রবীন্দ্র সাহিত্য মানেই সবুজ। সে শিশুসাহিত্য হোক, অথবা রোমান্টিক! ‘শেষের কবিতা’য় যেমন “উদ্ধৃত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ”, তেমনই আগমনীতে শারদলক্ষ্মীর আবাহন করে “আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা”।
রবীন্দ্র-সৃষ্ট শিশুপাঠ্য ‘সহজপাঠ-এ অতি মনোরম ভাবে গাছপালা, ফসল ও অরণ্যের বিবরণ দিয়েছেন সহজ এবং সরল বাক্যে, যা শৈশব পেরিয়ে গেলেও, চুলে পাক ধরলেও আজকের প্রবীণ মন থেকে হারিয়ে যায় না কখনো। এই ক্ষুদ্র আলোচনার পরিসরে বাঙ্গলার শিশুদের জন্য রচিত সেই সাহিত্যিক চিত্রকল্পের অনুসন্ধান করবো। যারা আজ বৃদ্ধ হয়েছেন, অথচ শৈশবে ‘সহজপাঠ’ করেছেন, তাদের মধ্যেও ফিরে আসবে একফালি শৈশব। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, “ঘুমিয়ে থাকে শিশুর পিতা/সব শিশুরই অন্তরে”, তেমনই সকল বৃদ্ধের মধ্যেও কী রয়ে যায় না চির তারুণ্য, চির শৈশবের অনন্ত সত্তা!
সে বহুদিন আগের কথা। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ওয়ান থেকে নানান ক্লাসে পড়ানো হতো সহজপাঠের প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি ভাগ। শিশুরা তখন সবে অক্ষর পরিচিতি লাভ করেছে। এবার ধীরে ধীরে ছোটো ছোটো বাক্য লিখতে শিখবে, তারজন্য মুন্সীয়ানা চাই। রবীন্দ্রনাথই আমাদের ভরসা। তিনি গল্প বলার ঢঙে উপস্থাপন করলেন প্রকৃতিপাঠ এবং উদ্ভিদবৈচিত্র্যের বর্ণনা। সরাসরি দ্বিতীয় ভাগে চলে যাচ্ছি৷
সহজপাঠের দ্বিতীয় ভাগের প্রথম পাঠ, “কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী? ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ।” সারা বাঙ্গলার মানুষ পালং শাক ( Spinacea oleracea F: Chenppodiaceae) চিনলেও পিড়িং শাক ( Trigonella corniculata, F: Fabaceae) চেনেন না৷ পিড়িং শাক শীতকালে ভিজে জমিয়ে জন্মায়, স্বাদ তেতো, বেগুনের সঙ্গে ভেজে খেতে হয়। কার্তিক মাসের প্রথমে বীজ বপন করা চলে। এটি একটি উপকারী ভেষজ — মধুমেহ রোগ সারায়, শরীরের জ্বালা দূর করে, অম্বল ভালো করে। এদিকে পালংশাক শীতকালে ডাঙা জমিতে চাষ হয়, লাগাতে হয় আশ্বিন-কার্তিক মাসে। ফাল্গুন-চৈত্রমাসে বীজ হয়। পালখ মুখরোচক এবং দৈহিক বলকারি, কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় করে, রয়েছে প্রচুর ভিটামিন-A.
দ্বিতীয় পাঠে “বরের বাড়ি অহল্যাপাড়ায়। তিনি আর তাঁর ভাই সৌম্য পাটের ( Corchorus olitorius)ব্যবসা করেন।” একসময় ছিল যখন পাট চাষ ও শিল্প বাঙ্গলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সেদিন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। ‘হাট’ কবিতায় যে কৃষি ফসল বেচাকেনা চলে সেখানে রকমারি উদ্যান ফসল এবং মাঠের ফসল দুই-ই রয়েছে, “জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে/গ্রামের মানুষ বেচে কেনে।/উচ্ছে ( Momordica charantia) বেগুন (Solanum melongena) পটল (Trichosanthes dioica) মুলো ( Raphanus sativus),/বেতের( Calamus tenuis) বোনা ধামা কুলো,/সর্ষে ( Brassica nigra) ছোলা (Cicer arietinum)ময়দা আটা”। সেখানে আর রয়েছে কলসি ভরা এখো ( Saccharum officinarum) গুড় (আখ থেকে দেশজ পদ্ধতিতে প্রস্তুত শর্করা জাতীয় পণ্য) এবং নৌকো বেয়ে আসা খড়ের (Oriza sativa) আঁটি। তৃতীয় পাঠে দেখা যায় মঙ্গলবারে “পাড়ার জঙ্গল সাফ করার দিন”। তারজন্য “সঙ্গে নিতে হবে কুড়ুল, কোদাল, ঝাঁটা, ঝুড়ি।” তথ্য আছে ফসলে পঙ্গপালের আক্রমণের কথা, “এবার পঙ্গপাল