জেলবন্দি রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রভাব’ দেখে বিস্মিত কলকাতা হাই কোর্ট! বৃহস্পতিবার হাই কোর্টে শুনানি ছিল পার্থের জামিনের মামলার। শুনানি চলাকালীনই বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী বলেন, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন আর মন্ত্রী নেই। অথচ তাঁর ক্ষমতা আমরা এজলাসে বসে টের পাচ্ছি। তিনি এতটাই প্রভাবশালী যে, তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের অনুমোদন দিতে মুখ্যসচিবের কলম উঠছে না!’’
বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং বিচারপতি গৌরাঙ্গ কান্তের ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি ছিল পার্থ-সহ এসএসসির দুই প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য এবং অশোক কুমার সাহার। তিন জনেই তাঁদের বিরুদ্ধে হওয়া সিবিআই মামলায় জামিন চেয়েছিলেন। সেই আবেদনের পাল্টা সিবিআইয়ের বক্তব্য জানতে চায় আদালত। জবাবে সিবিআইয়ের আইনজীবী আদালতকে জানান, তাঁরা এই জামিনের বিরোধী, কারণ এখনও তদন্তকারী সংস্থাটি পার্থদের বিরুদ্ধে তদন্তপ্রক্রিয়াই শুরু করতে পারেনি।
কেন তদন্ত শুরু করা যায়নি তার ব্যাখ্যাও দেয় সিবিআই। আদালতকে তারা বলে, সরকারি আধিকারিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার আগে রাজ্য সরকারের মুখ্যসচিবের অনুমোদন প্রয়োজন হয় অথবা তদন্তের বিষয়ে তাঁকে নিজের অবস্থান জানাতে হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশ পেয়েও মুখ্যসচিব নিজের মতামত জানাননি। ফলে থমকে রয়েছে তদন্তও। সিবিআইয়ের এই বক্তব্য শুনে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে তাঁর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ভর্ৎসনা করেন বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যসচিবকে তাঁর দায়িত্ব পালন করাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে আদালত। তিন বার তাঁকে আদালত নিজের মতামত জানানোর সুযোগ দিয়েছে। চার মাস সময় দেওয়া হয়েছে। তার পরেও তিনি আদালতের নির্দেশ মানেননি।’’ রাজ্যের তরফে আদালতে হাজির ছিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল। তাঁকেই বিচারপতি বাগচী প্রশ্ন করেন, ‘‘এটা কি নেহাতই আমলাতন্ত্রের আলস্য? না কি এর নেপথ্যে অন্য অঙ্ক কাজ করছে?’’
বিচারপতি বাগচী এবং বিচারপতি গৌরাঙ্গ কান্তের বেঞ্চে চলছিল শুনানি। ডিভিশন বেঞ্চের এই প্রশ্নের জবাবে রাজ্যের এজি আরও সাত সপ্তাহ সময় চান আদালতের কাছে। তিনি বলেন, রাজ্যের মুখ্যসচিব বিপি গোপালিককে আরও কিছুটা সময় দেওয়া হোক। সেই আর্জি শোনামাত্রই বেঞ্চ ভর্ৎসনা করে বলে, ‘‘কেন আরও সাত সপ্তাহ সময় চাই? এটা কি বিচারপ্রক্রিয়াকে দেরি করানোর কৌশল? আমরা নির্দেশ দিচ্ছি, মানা হচ্ছে না। বার বার ইচ্ছাকৃত ভাবে একই ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। মুখ্যসচিব তো আমাদের বাধ্য করছেন কড়া পদক্ষেপ করতে।’’
এর পরে আদালত ভর্ৎসনার সুরেই মুখ্যসচিবের উদ্দেশে বলে, ‘‘তাঁর উপর তো কোনও কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি বা কিছুতে বাধ্য করা হয়নি। তাঁকে বলা হয়েছে সিদ্ধান্ত জানান। অথচ তিনি সেটাই জানাতে পারছেন না। গণতন্ত্রে এক জন উচ্চপদস্থ আধিকারিকের এই ভূমিকা আশা করা যায় না। মুখ্যসচিব যদি এর পরে অনুমতি না দেন, তাতেও আমরা অবাক হব না। এখন তো এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক ষড়যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে। অভিযুক্তেরা এতই প্রভাবশালী যে রাজ্যের মুখ্যসচিবের কলম উঠছে না? ’’
বিস্মিত বিচারপতি এর পরেই বলেন, ‘‘ভাবা যায় এমন অবস্থা! এখানে আদৌ স্বচ্ছ নিরপেক্ষ বিচার সম্ভব কি না তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন মন্ত্রী নেই। অথচ আমরা এজলাসে বসে তাঁর ক্ষমতা টের পাচ্ছি। বেশ বুঝতে পারছি এর কারণ কী।’’
আদালতে তখনও পার্থদের জামিন নিয়ে শুনানি শেষ হয়নি। বিচারপতি পার্থদের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনার যখন গোপন বন্ধু আছেন, তারাই তা হলে আপনার জামিনের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। আমাদের জামিনের আর্জি তা হলে খারিজ করে দিতে হবে।’’ আদালতের এই মন্তব্য শুনে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার কথা বলেন রাজ্যের এজি। আদালত জানিয়ে দেয়, শুক্রবার এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে। সেখানেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।