিম) 


গোয়ালপাড়া ( ৫৭.৫২ শতাংশ মুসলিম) 


হাইলাকান্দি (৬০. ৮১ শতাংশ মুসলিম) 


 করিমগঞ্জ (৫৬.৫২ শতাংশ মুসলিম) 

নও গাঁও  ( ৫৫ .৩৬ শতাংশ মুসলিম) 

মরিগাঁও  ( ৫২.৬৬ শতাংশ মুসলিম) 

হিন্দু মেয়েদের ছলে-বলে-কৌশলে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করা , হিন্দু সম্পত্তি জবরদখল করা,  চুরি ডাকাতি থেকে শুরু করে সমস্ত রকমের ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি ,অসামাজিক, দেশবিরোধী ক্রিয়া-কলাপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই সমস্ত এলাকাগুলো।  ১২৬ সদস্যবিশিষ্ট অসম বিধানসভার মুসলিম সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। রিপোর্ট বলছে অসমে বর্তমানে ১৫ টি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন ক্রিয়াশীল আছে।

#একটিইতিহাসজাতীয়নাগরিকপঞ্জি #ক্রমশ

তথ্যঃ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি : সাধন কুমার পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.