শিবের যে দারিদ্র্য, তা আসলে বৈরাগ্যের নামান্তর। তাঁর স্ত্রী স্বয়ং অন্নপূর্ণা, অন্নদাতা, অথচ তিনি ভিখারি। এ এক অভূতপূর্ব বৈপরীত্য! একটা প্রবল প্যারাডক্স, ব্যঞ্জনাধর্মী ব্যাখ্যান। ধন নেই, তা বড় ব্যাপার নয়; ধন মহাদেবের প্রয়োজন নেই। দারিদ্র্যের মধ্যে তো তাঁর অতৃপ্তি নেই! তা বোঝানোর জন্যই তো তিনি শ্মশানচারী! যিনি সিদ্ধিতে নিপুণ, তাঁর পার্থিব ধন-সম্পদের প্রয়োজন আছে কি? অন্নের বেদিতে শুয়ে থাকতে পারে বৈরাগ্যই; যিনি ত্রিগুণাতীত। তা বোঝাতেই তিনি শ্মশানবাসী।
আমরা দেখেছি শিবপুজোর উপকরণ অতি সাধারণ। তাতে প্রকৃতির সহজ অমল সান্নিধ্য। যেমন আকন্দ, ধুতুরা, বেলপাতা, ভাটফুল, হরবরই, সিয়াকুল, বেল, কদবেল, নোনা, ফুটি ইত্যাদি ফুল ও ফল। কৈলাস ছেড়ে মা দুর্গা মর্ত্যধামে এসে সাময়িক আশ্রয় নেন ‘শিবের ফ্ল্যাটবাড়ি’-তে; সেটা এক বিল্ববৃক্ষ। দুর্গাপূজার বোধনে সায়ংকালে সেই বেলগাছের সামনে গিয়ে বিল্বতরুকে আহ্বান করা হয় — “ওঁ মেরুমন্দর-কৈলাস-হিমবচ্ছিখরে গিরৌ। জাতঃ শ্রীফলবৃক্ষ ত্বমম্বিকায়াঃ সদা প্রিয়ঃ। শ্রীশৈলশিখরে জাতঃ শ্রীফলঃ শ্রীনিকেতনঃ। নেতব্যোহসি ময়গচ্ছ পুজ্যো দুর্গাস্বরূপতঃ।।” শিবের সঙ্গে বিল্ববৃক্ষের যোগ বৃক্ষপূজার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শূণ্যপুরাণে শিব সম্পর্কিত একটি ছড়া নিবেদিতাকে দেখিয়েছিলেন বাংলাসাহিত্যের গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন। ছড়া পড়ে নিবেদিতা খুশিতে উদ্বেল; যেন হতদরিদ্র হঠাৎই পেয়ে গেছে এক ঐশী রাজ্য। নিবেদিতা বলছেন, “ও দীনেশবাবু, এটা একটা আশ্চর্য জিনিস!” নিবেদিতা গ্রাম্য-কাব্যের মধ্যে ভারতীয় ভাবের অতুলনীয়তা দেখে আশ্চর্য হলেন। শূণ্যপুরাণে ভগবান শিবের দুঃখে কাতর তার ভক্ত, ভুলে গেছেন নিজের দুঃখও; তাঁকে পরামর্শ দিচ্ছেন চাষ করার।
“আহ্মর বচনে গোসাঞি তুহ্মি চষ চাস।
কখন অন্ন হএ গোসাঞি কখন উপবাস।”
শিবকে ভিক্ষে করে খেতে হয়, এ বড় বিড়ম্বনা; ভিক্ষা করে কোনোদিন কিছু জোটে আবার কোনোদিন নিরম্বু উপবাস। তার চেয়ে শিব বরং ধান চাষ করুন, ধান ভানুক, শিবের কষ্ট দূর হবে —
“ঘরে ধান্ন থাকিলেক পরভু সুখে অন্ন খাব।
অন্নর বিহনে পরভু কত দুঃখ পাব।। “
শিব প্রায় উলঙ্গ, তাকে বাঘছাল পরে কাটাতে হয়; তারচেয়ে বরং শিব কাপাস বুনুক, তুলো থেকে সুতো করে কাপড় বুনুক; তবে শিব সুখী হবে।
ভক্ত তার আরাধ্যকে আরও উপদেশ দিচ্ছে —
“সকল চাষ চস পরভু আর রুইও কলা।
সকল দব্ব পাই জেন ধম্মপূজার বেলা।”
শিবায়ন কাব্যে শিবের চাষের সজ্জা, বীজধান সংগ্রহ, শিবের চাষের জমিতে যাত্রা, ফসলোৎপাদন অংশের বর্ণনা আছে।
“দিন সাত বরষিয়া দিলেক ঈশানে।
হৈল হাল-প্রবাহে শিবের শুভক্ষণে।
বাঙালির কাছে শিব যতটা না দেবতা,তার চাইতেও সে আপন পরিবারের অন্যতম এক সদস্য।তিনি দেবতা না হয়ে গ্রামীণ মানুষের সুখ দুঃখের নিত্য জীবনের সঙ্গী হয়ে যান। দেবতাকে এত কাছের করে নিতে পারেন আর কে আছেন!
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
(ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য)