এসে বড় ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়-বাবুর বাগানে কপির( Brassica oleracea) পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ ক’রে দিয়েছে। পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে।” সে সময় বঙ্গের কৃষিকাজে মারাত্মকভাবে ফসল নষ্ট করতে হানা দিত মেঘের মতো কালো করে আসা পঙ্গপালের যূথচারী দল। আজ অবশ্য এমন আপদ বিদায় নিয়েছে, তবুও করোনাকালীন পরিস্থিতিতে ভারতে পঙ্গপালের আক্রমণের সংবাদ আমরা পেয়েছি।
চতুর্থ পাঠে ঘরে যে ফুলদানি রাখা হবে “তাতে কুন্দফুল ( Jasminum multiflorum) থাকবে আর আকন্দ ( Calotropis procera) থাকবে।” এ দুই-ই বাঙ্গলার সহজলভ্য ফুল। আকন্দ তো মাঠেঘাটেই জন্মে। কুন্দফুল উদ্যানে কুঞ্জ নির্মাণ করে রোপণ করা হয়। সন্ধ্যা হ’লে ঘরে ধুনোর গন্ধ দেওয়ার কথা আছে এই পাঠে। পঞ্চম পাঠে রয়েছে কর্ণফুলি নদীতে বন্যা দেখা দেওয়ার কথা। সর্ষেক্ষেত ডুবিয়ে দিয়েছে। চাষীদের কাজকর্ম সব বন্ধ। সহজপাঠের এখানেই একটি কবিতায় পাওয়া যাচ্ছে “পুকুর-পাড়ে জিয়ল গাছের বেড়া”, ঝাউতলা। রয়েছে “ফলসাবনে ( Grewia asiatica)গাছে গাছে/ফল ধ’রে মেঘ ঘনিয়ে” আসার কথা। সেখানে “কাঠবেড়ালি লেজটি তুলে হাত থেকে ধান” খায়। সপ্তম পাঠে পাওয়া পেস্তা বাদামের(Pistacia vera) কথা, বস্তা থেকে গুন্তি করে ত্রিশটা আলু(Solanum tuberosum)। আর একটি কবিতায় হাঁক দিয়ে যায় “আতাওয়ালা ( Annona squamosa) নিয়ে ফলের ঝোড়া”। অন্য কবিতায় “বাঁশের( Dendrocalamus sinicus) ডালে ডালে’ রোদ ঝিলমিলিয়ে ওঠে।
দশম পাঠে এঁকেছেন রাত্রের পরিমণ্ডল। শোনা যায় “অশ্বত্থ ( Ficus religiosa)গাছে পেঁচার ডাক”। কবিতায় রোদ পড়ে ” বাঁশ-বাগানের মাথায় মাথায়/তেঁতুল গাছের ( Tamarindus indica) পাতায় পাতায়/হাসায় খিলিখিলি।” আর হারিয়ে পাওয়া আলোতে “নাচায় ডালে ফিরে ফিরে/ঝুমকো ফুলের ( Passiflora caerulea) লতা।” একাদশ পাঠে জঙ্গল ঘন হয়ে আসে। গাছের ফাঁক দিয়ে বাঁকা হয়ে পড়ে রোদ। প্রকাণ্ড অর্জুন ( Terminalia arjuna) গাছের উপর কতকগুলো বাঁদর। বনে “সন্ধ্যা হ’তেই ঘোর অন্ধকার। কাছে তেঁতুল গাছ।” অসংখ্য জোনাকি গাছে গাছে জ্বলছে। পরদিন সকালে জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা মেলেনা, গায়ে বুনো গাছের কাঁটার আঁচড় লাগে। নদীর ধারে ঢিপির ‘পরে গোলপাতা ( Nypa fruticans) দিয়ে ছাওয়া কুঁড়েঘর। কাছে একটা মস্ত বট ( Ficus benghalensis ) গাছ, তার থেকে লম্বা লম্বা ঝুরি নেমেছে। সেই গাছে যত রাজ্যের পাখির বাসা। কাঠুরিয়ারা শক্তিবাবুকে তালপাতার ( Borassus flabellifer)ঠোঙায় চিঁড়ে আর বনের মধু এনে দেয়। দ্বাদশ পাঠে পদ্মার ধারে ছোটো ছোটো ঝাউ ( Tamarix dioica) গাছের জঙ্গল। উনান ধরানোর জন্য বিশ্বম্ভর বাবুর চাকর শম্ভু দা দিয়ে ঝাউডাল কেটে আঁটি বাঁধে। মাঝে একটি কবিতায় ডালা ঝুড়ি ধাম সবজিতে ভরা। ত্রয়োদশ পাঠে “পাড়ার প্রান্তে যে বড় পুষ্করিণী, তার নাম পদ্মপুকুর।”
এই যে চেনা চিত্র, তা গ্রাম বাংলার স্বাভাবিক উদ্ভিদ এবং কৃষিপণ্য। রবীন্দ্রনাথ তা অতি সহজভাবে আরো নানান দরকারি কথার মাঝে শিশুসাহিত্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গের মানুষ বঙ্গবিচ্যুত হতে চান না, না বাস্তবে, না সাহিত্যে। রবীন্দ্র সাহিত্যে তাই শ্যামল প্রকৃতির সহজ সান্নিধ্য। এর সামীপ্য থেকে অতিবৃদ্ধ-শিশুও বিচ্যুত হবে, তার সুযোগ কোথায়! যদি না সহজপাঠ্য-কে স্কুল স্তর থেকে বহিষ্কার করা হয়!
সম্বিত চৌধুরী।