‘আবর্তিয়া ঋতুমাল্য করে জপ, করে আরাধন দিন গুণে গুণে’–চৈত্র শুক্লা প্রতিপদ, দিন- রাত সমান , নব আনন্দে জেগে উঠেছে মন, চলে গেছে শীতের কামড় , আকাশে-বাতাসে অকারণ পুলকে মেতে ওঠা, কৃষকের পরিশ্রমের ফল পাওয়া অর্থাৎ ফসল কাটার শুরু , মানব জাতির আবির্ভাব এর দিন তাই নাম “বর্ষ প্রতিপদ”। বিদেশী আক্রমণকারীরা বিভিন্ন কারণে বারবার আমাদের দেশ আক্রমণ করেছে , এদের সকলকেই আমরা বীরের ন্যায় পরাস্ত করেছি। ভারতীয় কালগণনা প্রকৃতিদেবীর ওপর ভিত্তি করেই নিরূপিত হয়েছে। বসন্ত ঋতু প্রাকৃতিক কারণে নবজীবনের বার্তা বয়ে আনে। এই সময় প্রকৃতিও নবরূপ ধারণ করে।’কালনির্ণয়’ এর ভূমিকা এবং ভারতীয় পদ্ধতিতে নির্মিত ‘কালপঞ্জী’ বা ক্যালেন্ডারের উৎকৃষ্টতা বেশিরভাগ ভারতীয়ের কাছে এখনো অজানা। কালপঞ্জী , আমাদের সকলের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দৈনন্দিন জীবনে কালপঞ্জী ছাড়া একটি দিন যাপন কল্পনার বাইরে।আমরা বর্তমানে যে কালপঞ্জী ব্যবহার করি তাকে ‘গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ বলা হয় পোপ গ্ৰেগরির নামানুসারে কিন্তু এই পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত নয়, বিজ্ঞান খুঁজতে হলে দেখতে হবে ভারতীয় কালপঞ্জীকে। ভারতীয় পদ্ধতিতে , মহাকাশে চাঁদের গতিকে ২৭ টি নক্ষত্রের মাধ্যমে ২৭ টি ভাগে ভাগ করা হয়।একটি মাসের প্রথম পূর্ণিমার সময় চাঁদের অবস্থান যে নক্ষত্রের কাছে হয় , মাসের নামকরণ সেই নক্ষত্রের নামানুসারে হয়। মাসের নাম ‘বৈশাখ’ কারণ সেই মাসে পূর্ণিমার চাঁদ থাকে বিশাখা নক্ষত্রের কাছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের রীতি অনুযায়ী যে পঞ্চাঙ্গের (পাঁচটি অঙ্গ-তিথি , নক্ষত্র ,বার ,যোগ , কারণ) সাহায্যে কালনির্ণয় করা হয় সেই পদ্ধতিতে সূর্য , চন্দ্র ও নক্ষত্রের অবস্হান জেনে কাল নির্ণয় সহজেই করা যাবে।এই থেকেই প্রমাণিত সূর্য-চন্দ্রের পর্যায়ক্রমিক গতি ও নক্ষত্রের অবস্হান কে কাজে লাগিয়ে নির্মিত কাল গণনা পদ্ধতি অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক।
সম্রাট বিক্রমাদিত্য বহিঃশত্রু দের পরাস্ত করে হিন্দু শৌর্য বীর্যের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারই স্মারক হিসেবে বিক্রম সম্বৎ গণনা আরম্ভ হয়। শকরা একসময় আমাদের দেশকে বার বার আক্রমণ করে দেশের সাংস্কৃতিক চিহ্ন ও মান বিন্দুগুলি ধ্বংস করেছিলেন এবং নানা প্রকার অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়েছিল , সেই নিপীড়ন থেকে দেশ ও সমাজকে বিক্রমাদিত্য উদ্ধার করেছিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য শুধু শকদের পরাস্ত করে হিন্দু সমাজ রক্ষা করেছিলেন তাই ই নয় তাঁর রাজসভাতে কবি কালিদাস ,বরাহমিহির প্রমুখ নয় জন বিখ্যাত পন্ডিতদের সমাবেশ হয়েছিল ,এই বিখ্যাত পন্ডিত মণ্ডলীকে নবরত্ন বলা হত। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় রাজা বিক্রমাদিত্যের শাসনকালে তৎকালীন হিন্দু সমাজ সামগ্রিকভাবে অর্থাৎ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সাহিত্যচর্চায় , রণনৈপুণ্যে , সাহসে ও পরাক্রমে অসাধারণ উন্নতি করেছিল।আমরা যারা জন্মান্তরে বিশ্বাস করি তাদের কাছে আত্মা অমর, পুরাতন দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহে প্রবেশমাত্র অক্ষয় আত্মা অবিনাশী; ঠিক বসন্ত ঋতুতে পর্ণমোচীর পত্রমোচন শেষে যেমন ঝড়াপাতার জঙ্গলে কিশলয় নতুন জীবনের বার্তা নিয়ে আসে, তেমনি নতুন বছর সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে নব উন্মেষের চেতনা নিয়ে আসে।অখণ্ড ভারতের নবরাত্রির পুন্য অবধির মধ্য দিয়ে নব বর্ষ । সভ্যতা সংস্কৃতি প্রকৃতি ও মানবতার প্রতিছায়া।
