#পর্ব_৩
মহাবীর হনুমান চারিদিকে চায়।
লঙ্কাপুরী পোড়াইতে চিন্তিল উপায়।।
সব ঘর জ্বলে যেন রবির কিরণ।
হেন ঘরে অগ্নি বীর করে সমর্পণ।।
মেঘেতে বিদ্যুৎ যেন লেজে অগ্নি জ্বলে।
লাফ দিয়া পড়ে বীর বড় ঘরের চালে।।
পুত্রের সাহায্য হেতু বায়ু আসি মিলে।
পবনের সাহায্যে দ্বিগুণ অগ্নি জ্বলে।।
ঊনপঞ্চাশৎ বায়ু হয় অধিষ্ঠান।
ঘরে ঘরে লাফ দিয়া ভ্রমে হনুমান।।
এক ঘরে অগ্নি দিতে আর ঘর জ্বলে।
কে করে নির্ব্বাণ তার কেবা কারে বলে।।
তিনিই হনুমান , পবন পুত্র। তিনিই সাধক দেহে প্রাণবায়ু। তিনিই সীতাকে বা কুন্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে পরমাত্মার স্বরূপ রামের নিকট নিয়ে যেতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনিই লঙ্কা দহন করেন। লঙ্কা অর্থাৎ সাধক মতে মুলাধারের লং বীজ। প্রথম পর্বে সে কথা আমি উল্লেখ করেছি।এমন দর্শনের কি বা ব্যাখ্যা? মানবদেহে বা আমাদের শরীরের গুহ্যদেশে থেকে দুই আঙ্গুল উপরে ও লিঙ্গমূল থেকে দুই আঙ্গুল নিম্নে চার আঙ্গুল বিস্তৃত যে যোনীমন্ডল , তার উপরেই বলা হচ্ছে মূলাধার অবস্থিত। বলা হয় মুলাধার চতুর্দ্দল বিশিষ্ট। এখানে ব, শ, ষ, স এই চার বর্ণের অবস্থানের কথাও উল্লেখ আছে। এই পদ্মের কর্নিকার মধ্যে পৃথ্বীমন্ডল তার একপাশে পৃথ্বী বীজ লং আছে বলা হয়। যোগে বসলে সাধক মূলাধারচক্রের শক্তির একটিঊর্ধ্ব গতি অনুভব করেন। তবে এতে যে মূলাধার চক্রের মুখ খুলে যায় এমন মনে করার কারণ নেই। মুলাধারের শক্তি জাগ্রত হলে বলা হয় পঞ্চভূতের পৃথ্বী বা ক্ষিতিতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হয়। এই ক্ষিতিতত্ত্ব পরিত্যাগ হলেই তাঁকে সাধক বলা হয়। তাঁর তখন পার্থিব সঞ্চারী বৃত্তি থেকে মুক্তি ঘটে। অর্থাৎ শরীরের স্থূলতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন সূক্ষ্ম শরীরের ধারণ ক্ষমতা আসে। এটিকেও রাম চরিত্র হিসাবে দেখেন অনেক সাধক।
সম্যক জ্ঞানলাভ হয় লক্ষ্মণ চরিত্রের সহাতায়। বলা হয় যে , পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে ক্ষিতিই হল ঘন সংবদ্ধ উপাদান। যে ঘনত্ব কোনো বস্তুকে ধরে রাখতে পারে। এই ধরে রাখার বৃত্তি নষ্ট হয় লক্ষ্মণের সহায়তায়।লক্ষ্মণই বলে দিচ্ছেন রামের বিকাশ পথ।