পশ্চিমবঙ্গে ডালশস্য চাষে চাহিদা ও যোগানের মাঝে বিস্তর ফারাক; কৃষি বিজ্ঞানীরা তাই চাষ ও ফলন বাড়াতে নানাভাবে সচেষ্ট হচ্ছেন। তার মধ্যে যেমন রয়েছে শস্যপর্যায়ে আমন-ধানে পয়রা ফসল রূপে মসুর, খেসারি; এমনকি অধুনা ধান ও ধানের পায়রা-ছোলা ও পয়রা-মটর এবং নানান মিশ্রচাষে সাথী বা অন্তবর্তী ফসলরূপে ডালশস্যের সংযুক্তি (উদাহরণ: ছোলার জমিতে সরষে ৪:১ অনুপাতে; আখের ক্ষেতে ছোলা; রাই সরষে, তিসি, গমের সঙ্গে ছোলার মিশ্র চাষ; আখ, তিল, তোষাপাটের সঙ্গে সাথি ফসল হিসাবে মুগ; অড়হর, তুলো, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টার সঙ্গে মুগ ইত্যাদি) ডালচাষে জোয়ার আনতে পারে। তবে সমস্যা হল, নতুন জমি পাওয়া মুস্কিল। তাই, তৃতীয় যে উপায়, তা হল, ফল বাগিচায় সাথী ফসল হিসাবে ডালশস্যের চাষকে জনপ্রিয়-করণ
বাগিচায় কীভাবে করবেন ডালশস্য
আম-কাঁঠাল-লিচু-সবেদা প্রভৃতি ফসলে ১০-১২ বছর; নারকেলে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত বাগিচায় বিভিন্ন ঋতুতে ডালশস্য চাষ করা যাবে। গাছের গোড়া ছেড়ে জমি চাষ দিয়ে দেড় মিটার ছেড়ে সারিতে বীজ বুনলে সবচাইতে ভালো; অনেকে অবশ্য শ্রমিকের অভাবে ছিটিয়ে বীজ বোনেন।
বাগিচাতে চারটি ঋতুতে ডালশস্য বোনা চলে — প্রাক্-খরিফে মুগ ও কলাই; খরিফে অড়হর ও সয়াবীন; খারিফোত্তর মরশুমে মুগ ও কলাই এবং রবি মরশুমে মুসুরি, খেসারি, ছোলা ও মটর। এইভাবে মুগ ও কলাই বোনা যাবে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে এবং তারপর আগষ্টে; অড়হর এবং সয়াবীন জুন-জুলাই মাসে; রবি অড়হর বুনতে হবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে; মুসুরি, মটর ও খেসারি বোনার আদর্শ সময় হল অক্টোবর থেকে নভেম্বর আর ছোলা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর।
মুগ ৫৫-৭০ দিনের ফসল, নানান জাতে ফলন ক্ষমতা হেক্টরে (সাড়ে সাত বিঘায়) ৭.৫ থেকে ১৪ কুইন্টাল। কলাই ৭০-৯০ দিনের ফসল, ফলন ক্ষমতা ৯-১৪ কুইন্টাল। অড়হর ১৪০-১৭০ দিনের ফসল, ফলন হেক্টরে ১৬-২৫ কুইন্টাল; সয়াবীন ৯৫-১২৫ দিনের ফসল, ফলন হেক্টরে ২০-২৫ কুইন্টাল; খেসারি ১১০-১৩০ দিনের, ফলন হেক্টরে ১৫-২৮ কুইন্টাল; মটর ৮০-১৩৫ দিনের ফসল, ফলন হেক্টরে ১৫-১৮ কুইন্টাল; মুসুর ১১৮-১৩০ দিনের, ফলন হেক্টরে ১৪-২০ কুইন্টাল; ছোলা ১২০-১৩৫ দিনের শস্য, ফলন হেক্টরে ২০-২৪ কুইন্টাল। যেহেতু সাথী ফসল, ফলে স্বাভাবিক একক ফসলের চাইতে ৩০-৫০ শতাংশ ফলন কম হবে।
সাধারণভাবে এক বিঘা জমিতে যে বীজ দরকার হয়, সাথী ফসলে তার চাইতে কম বীজ প্রয়োজন হবে। নারকেলের জমিতে আট বছর পর্যন্ত সাথী ডালশস্য নেওয়া যায় ৫০ শতাংশ জমিতে। আম, লিচুতে দ্বি-বেড়া সারিতে (Double Hedge Row System) ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ৭০ শতাংশ জমিতে এবং ৮ থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত ৫০ শতাংশ জমিতে সাথী ডালশস্য সাফল্যের সঙ্গে নেওয়া যাবে। সাধারণ বীজের হার দেওয়া হল, এ থেকে পরিমাণ মত বীজের মাত্রা কমিয়ে সাথী ফসলে বীজের হার অঙ্ক কষে বার করে নিন। প্রতি বিঘা স্বাভাবিক জমিতে মুগ, কলাই ও অড়হরে বীজের হার সোওয়া তিন থেকে চার কেজি; রবি অড়হরে ১০ কেজি; সয়াবীনে সাড়ে ছয় থেকে ১০ কেজি; মুসুরিতে সাড়ে চার কেজি; মটরে সাড়ে ছয় থেকে ৮ কেজি; খেসারিতে সাড়ে পাঁচ এবং ছোলায় আট কেজি প্রয়োজন হবে। সাথী ডাল চাষ করার জন্য মূল ফসলে ৩০-৫০ শতাংশ জায়গা বরাদ্দ রাখতে হবে, বাকি জায়গায় আনুপাতিকভাবে বীজের হার ও সারি তৈরি করতে হবে।
