পশ্চিমবঙ্গের নতুন লোকসভা আসনগুলির অন্যতম রানাঘাট। জন্ম ২০০৯ সালে। ফলে এ বার চতুর্থ নির্বাচন নদিয়া জেলার এই আসনে। সাবেক নবদ্বীপ আসন ভেঙেই জন্ম রানাঘাটের। নবদ্বীপ বরাবর সিপিএমের হাতেই ছিল। ১৯৭১ থেকে টানা আটটি ভোটে দাঁত ফোটাতে পারেনি অন্য কোনও দল। বরাবর লাখখানেক ভোটেই জয় পেত কাস্তে-হাতুড়ি-তারা। কিন্তু ১৯৯৯ সালে সব অঙ্ক বদলে দেন তৃণমূলের আনন্দমোহন বিশ্বাস। সে বার অবশ্য বিজেপির সঙ্গে জোট ছিল তৃণমূলের। কিন্তু নবদ্বীপে জয় ধরে রাখতে পারেনি তৃণমূল। ২০০৩ সালে আনন্দমোহনের মৃত্যু হয়। উপনির্বাচনে জিতে যান সেই সিপিএমের অলকেশ দাস। পরের ভোট ২০০৪ সালেও অলকেশ জেতেন। তবে ব্যবধান কমে হয় ১০ হাজারের নীচে।
২০০৯ সালে রানাঘাট আসনের জন্ম হতেই তার দখল নেয় তৃণমূল। লক্ষাধিক ভোটে জেতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন চিকিৎসক সুচারুরঞ্জন হালদার। ৮৪ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়ে বিজেপি তখন তৃতীয়। পরের বার ২০১৪ সালে তৃণমূল প্রার্থী বদল করে। চিকিৎসকের পরিবর্তে অধ্যাপক তাপস মণ্ডল। তিনি ব্যবধান দ্বিগুণ করে জয়ী হন। বিজেপি তৃতীয় স্থানে থাকলেও মোদী-হাওয়ায় ভোট বাড়ে তিন গুণেরও বেশি। সেই আসনেই একেবারে এক নম্বরে চলে আসে বিজেপি ২০১৯ সালে। জগন্নাথ সরকার জয়ী হন ২,৩৩,৪২৮ ভোটে। কারণ, তত দিনে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট ঘাসফুল ছেড়ে পদ্মে চলে গিয়েছে।
কিন্তু জগন্নাথের জেতার কথাই ছিল না! এ বার জগন্নাথের লড়াই যাঁর বিরুদ্ধে, সেই তৃণমূল প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারীই প্রথমে পদ্মের টিকিট পেয়েছিলেন। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের চাকরি ছেড়ে প্রার্থী হওয়া মুকুটমণির হয়ে প্রচারও করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু বিধি বাম। দাঁড়াতে পারেননি মুকুটমণি। বিজেপির অন্দরমহলে কান পাতলে শোনা যায়, তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের হস্তক্ষেপেই টিকিট পেয়েছিলেন মুকুটমণি। কিন্তু রাজ্য সরকারের প্রয়োজনীয় ‘ছাড়পত্র’ না মেলায় সরকারি হাসপাতালের চাকরিতে ইস্তফা গৃহীত হয়নি। ফলে মনোনয়নই জমা দিতে পারেননি। শিঁকে ছেঁড়ে তৎকালীন রানাঘাট সাংগঠনিক বিজেপির জেলা সভাপতি জগন্নাথের ভাগ্যে।
সাংসদ হতে না পারলেও মুকুটমণি বিজেপির টিকিটে ২০২১ সালে বিধায়ক হন রানাঘাট দক্ষিণ আসন থেকে। ১৬ হাজারের বেশি ভোটে জেতেন। আশা ছিল, দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে ২০২৪ সালে রানাঘাট লোকসভা থেকে টিকিট পাবেন তিনি। দিল্লি গিয়ে কম দরবারও করেননি। কিন্তু জগন্নাথের নাম আবার বিজেপি প্রার্থী হিসাবে ঘোষিত হয়। দলবদলের সিদ্ধান্ত নেন মুকুটমণি। কলকাতায় আয়োজিত এক মিছিলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি। বিজেপির বিধায়ক পদ ছেড়ে রানাঘাটে তিনি তৃণমূলের প্রার্থী। মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট রানাঘাটের ফলাফলে অনেকটাই প্রভাব ফেলে। জগন্নাথ মতুয়া না হলেও বিজেপি প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন। আর মুকুটমণি নিজেই মতুয়া। তিনি সংগঠনের বড় দায়িত্বেও ছিলেন। সেই অঙ্কেই তৃণমূল প্রার্থী করেছে চিকিৎসক মুকুটমণিকে।