তখনই সূক্ষ্মতা জন্ম নিচ্ছে সাধক শরীরে। মূলাধার চক্রের পরের ধাপ হল স্বাধিষ্ঠান। জলজ ক্ষেত্র হিসাবে এখানে জলীয় উপাদান থাকার কথা বলা হয়েছে। বলে হয় এটি সৃষ্টি ক্রিয়া ক্ষেত্র। কুন্ডলিনীশক্তি যখন স্বাধিষ্ঠান পেরিয়ে যাচ্ছে তখনই সাধকের জলীয় উপাদান সম্পর্কে জ্ঞান জাগ্রত হয়। স্বাধিষ্ঠান চক্র চক্র অতিক্রম করলে কুন্ডলিনী মণিপুর চক্রে পৌঁছে যায়। এই ক্ষেত্রটিকে বলা হয় তেজক্ষেত্র বা অগ্নিক্ষেত্র। এখান থেকেই আসলে দৈহিক রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তন সূচিত হয় । সাধক শরীরে মণিপুর চক্রের গুরুত্ব অপরিসীম। কুন্ডলিনী শক্তি এখানে উঠলেই জঠরাগ্নি ও ভূতাগ্নির মধ্যে কি পার্থক্য তা স্পষ্ট অনুভব করেন সাধক। যেখানে ভূতাগ্নি বা সূক্ষ্ম দেহের তাপ প্রবল, সেখানে জঠরাগ্নিবা স্থূলদেহের পরিপাকের তাপ দুর্বল।সাধক এই জঠরাগ্নি প্রভাব ক্রমশ দূর করতে থাকেন শরীর থেকে। ফলে, যেটা হয় ভূত অগ্নিতে শরীর ছেয়ে যায়। সাধকের নিকট হনুমানের লঙ্কা দহন অর্থ ভূত অগ্নিতে তাপে শরীরের মূলাধারের লং বীজকে ছারখার করে দেওয়া। একেই প্রতীকদেহের সঙ্গে তুলনা টেনেছেন সাধক।
বলা হয় যে, মণিপুর চক্রের অগ্নিকে যদি সাধক অধিক আয়ত্ত করতে যান তাহলে তিনি খুব দ্রুত ধাতস্থ হতে পারবেন না। তখনই বেরিয়ে পড়বে তাঁর অহংকারের ও আরো নানা রিপু দোষের নানান ভাবাবেগ। একেই সাধক বলেছেন রাবণ। মণিপুর চক্রের পরেই আছে অনাহত চক্র। বলা হয় যে , আধ্যাত্ম ক্রিয়াকলাপ যথার্থ ভাবে বলতে গেলে এই চক্র থেকেই সূচিত হয়। কুন্ডলিনী শক্তি অনাহত চক্রে গিয়ে উপস্থিত হলেই ব্যোমীয় প্রাণীদের সম্পর্কে জ্ঞান হয় সাধকের- এরকমই বলা হয়। অনাহত হল বায়ুমন্ডল ক্ষেত্র। অনাহত চক্রে কুন্ডলিনী শক্তিকে ওঠানো গেলেই ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে নীল আকাশ প্রত্যক্ষ হতে পারে সাধকের চোখে। আসলে সাধক তখন নিজস্ব সূক্ষ্মতার অনন্ত শূন্যতাকেই উপলব্ধি করতে থাকেন।
আধ্যাত্মবাদ বলছে ব্যোমীয় প্রাণীদের কথা।বলছে যে, আমরা যেসব যজ্ঞ অনুষ্ঠান ইত্যাদি করে থাকি তা আসলে এই সব ব্যোমীয় প্রাণীদের নিমিত্ত , তাঁদের ভোজন করাবার নিমিত্ত। যাঁদের আমরা দেবতা বলে থাকি। যজ্ঞের যে সুঘ্রাণ যুক্ত ধুম্র ,তাঁরা সেই ঘ্রাণ গ্রহণ করে তাঁদের ভোজন সম্পন্ন করেন।বহু সাধক মতে যজ্ঞে জঠরাগ্নি নয় ভূত অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা একান্ত প্রয়োজন। যাঁরা ভূতাগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করতে পেরেছেন তাঁরাই যজ্ঞের অধিকারী।