বাগিচায় সারিতে বীজ বোনা হলে মুগ, কলাই, রবি অড়হর, মুসুরি, মটর, খেসারি, ছোলা-তে বোনার দূরত্ব হবে ৩০x১০ সেন্টিমিটার; খারিফ অড়হরে ৫০x২০ সেন্টিমিটার এবং সয়াবীনে ৪০x১০ সেন্টিমিটার। বীজে রাইবোজোমের ব্যবহার জরুরি, জরুরি বীজ শোধনও।
পূর্ণবয়স্ক এবং পুরাতন বাগিচায় আলো-আঁধারিতে, বেশি ছায়ায় আদা-হলুদ, একাঙ্গি, এরারুট, আনারস প্রভৃতি ফসল চাষ করা গেলেও সবুজ-সার ও গো-খাদ্যোপযোগী নানান ডালশস্য চাষ করতে দেখা যায় বাংলার কৃষকদের। তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত গাছের ছায়ায় মাটি ঢাকছে, তত সময় ধরে নতুন উঠতি বাগানে এবং ১০/১২ বা ১৫ বছর অবধি আম/কাঁঠাল/লিচু/সবেদা বাগিচায় অতি সহজে সারি করে বা ছিটিয়ে ডালশস্য ও তৈলবীজ চাষ করা সম্ভব। যে চাষির হাতে সময় বেশি, পুঁজি বেশি, যেখানে সেচের জল আছে, তারা অবশ্য আরও লাভজনক সবজি, অন্যান্য ফল যেমন পেঁপে, ডালিম, পাতি/কাগজি লেবু এবং নানান মশলাপাতি চাষ করে থাকেন।
এমন হতে পারে, আম/লিচু/সবেদা/কাঁঠালের মাঝে কলা-পেঁপের মত স্বল্প উচ্চতার ফল লাগিয়ে তলায় আচ্ছাদন-ফসল রূপে ডালশস্যের চাষ করা। ডাল শিম্বগোত্রীয় ফসল হওয়ায় তা চাষ করে জমির স্বাস্থ্য ও খাদ্য ভান্ডার অটুট রাখা যায়, মাটিতে রাসায়নিক সারের চাহিদা কমে, চাষের খরচ কমে, ভূমিক্ষয় রোধ করা যায়, মাটির আদ্রর্তা বাড়ে।
এক বিঘার বাগিচায় উচ্চমূল্যের সবজি ও অন্যান্য ফসল চাষ করে হাজার চারেক টাকা খরচ করে অতিরিক্ত সাত থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত এক একটি ফসল থেকে লাভ করতে পারবেন। দু’টি সাথী ফসল নিলে এই লাভের অঙ্ক আরও বাড়বে। অনেক জমির মালিক শ্রমিকের অভাবে কিংবা শারীরিক অসামর্থ্যতায় শ্রম-নিবিড় ফসল চাষ করতে সমর্থ হন না।
সেক্ষেত্রে তিনি ফলবাগিচায় ডালশস্যের উপযোগী প্রজাতি ও জাত নির্বাচন করুন ও জমিতে সঠিক সময়ে চাষ দিয়ে ছিটিয়ে কিংবা সারিতে বুনে দিন। এতে বিঘায় অতিরিক্ত দু আড়াই হাজার টাকা খরচ করে এক একটি ডাল ফসল থেকে অতিরিক্ত হাজার পাঁচেক টাকা লাভ করতে পারবেন।
চাষীকে ফল চাষ করতে পরামর্শ দিলে অনেক সময় তিনি সম্মত হন না, কারণ ফল চাষ থেকে লাভ পেতে হলে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ হল, চাষের জমিতেই নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করে সারমাটি দিয়ে নির্বাচিত ফলের গাছ লাগানো এবং ফসল চাষ যেভাবে করা হচ্ছে সেভাবেই কয়েক বছর চালিয়ে যাওয়া। ধীরে ধীরে ফলের গাছ বাড়বে, ফল ধরবে, তখন মাঠের ফসলের সঙ্গে সঙ্গেই ফল থেকেও আয় শুরু হয়ে যাবে।
যদি মনে হয় জমি কিছুটা নিচু তবে মাদা করে, সামান্য মাটি ফেলে গাছ লাগানোর জায়গাটুকু খানিক উঁচু করে তাতে ফলের চারা লাগান এবং প্রাথমিক এক-দুই বছর কলসী-সেচের ব্যবস্থা রাখুন। মাঠের জমিতে প্রদত্ত সেচের ভাগ ফলগাছটিও পাবে। নতুবা এই জল শিকড় ছাড়িয়ে গভীরে চলে যেতো, কাজে লাগতো না। সেচের জলের সদ্ব্যবহার হয় সাথী ফসলচাষে। ডালশস্য যেহেতু শিম্বগোত্রীয় ফসল, তাই তার চাষ করে ফলের বাগানের মাটিতে খাদ্যোপাদান বিশেষত নাইট্রোজেন ও জৈবভাণ্ডারের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়।
