বিশ্বের এক নম্বর মহিলা টেবল টেনিস খেলোয়াড় চিনের সুন ইয়েংসাকে হারিয়ে দেশে ফিরে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কলকাতায় ‘ধানুকা ধুনসেরি সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি’ (এই অ্যাকাডেমিতেই অনুশীলন করেন তিনি)-তে দাঁড়িয়ে ঐহিকা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, পরের লক্ষ্য অলিম্পিক্স। দেশের হয়ে পদক জিততে চান। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধাক্কা খেয়েছে। অলিম্পিক্সে টেবল টেনিসের ভারতীয় মহিলাদের দলেই জায়গা পাননি ঐহিকা। বাঙালি তারকার জায়গা না পাওয়া উস্কে দিয়েছে নতুন বিতর্ক। প্রশ্ন উঠছে ভারতীয় টেবিল টেনিস সংস্থার নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে।
বৃহস্পতিবার ভারতের টেবল টেনিস দল ঘোষণা করেছে ফেডারেশন। মহিলাদের দলে রয়েছেন— মণিকা বাত্রা, শ্রীজা আকুলা ও অর্চনা কামথ। ঐহিকাকে রাখা হয়েছে পরিবর্ত হিসাবে। অর্থাৎ, যদি এই তিন খেলোয়াড়ের কেউ চোট পান বা অন্য কোনও কারণে খেলতে না পারেন তা হলে ঐহিকা খেলবেন। পুরুষদের দলে রয়েছেন— শরথ কমল, হরমিত দেশাই ও মানব ঠক্কর। পরিবর্ত হিসাবে রাখা হয়েছে জি সাথিয়ানকে।
পুরুষদের দল নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও মহিলাদের দল নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। ফেডারেশনের বক্তব্য নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। দল ঘোষণার পরে ফেডারেশন একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, মহিলাদের দলের তৃতীয় খেলোয়াড় নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্চনাকেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কারণ, বিশ্ব টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে অর্চনা ভাল খেলেছে। এ ছাড়া ওর বিশ্ব র্যাঙ্কিংও ঐহিকার থেকে ভাল।
ফেডারেশন ব্যাখ্যা দিলেও টেবল টেনিসে সাম্প্রতিক সময়ে ঐহিকা যা পারফর্ম করেছেন তেমনটা করতে পারেননি অর্চনা। এশিয়ান গেমসে সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গী করে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন ঐহিকা। প্রথম ভারতীয় মহিলা জুটি হিসাবে এই কীর্তি করেছেন তাঁরা। তার পরে তিনি হারিয়েছেন বিশ্বসেরাকে। টেবল টেনিসে তাঁর পারফরম্যান্সের জন্য এই বছর অর্জুন পুরস্কারও পেয়েছেন ঐহিকা। বিশ্ব স্তরে তাঁর এই পারফরম্যান্সও কি তা হলে অগ্রাহ্য করেছে ফেডারেশন?
তা হলে কোন যুক্তিতে দল বেছেছে তারা? প্রধান কারণ, সিঙ্গলসে র্যাঙ্কিং। বিশ্ব স্তরে ঐহিকার (১৩৬) থেকে ৩৩ ধাপ এগিয়ে অর্চনা (১০৩)। জাতীয় স্তরে সিঙ্গলসে ২০২৩ সালের শেষে ঐহিকা ছিলেন দু’নম্বরে। অর্চনা তিন নম্বরে। কিন্তু তার পরে কয়েকটি প্রতিযোগিতায় নামেননি ঐহিকা। ক্রমতালিকায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়। সেখানে ঐহিকা পিছিয়ে গিয়েছেন। কয়েকটি প্রতিযোগিতায় নামার আগে ভিসা সমস্যায় পড়েছেন তিনি। তাই যাওয়া হয়নি। আবার চোটের কারণেও কয়েকটি প্রতিযোগিতা থেকে নাম তুলে নিয়েছেন। সেই সব জায়গায় খেলে নিজের র্যাঙ্কিং বাড়িয়ে নিয়েছেন অর্চনা। ফেডারেশন সেটাই দেখেছে।
অর্চনার পক্ষে গিয়েছে আরও একটি বিষয়। মণিকার সঙ্গে তাঁর ডাবলস জুটি। দু’জনে মিলে বিশ্ব স্তরে বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তাঁদের র্যাঙ্কিং ৪। তাঁদের খেলার ধরন অনেকটা একই রকম। সেই কারণেই হয়তো নির্বাচকেরা ঐহিকার থেকে অর্চনাকে এগিয়ে রেখেছেন।
কিন্তু অলিম্পিক্সে তো প্রতি রাউন্ডে একটি ডাবলস ম্যাচ খেলতে হয়। সেখানে চারটি সিঙ্গলস ম্যাচ হয়। মণিকার সঙ্গে শ্রীজাও জুটি বেঁধে খেলেছেন। ফেডারেশন চাইলে সিঙ্গলসের দিকে বেশি নজর দিতে পারতেন। গত কয়েক মাসে সেখানে কিন্তু অর্চনাকে টেক্কা দিচ্ছেন ঐহিকা।
দল ঘোষণার পরে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে ঐহিকার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন তোলেননি। ঐহিকার কোচ তথা প্রাক্তন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন পৌলমী ঘটক জানিয়েছেন, এই খবরে খুবই ভেঙে পড়েছেন ঐহিকা ও তাঁর পরিবার। পৌলমী নিজেও খুব হতাশ। তিনি সরাসরি না বললেও তাঁর কথায় উঠে এসেছে নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন। পৌলমী বললেন, “আমরা সবাই এই খবরে খুব হতাশ। ভাবতে পারিনি যে ঐহিকা সুযোগ পাবে না। ফেডারেশন আগে থেকেই দল নির্বাচনের একটা মাপকাঠি তৈরি করে দিয়েছিল। সেখানে বিশ্ব ও জাতীয় স্তরে র্যাঙ্কিং অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐহিকা বিশ্বের এক নম্বরকে হারিয়েছে। এশিয়ান গেমসে পদক জিতেছে। সেগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হলে ওই সুযোগ পেত।”
অর্চনা সুযোগ পাওয়ায় ক্ষোভ নেই পৌলমীর। কারণ, হাজার হলেও দেশের হয়ে লড়বেন তাঁরা। কিন্তু তার পরেও হতাশা যাচ্ছে না তাঁর। পৌলমী বললেন, “ঐহিকা কয়েকটা প্রতিযোগিতায় নামতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে ভিসা পায়নি। চোটের জন্যও একটা প্রতিযোগিতা থেকে নাম তুলে নিয়েছিল। সেটাই অর্চনা কাজে লাগিয়েছে। ওদের শুভেচ্ছা। আমরা ভেবেছিলাম ঐহিকা সরাসরি দলে থাকবে। পরিবর্ত হিসাবে সুতীর্থা থাকবে। কিন্তু ঐহিকাকেই পরিবর্ত হিসাবে রাখা হল। আমরা খুব হতাশ।”
ভারতীয় টেবল টেনিস নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। খেলোয়াড় থেকে শুরু করে কোচ— নাম জড়িয়েছে অনেকের। কিন্তু এশিয়ান গেমসের পর থেকে টেবল টেনিস নিয়ে আশা বাড়ছিল। গত কয়েক মাসে সেই আশা বাড়ানোর নেপথ্যে প্রধান মুখ ছিলেন ঐহিকা। সেই তিনিই এ বার জায়গা পেলেন না দলে। আরও একটি বিতর্ক তৈরি হয়ে গেল।