যজ্ঞ করার অর্থ হল আধ্যাত্মিক জ্ঞান।অনাহতে যা আসে বলা হচ্ছে ভূতাগ্নি তাপে । অনাহতেই সাধক শব্দ শুনতে পান। ধ্বনি তাঁর কর্ণে আসে। সেই ধ্বনিকেই সাধক বলেন অনাহত নাদ বা ওঁ। এই ধ্বনি ওঠে সূক্ষ্ম বায়ুর প্রভাবে। মণিপুর চক্রকে ভিত্তি হিসাবে নির্ভর করে ফুসফুসের বায়ু ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এই আওয়াজ সৃষ্টি হয়। সাধক মতে আসলে কুলকুন্ডলিনী শক্তি উঠে এলে যে শক্তি তরঙ্গের সৃষ্টি হয় তা মস্তিকে প্রবেলবেগে গিয়ে সাড়া তোলে তার ফলে সাধক কোনো মানুষের ভাবতরঙ্গে তখন অনায়াসে চলে গিয়ে নিজের ভাবতরঙ্গেকে সমান্তরাল রেখাতে এনে সেই মানুষের মানসিক অবস্থাকে অতি সহজেই ধরতে পারেন। এটা হয় যখন অনাহত চক্রের বায়ু সম্পর্কে সাধকের সম্যক জ্ঞান হয় তখনই।
অনাহতচক্র থেকে শক্তি কুলকুন্ডলিনী শক্তি এরপর উপরে উঠে আসে বিশুদ্ধ চক্রে। এই চক্রকে নির্মল চক্র বলা হয়।কুলকুন্ডলিনীকে ওঠানো গেলে ব্যোম মার্গের জ্ঞান চলে আসে সাধকের। ক্ষিতি ,অপঃ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম যে পঞ্চ তত্ত্ব বা পঞ্চভূত আছে তার মধ্যে সব থেকে সূক্ষ্মতম হল ব্যোম। এই অঞ্চলে কুলকুন্ডলিনী শক্তিকে আনা গেলে চেতনায় ছয় ধরনের যে স্থূল আস্বাদন শক্তি আমাদের আছে যেমন – মিষ্টি,টক, ঝাল, নোনতা, তেতো, কষ্টা…এই সবকে অতিক্রম করে যায়। কুন্ডলিনী শক্তি এখানে এলে এরপর আর কোনো কিছুর বোধ থাকে না। তখন কেবল তিন বোধ থাকে বা আবরণ থাকে – সত্ত্ব , রজ, তম। তারপর কি হয়?
বিশুদ্ধ চক্র থেকে যখন কুণ্ডলিনী আজ্ঞা চক্রে উত্তীর্ণ হয় তখন তৃতীয় নয়ন উনম্মিলিত হয় সাধকের। যাকে শুদ্ধ ভাষাতে বলা হয় দূরদৃষ্টি । সাধক বলেন এখানে সূক্ষ্ম দৃষ্টি হয়, সূক্ষ্ম শ্রুতি হয়।আজ্ঞা পদ্মের দুটো দল আছে । এই দুই দলের পৃথক বীজ মন্ত্র।তার একটি হলো শক্তি মন্ত্র অপর একটি হলো শিব মন্ত্র। আজ্ঞা অর্থাৎ আদেশ অর্থাৎ গুরুর আদেশ। অনেকে একে গুরু চক্রও বলেন। গুরু অর্থাৎ শিব। আজ্ঞা চক্রে কুন্ডলিনী এসে পৌঁছলে শিব জ্ঞান প্রাপ্তি হয় । এই চক্র পার হলেই সহস্রদল। মস্তিষ্ক মন্ডলে যে তিনটি স্তর আছে – আনন্দ +চিৎ + সৎ, সেখানে পৌঁছান যায়।