হিন্দু বিশ্বাস, বর্ষ প্রতিপদ তিথি হচ্ছে জগৎ সংসার সৃষ্টির প্রারম্ভ-দিবস। এদিন মহর্ষি গৌতমের জন্মতিথি। এদিনেই মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক তিথি ও আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠা। সঙ্ঘভগীরথ আদ্য সরসঙ্ঘচালক ডাক্তারজীর আবির্ভাব তিথি যার মনে প্রোথিত হয়েছিল সঙ্ঘশক্তির অমোঘ আহ্বান। তাই দেশপ্রেমে আধারিত, হিন্দু চেতনায় উদ্বুদ্ধ, ত্যাগের দীপ্তিতে উজ্জ্বল এবং সংগঠন কুশলতায় নিরূপম ডাক্তারজী অন্তরাত্মার আহ্বানে যে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ দেশমাতার সেবায় তথা ধর্মরক্ষায় দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছে পরম বৈভবশালি অখন্ড ভারত নির্মাণে।আকবরের ইলাহি ক্যালেণ্ডারের শুরু হিজরি ৯৬৩ সালে, অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রীস্টাব্দে। বর্তমানে ২০২৪ খ্রীস্টাব্দ, অর্থাৎ ইলাহি শুরুর পর ২০২৪-১৫৫৬=৪৬৮ বছর এগিয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই ৪৬৭-র সঙ্গে হিজরি ৯৬৩ যোগ করলে দাঁড়ায় (৯৬৩+৪৬৮=১৪৩১) বঙ্গাব্দের হিসাব। এবার ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। সৃষ্টির সূচনায় আজকের দিনেই প্রজাপতি ব্রহ্মা জগৎ রচনা শুরু করেন। ত্রেতাযুগে আজ মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামের রাজ্যাভিষেক তিথি। দ্বাপরযুগে আজ পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক তিথি।এই দিন থেকেই চৈত্র নবরাত্রির ব্রত – উপবাস – দেবী বাসন্তীর আরাধনা অর্থাৎ শক্তির আরাধনা।এই শুভ তিথিতেই আমাদের প্রতিজ্ঞা নিতে হবে আমরা সকল সনাতনীরা হিন্দুমূল্যবোধ ও নৈতিকতার আঁধারে নিজে বলশালী হব, সৎ , রাষ্ট্রভক্ত , সেবাপ্রেমী পরার্থপর গুণবত্তা সম্পন্ন মানুষ তৈরী করব। শক্তিশালী হিন্দু সমাজই দেশ , ধর্ম , দর্শন, আধ্যাত্মিকতা , সংস্কৃতি ও বিশ্বশান্তি রক্ষা করার একমাত্র উপায় এ সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করার দায়িত্ব আমাদের। এই বোধ নিয়ে কাজ করলে বর্ষপ্রতিপদ উদযাপন আমাদের জীবনে ও জাতির জীবনে সার্থকতা নিয়ে আসবে। “বর্ষ প্রতিপদ” উৎসব আমাদের দেশে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই পালন করা হয়। এই উৎসব স্ফূর্তি ও বিজয়ের , যারা দেশের অখন্ডতা, ধর্ম সংস্কৃতির শত্রু তাদের সংহত শক্তি দিয়েই পরাজিত করতে হবে। নিজ ধর্মকে ভালোবাসতে শিখুন এবং এর কুসংস্কার ও মন্দ দিকগুলো সংস্কার করে সময় উপযোগী করে তুলুন। গাছের শিকড় না থাকলে যেমন গাছ বাঁচতে পারে না ঠিক তেমনি মানুষের ধর্ম না থাকলে তাঁর কোন অস্তিত্ব থাকে না।
সকলকে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই , বাড়িতে বাড়িতে গৈরিক ধ্বজ উত্তোলন করুন, সন্ধ্যায় ৫ টি মাটির প্রদীপ জ্বালুন এবং পরিশেষে অবশ্যই গর্ব করে বলুন “ আমি হিন্দু”।
সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য, বহরমপুর