তবে একটা প্রশ্ন থাকছে। বিজেপির বিধায়ক থাকার সময় সিএএ চালু করতে দেরি হচ্ছে কেন, সে প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপে রাখতেন মুকুটমণি। কিন্তু তিনি তাঁর দলবদলের পরে পরেই যখন সিএএ কার্যকর হল, তখন তাঁকে বর্তমান দলীয় নীতি মেনে বলতে হচ্ছে ঠিক উল্টো কথা। যে সূত্রে বিজেপির আশা, মুকুটমণির ১৮০ ডিগ্রি ‘ভোলবদল’ তাঁকে নিজের সম্প্রদায়ের ভোটারদের থেকে দূরে করে দিয়েছে।
চূর্ণী নদীর শহর হিসাবে পরিচিত রানাঘাটের ঘাটে ঘাটে যে লড়াই, তা বাংলার অন্য আসনের থেকে আলাদা করে দিয়েছে দুই সহযোদ্ধার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা। একই দলের হিসাবে ‘সহযোদ্ধা’ বলা হলেও রানাঘাটে সকলেই জানেন জগন্নাথ-মুকুটমণির ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা। আগেও যুযুধান ছিলেন। এখন আরও বেশি। ‘চেনা মাঠে’ লড়াইয়ে জগন্নাথ যেমন কিছু সুবিধা পাচ্ছেন, তেমন কিছু অসুবিধাও রয়েছে। তাঁকে ঘিরে এই লোকসভা আসনে বিজেপির মধ্যেই অনেক বিতর্ক। মুকুটমণি যে হেতু ‘নতুন মাঠে’, তাই তাঁর গায়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ ততটা লাগছে না। তবে বিজেপি থেকে এসে রাতারাতি তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও হজম করতে পারছেন না রানাঘাটের তৃণমূল নেতাদের একাংশ। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেকের কারণেই সকলে মুখ বুজে সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। অন্তত প্রকাশ্যে।
তবে রানাঘাটে আসল কথা বলবে মতুয়া ভোট। এই কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে কৃষ্ণগঞ্জ, রানাঘাট দক্ষিণ, রানাঘাট উত্তর পূর্ব ও চাকদহে মতুয়া ভোটের আধিক্য। বাকি কেন্দ্রগুলিতেও মতুয়া ভোট রয়েছে। তবে তুলনায় কম। গত লোকসভা ভোটের সময় থেকেই মতুয়ারা পদ্মের পক্ষে চলে যান। বিধানসভা ভোটেও তাই। লোকসভা ভোটের নিরিখে বিজেপি যেখানে যেখানে এগিয়ে ছিল, সেই সব আসনে জগন্নাথ ও মুকুটমণি-সহ বিজেপির টিকিটে ছ’জন জেতেন। শুধু নবদ্বীপ আসনটি পায় তৃণমূল। পরে অবশ্য জগন্নাথের ছেড়ে দেওয়া শান্তিপুরে উপনির্বাচনে জিতেছিল তৃণমূল।
সিপিএম প্রার্থী এ বারেও করেছে নবদ্বীপ আসনে দু’বার জয়ী প্রাক্তন সাংসদ অলকেশকেই। চূর্ণী নদী দিয়ে অনেক জলে বয়ে গিয়েছে। এক সময় দল থেকে সাসপেন্ড হয়েছিলেন নবদ্বীপের এই প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ। তবে ফের দলে ফিরে কাজ শুরু করেছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম প্রার্থী করেছিল রমা বিশ্বাসকে। তিনি ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ৬.৬৩ শতাংশ। এটুকু সম্বল করেই লড়াই অলকেশের। বিজেপির সম্বল পাঁচ বছর আগের ৫৩.১১ শতাংশ ভোট। যে নির্বাচনে তৃণমূলের ছিল ৩৭.২৮ শতাংশ।