অর্থাৎ প্রথমে অপরিচ্ছন্ন জ্যোতি দেখতে পান। তারপরই দর্পন তুল্য স্বচ্ছ স্তর ফুটে ওঠে। তারপর দেখা মেলে পরম শূন্যতার । সাধক বলেন একে সচ্চিদানন্দের জাগরণ। যে জাগরনে পরম আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় । সাধক একেই আসলে রাম বলতে উল্লেখ করেছেন। প্রথম পর্বে তেমনি লিখেছিলাম বোধকরি। রামায়ণ এভাবেই আমাদের শরীরে সমাহিত হয়েছে নিয়েছে। পরমাত্মা হয়ে উঠেছেন রাম। তিনি প্রভুত্ব করেছেন করছেন ৭২০০০ নাড়ির ধারক এই মানব শরীরকে …..হয়ে উঠেছেন রাজারাম । তার এই হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছেন লক্ষ্মণ। তিনি পরমাত্মার বিকাশে, জাগরণে মনঃসংযোগ হয়ে বসেছেন। তিনি মনোসংযোগের সাহায্যে সীতাকে জাগ্রত করছেন। কুন্ডলিনী স্থূল দেহ থেকে সূক্ষ্ম, শূন্যতায় চলে যাচ্ছে। যাকে সাধক বলেছেন মস্তিষ্কের বা সহস্রাবের কূটস্থান । সেই স্থানে চলে যাচ্ছেন শক্তি সীতা। লক্ষ্মণের একমাত্র লক্ষ্য হলো সীতার জাগরন। তাঁকে রামের কাছে পৌঁছে দেওয়া। রামায়ণে সেই কথাই বর্ণিত হয়েছে লক্ষ্মণ চরিত্রে। তার জন্যই কর্ষিত হয় আমাদের দেহভান্ড। সেই কর্ষন হলেন জনক রাজা। তিনি শক্তি স্বরূপ সীতাকে লাভ করেছিলেন। এখানে জনক মানব শরীরে কর্ষণকারী হিসাবে নিজেই হাল ধরেছেন। সীতা পাচ্ছেন তিনি।
দশরথ হলেন সাধকের দশ নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় – বাক, পাণি ,পাদ, পায়ু, উপস্থ, ও পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়- চক্ষু, কর্ণ , নাসিকা , জিহ্বা, ত্বক। এগুলি সবই জাগরন হয় যোগের মাধ্যমে।
এভাবেই সাধক পরমাত্মার দেখা পান। যা রাজা রামেই সামিল । এ সবই হয় বায়ু ক্রিয়ার মাধ্যমে।তাই বায়ুই হলেন হনুমান। আর পথের বাধা বিঘ্ন , এগিয়ে যাওয়ার যুদ্ধ হল রাবণের রূপাবয়ব। এই ভাবেই রামায়ণকে আধ্যাত্মিক দর্শনের মাঝে এক অতীন্দ্রিয় ব্যাখায় দেহভান্ড ও রামায়ন করে এক করে দেওয়া সাধক জীবনের এক অভিনব প্রয়াস।
ঈশ্বরে বিশ্বাস জানকীর প্রায় / বন্দিনী ছিল কামনার লঙ্কায়.
উদ্ধারিলে তারে তোমার তপস্যায় / শক্তিরে জাগাইয়া শ্রীরাম-সম ||
তোমার কথামৃত তলির নববেদ / একাধারে রামায়ণ গীতা
বিবেকানন্দ মাঝে লক্ষণ অর্জ্জুন / শক্তি করিলে পুনর্জ্জীবিতা |
ভুভারতে কলহের কুরুক্ষেত্রে / দাঁড়াইলে তুমি আসি সকরুণ নেত্রে
বাজালে অভয় পাঞ্চজন্য শঙ্খ, / বিনাশিলে অদর্ম্ম, হিংসা, আতঙ্ক.
প্রেম-নদীয়ায় তুমি নব-গৌরাঙ্গ / সকল জাতির সখা, প্রিয়তম ||
#সমাপ্ত
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কাপালিক ,তান্ত্রিক, যোগী কথা