ফল বাগানে ডালশস্য: আনুমানিক আয়
ফলের নাম — আম, জাত — হিমসাগর অথবা দোফলা/বারোমাসি, রোপণ পদ্ধতি /ঘনত্ব — দ্বি-বেড়া সারি, গাছের সংখ্যা — হেক্টরে ২২০ টি গাছ ধরে বিঘায় ৩০ টি গাছ।
চতুর্থ বছরে গাছ প্রতি ২ কেজি, বিঘা প্রতি ৬০ কেজি ফলন, ১০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি হলে বিঘায় আয় ৬০০ টাকা। পঞ্চম বছরে গাছ প্রতি ৫ কেজি, বিঘা প্রতি ১৫০ কেজি ফলন, ১০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি হলে বিঘায় আয় ১৫০০ টাকা। ষষ্ঠ বছরে গাছ প্রতি ১২ কেজি, বিঘা প্রতি ৩৭০ কেজি ফলন, ১০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি হলে বিঘায় আয় ৩৭০০ টাকা। সপ্তম বছরে গাছ প্রতি ২০ কেজি, বিঘা প্রতি ৬০০ কেজি ফলন, ১০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি হলে বিঘায় আয় ৬০০০ টাকা।অষ্টম বছরে গাছ প্রতি ৪০ কেজি, বিঘা প্রতি ১২০০ কেজি ফলন, ১০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি হলে বিঘায় আয় ১২,০০০ টাকা।নবম বছরে গাছ প্রতি ৭৫ কেজি, বিঘা প্রতি ২২০০ কেজি ফলন, ১০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি হলে বিঘায় আয় ২২,০০০ টাকা। দশম বছরে গাছ প্রতি ১১০ কেজি, বিঘা প্রতি ৩৩০০ কেজি ফলন, ১০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি হলে বিঘায় আয় ৩৩,০০০ টাকা।যদি হিমসাগর জাত না হয়ে লাগানো হয় বারোমাসি তবে অফ সিজনে কেজি প্রতি ২০ টাকায় তা বেচা যাবে, গাছ প্রতি ফলনও সারা বছরে কিছুটা বেশি হয়। এদিকে আম বাগানে বছরে দুটি ডালশস্য এবং একটি গোখাদ্য বা সবুজ সার ফসল নিলে বছরে অতিরিক্ত লাভ হবে দশ হাজার টাকা। কাজেই হিমসাগর আমের ঘন বাগানে ডালশস্যের দুটি চাষ মিলিয়ে, চাষের খরচ বাদ দিয়ে বিঘায় বার্ষিক লাভ ৩৩ থেকে ৩৫ হাজার টাকা, বারোমাসি আমে এই অঙ্ক ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। বার্ষিক বিঘা প্রতি মোট খরচ ৮-১০ হাজার থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা।
কলাচাষে সাথীফসলরূপে ডাল
অন্যান্য ফল বাগিচার মত কলা চাষের ক্ষেত্রে ডালশস্য চাষ করা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে তেউর অথবা টিস্যু কালচার চারা রোপণ করা হয় দুটি পর্বে — ফাল্গুন-চৈত্র মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) এবং ভাদ্র-আশ্বিন মাসে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর)। জাত ভেদে, ঘনত্ব ভেদে গাছের দূরত্ব ১.৮x১.৮ মিটার (গ্র্যান্ড নাইন), ২x১.৮ মিটার (চাঁপা), ২x২ মিটার (মর্তমান, কাঁচাকলা), ২x২.৫ মিটার (বাগদা, কাঁঠালি)। গ্র্যান্ড নাইন বারো মাসে, মর্তমান ১৩-১৪ মাসে, চাঁপা ১৪-১৬ মাসে এবং কাঁঠালি ১৫-১৭ মাসে পাকে। ফাল্গুনে তেউড় রোপণ হলে প্রাক-খরিফে মুগ, কলাই এবং ভাদ্রমাসে (খারিফোত্তর) গাইমুগ দ্বিতীয় ফসল হিসাবে লাগানো যায়। ভাদ্র-আশ্বিনে তেউড় লাগালে কেবল রবি ডালশস্য হিসাবে খেসারি, মুসুর, মটর, ছোলা বোনা যাবে। কলা চাষে এক বিঘেয় খরচ ২০-২৫ হাজার টাকা, এক বিঘেয় আয় ৪০-৫০ হাজার টাকা, সুতরাং লাভ বিঘেয় ২০-২৫ হাজার টাকা। ডালশস্য চাষ করে অতিরিক্ত লাভ করা সম্ভব, সেই সঙ্গে অধিক প্রাপ্তি মাটির উন্নয়ন।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
অধ্যাপক, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়